আসাম এনআরসি: বাংলাদেশের কি উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত? by তাসলিমা ইয়াসমিন

গত বছরের জুলাই মাসে আসামের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনের (এনআরসি) খসড়ায় ৪০ লাখের বেশি লোককে ভারতীয় নাগরিকত্বের বাইরে রাখা হয়। চলতি ৩১ আগস্টের মধ্যে এর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে। এনআরসির অর্থ হলো, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পর আসামে প্রবেশ করা ‘অবৈধ অভিবাসীদের’ চিহ্নিত করে তালিকা থেকে বাদ দেয়া। বাংলাদেশ যখন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল, তখনই খসড়া এনআরসি প্রকাশ করা হয়েছিল। এ নিয়ে বাংলাদেশে অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাদের এই উদ্বেগ ছিল অনেকাংশেই যৌক্তিক। কারণ অবৈধ ঘোষিত লোকদেরকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হতে পারে বলে আশঙ্কার সৃষ্টি হয়। তবে বাংলাদেশের সাথে সরকারি পর্যায়ের বৈঠকগুলোতে ভারত কখনো অবৈধ অভিবাসনের বিষয়টি উত্থাপন না করায় বাংলাদেশও এনআরসি প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেনি।

অবশ্য বেসরকারিভাবে মিডিয়ায় কথা বলার সময় উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কারভাবে জানিয়ে বলেছেন যে ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ থেকে কোনো ধরনের বেআইনি অভিবাসন আসামে ঘটেনি। উভয় দেশের মধ্যকার উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত যোগাযোগে বাংলাদেশকে বারবার আশ্বস্ত করা হয়েছে যে এটা ভারতের স্রেফ একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়। এনআরসি থেকে বাদ পড়াদের বাংলাদেশে প্রত্যাবাসনের কোনো পরিকল্পনা ভারতের নেই।

অবশ্য এসব অনানুষ্ঠানিক অভিমত, সাক্ষাতকার, মিডিয়া বিশ্লেষণ- সবাই ভারতের নির্বাচন-পূর্ব প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত। কখনো কিন্তু পরিষ্কার করে বলা হয়নি যে এনআরসি হলো লোকসভার নির্বাচনে জয়ের একটি কৌশল। কিন্তু নির্বাচনের পর যে গতিতে এনআরসি বাস্তবায়নের কাজ চলছে, তাতে আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে যে সেটা আর স্রেফ রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর নয়। বরং বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারে ভারতের অন্যান্য অংশেও এনআরসি প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল।

তাছাড়া এনআরসি প্রক্রিয়াটি হচ্ছে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের তদারকিতে। আর সেই সুপ্রিম কোর্ট সুস্পষ্টভাবে বলেছে যে এই প্রক্রিয়ায় চিহ্নিত অবৈধ অভিবাসীদেরকে অবশ্যই বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে হবে। এটাই যদি হয়, তবে এনআরসি আর কেবল ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় থাকে না।

অবশ্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক যে পর্যায়ে রয়েছে তাতে করে ভারত এত বিপুলসংখ্যক লোককে বাংলাদেশ সীমান্তে পাঠাবে না বলেই আশা করা যায়। ক্ষমতাসীন বিজেপি ও এনআরসি কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে যে যারা তালিকা থেকে বাদ পড়বে, তারা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারবে। তাছাড়া তারা সুপ্রিম কোর্টেও যাওয়ার সুযোগ পাবে। ফলে যাদের নাম এনআরসির চূড়ান্ত তালিকায় না থাকবে, তাদের ভাগ্য নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে অনেক সময় লাগবে। ফলে আশা করা যেতে পারে অদূর ভবিষ্যতে কাউকে বাংলাদেশে বহিষ্কার করা হচ্ছে না।

কিন্তু এখনই বহিষ্কার করা না হলেও দীর্ঘ মেয়াদে এসব লোক তাদের রাজনৈতিসহ সব অধিকার হারিয়ে শেষ পর্যন্ত কোনো আটক কেন্দ্রে ঠাঁই পাবে। এখন পর্যন্ত হলো, জাতীয়তা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত থেকে এসব লোক কত দিন আসামে থাকা নিরাপদ মনে করবে? পুরো প্রক্রিয়াটি নিশ্চিতভাবেই নজিরবিহীন সংখ্যক লোককে রাষ্ট্রহীন করে তুলবে। আর এর জের ধরে সাম্প্রদায়িকতা ও অনিশ্চয়তা কেবল আসামেই সীমিত থাকবে না। আশঙ্কা করা যেতেই পারে, অধিকার বঞ্চিত এসব লোক প্রতিবেশী দেশগুলোর সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করবে। অর্থাৎ অনাগরিককরণের এই প্রক্রিয়া এই অঞ্চলে বিপজ্জনক মেরুকরণ করতে পারে। পরিণতিতে একপর্যায়ে সীমান্ত পেরিয়ে আসা বিপুল সংখ্যক লোককে গ্রহণ করা লাগতে পারে বাংলাদেশকে।

আর আসামের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জের ধরে বাংলাদেশেও বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা হতে পারে। আসামের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যে কেবল সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, তা বোঝার জন্য খুব বেশি রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির প্রয়োজন পড়ে না। এত বিপুলসংখ্যক লোকের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া অবশ্যই এই অঞ্চলের সার্বিক শান্তি ও নিরাপত্তার ওপর পড়বেই। আর এতে যে দেশ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবে তা হলো বাংলাদেশ। এই প্রেক্ষাপটেই ৩১ আগস্টের চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশের প্রেক্ষাপটে আসন্ন সঙ্কট নিরসনে বাংলাদেশ কী ধরনের কার্যকর কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত তা দেখার বিষয়।
>>>সাউথ এশিয়ান মনিটর

No comments

Powered by Blogger.