এত কষ্ট কীভাবে সইছে শিশুটি! -সরজমিন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল

দুপুর ১টা ৫০ মিনিট। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের প্রবেশমুখে একটি টেলিভিশনের ক্যামেরা রোগীর স্বজনদের ফুটেজ নিতে ব্যস্ত। ছুটির দিনেও হাসপাতালের ইমার্জেন্সি সার্ভিসে জনাকতক মানুষের ভিড় দেখা যায়। সিঁড়ি বেয়ে ভবনের তিন তলার ১১ নং ওয়ার্ডে লবি থেকে শুরু করে সিঁড়ির দু’পাশে অধিকাংশই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। ওয়ার্ডের বাইরে ডান পাশের লবিতে চিকিৎসা নিচ্ছে সার্থক বিশ্বাস। বয়স ১১ মাস। হাতে মস্তবড় একটি ক্যানোলা। বেডের কাছে সাদা পোশাক পরিহিত কাউকে আসতে দেখলেই ভয়ে চিৎকার শুরু করে সার্থক।
এই বুঝি তাকে আবার ইনজেকশন দিবে। ভয়ে মায়ের কোলের মধ্যে লুকায়। এ সময় মা শিলা বিশ্বাস ছেলেকে বলেন, ভয় পেয়ো না বাবা। এরা তোমার মাসি হয়। শরীরের তুলনায় বুক পেটের অংশ অপেক্ষাকৃত বেশি ভারী শিশুটির। ফুসফুসে পানি জমেছে। লিভার বেড়ে গেছে। ১ মাস বয়সে পায়ুপথে ফোঁড়া হয়। সেখানে প্রায় তিনবার অস্ত্রোপচার করা হয়। তার ওপর নিয়মিত জ্বর থাকে শরীরে। গোপালগঞ্জের একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা জানান, তার ডেঙ্গু হয়েছে। ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। পরবর্তীতে এক সপ্তাহ আগে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শিলা বিশ্বাস কান্নাজড়িত কণ্ঠে মানবজমিনকে বলেন, আমার এত কম বয়সী ছেলেটার অবস্থা দেখেছেন কেমন হয়ে গেছে। ও আমার প্রথম সন্তান। ওর বাবা শংকর বিশ্বাস গ্রামে কৃষি কাজ করেন। ছেলে আমার জন্মের একমাস পর থেকেই একটার পর একটা অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে। অবশেষে ডেঙ্গু হলো। ছেলের ফুসফুসের একটি অংশ নাই বললেই চলে এমনটিই জানিয়েছেন ডাক্তাররা। এতোটুকু শরীরে এতো কষ্ট কিভাবে সইছে ও? ভগবান জানেন। ওর শরীরে কতো যে ইনজেকশন আর স্যালাইন পুশ করা হয়েছে তার হিসাব নেই। ছেলে আমার এখন সাদা পোশাকে কাউকে আসতে দেখলেই ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করে। ওর শরীর থেকে জ্বর’ই কমছে না। আশির্বাদ করবেন, ঈশ্বর যেন আমার ছেলেটার দিকে মুখ তুলে তাকায়।

ওয়ার্ডের ভেতরে ফ্লোরে শুয়ে আছে রহমত উল্লাহ। বয়স ৬ মাস। নাকে নল। কপালে ব্যান্ডিজ। মাথার কাছেই একটি স্টিলের বাটিতে বড় একটি ব্যবহৃত ইনজেকশন রাখা। বাবা মো. আল আমিন বলেন, আমাদের বাড়ি বরিশাল। এটা আমার তৃতীয় বাচ্চা। ৬ মাসের ছেলে আমার দেখলে মনে হবে সদ্য জন্ম নেয়া শিশু। ১৫ দিন আগে ওর ঠান্ডা লাগে। সেখান থেকে নিউমোনিয়া। পরবর্তীতে জ্বর। বরিশালের ডাক্তাররা বলেছে ওর ডেঙ্গু হয়েছে। কিন্তু এখানে চিকিৎসকরা বলেছে ডেঙ্গু নয় তবে নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়েছে। তার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। বেড পাইনি।
আতিয়া। বয়স ৮ মাস। হাতে স্যালাইন চলছে। কিন্তু সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। বাবার কোলে উঠতে সে নানান ধরনের কসরত করে যাচ্ছে। মা মায়া আক্তার বলেন, আমাদের বাসা কল্যাণপুর। আতিয়া ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত তিন দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছে। চলতি মাসের পাঁচ তারিখ টেস্ট করালে ওর এনএসওয়ান পজেটিভ আসে। পরবর্তীতে বাসায় রেখে চিকিৎসা করালেও জ্বর না কমায় হাসপাতালে ভর্তি করি। এখন বুকের দুধ খেতে পারে। ডাক্তার বলেছে। দুই একদিনে ছেড়ে দিবে।

পাশের বেডে চিকিৎসা নিচ্ছে জুবায়ের। বয়স মাত্র ১ মাস ৯ দিন। মা শারমিন বলেন, প্রথমে ঠান্ডা ছিল। এরপর কাশি। শরীরে জ্বর আছে। ধারণা করছি ডেঙ্গু হয়েছে। তবে আমার ছেলের মুখে হাসি লেগেই আছে। কোনো অসুস্থ্যতাকে থোরাই কেয়ার করছে। পাশে থাকা নানু বলেন, নাতি আমার এতো অসুস্থ্যতার মধ্যেও হেসে কুটি কুটি। বাচ্চারা সাধারণত দুই থেকে তিন মাসের আগে হাসে না। কিন্তু তার মুখের হাসি যেন ফুরায় না।

ওয়ার্ডের বাইরে বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছে ঝিলমিল। বয়স ৪ বছর। মা ও খালার মাঝখানে শুয়ে আছে ঝিলমিল। হাতে স্যালাইন চলছে। কিন্তু তার কোনো হুশ নেই। পাশে থাকা মা বলেন, আমরা হুমায়ুন রোডের জেনেভা ক্যাম্পে থাকি। গত ৪ দিন ধরে ও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। ওর বাবা বাসায় বসে পোশাকে জরিবুটির কাজ করে। ওর রক্তের প্লাটিলেট কিছুটা ভালো থাকলেও প্রেসারটা খুব বেশি ওঠা নামা করছে। এটা নিয়েই যত ভয় হয়।

No comments

Powered by Blogger.