ট্রাম্পের কেন কাশ্মির প্রশ্নে মধ্যস্ততা করা উচিত by সাবিনা সিদ্দিকি

সাম্প্রাতিক সময়ে কাশ্মির প্রশ্নে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্ততার প্রস্তাব দিয়ে একটি বিতর্ক চাঙ্গা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর থেকেই অঞ্চলটি বিরোধপূর্ণ হয়ে রয়েছে। কাশ্মিরের ৫৫ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত, পাকিস্তান ৩০ ভাগ ও চীন ১৫ ভাগ। এই ইস্যু নিয়ে কয়েকটি যুদ্ধ হয়েছে এবং ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই পরমাণু শক্তিধর হওয়ায় এটি দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পাশে বসে সংবাদ সম্মেলন করার সময় ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ ধরনের আলোচনা করার ব্যবস্থা করার জন্য তাকে বলেছেন। ট্রাম্প বলেন, দুই সপ্তাহ আগে [ওসামায় জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে] নরেন্দ্র মোদির সাথে ছিলাম আমি। আমরা এই বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। তিনি সত্যিই আমাকে বলেছেন, আপনি কি মধ্যস্ততা বা দূতিয়ালি করতে রাজি হবেন? আমি বললাম, কোথায়? তিনি বললেন, কাশ্মির।

কিন্তু তিনি যখন মধ্যস্ততা হতে রাজি হবেন বলেছিলেন, তখন সম্ভবত ট্রাম্প বুঝতে পারেননি এই বিষয়ে বরফ গলানো সহজ নয়। এমনকি গত সাত দশকে জাতিসংঘ পর্যন্ত কাশ্মিরের সন্তোষজনক সমাধান দিতে পারেননি। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ওয়াশিংটনের সম্পৃক্ততা কল্যাণকর হবে। তবে দুই পক্ষ রাজি হলেই কেবল মধ্যস্ততার কাজটি হতে পারে।

প্রায় সাথে সাথেই কাশ্মির প্রশ্নে ট্রাম্পকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা অস্বীকার করে ভারত। এ নিয়ে দেশটির পার্লামেন্টেও উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়। তবে চলতি সপ্তাহে ট্রাম্পকে আবারো সাংবাদিকেরা জিজ্ঞাসা করে, তিনি কাশ্মির প্রশ্নে তার মধ্যস্ততা করার প্রস্তাবে উভয় পক্ষ রাজি হয়েছে কিনা। ট্রাম্প বলেন, মধ্যস্ততার প্রস্তাবটি গ্রহণ করা নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রী মোদির ওপর। অর্থাৎ, ভারতের প্রকাশ্য অবস্থান যাই হোক না কেন, বিষয়টি নিয়ে দুই নেতার সাথেই আলোচনা হয়েছে।

দৃশ্যত, পাকিস্তান সুযোগটিকে স্বাগত জানালেও ভারত তা বিবেচনা করতে পর্যন্ত রাজি নয়। কারণ তারা কাশ্মিরকে আন্তর্জাতিক বিরোধ হিসেব স্বীকার করতে চাচ্ছে না। এর বদলে তারা দুই প্রতিবেশীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় ইস্যু হিসেবে এটিকে তুলে ধরতে চায়। ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র বিবেচনা করে ট্রাম্পও মনে হচ্ছে ভারতকে ক্ষ্যাপাতে চান না। বোধগম্যভাবেই মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরও আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, তারা কাশ্মির বিরোধকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় ইস্যু মনে করে।

তা সত্ত্বেও প্রস্তাবটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে।

প্রথমত, আফগানিস্তানের ১৬ বছরের যুদ্ধ অবসানে পাকিস্তানের সহায়তার বিনিময়েই এই প্রস্তাব দেয়া হয়ে থাকতে পারে। মার্কিন নির্বাচন ঘনিয়ে আসতে থাকায় ট্রাম্প চাইবেন আফগানিস্তানে সফল হতে, সৈন্যদের দেশে ফিরিয়ে আনতে। আর তা করতে পাকিস্তানের সহায়তা প্রয়োজন ভারতের। কাশ্মির সমস্যার সমাধান হয়তো আফগানিস্তানের বিভিন্ন পক্ষের মধ্য যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানের প্রয়াসের পুরস্কার হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, অতীতে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে একসাথে উপকৃত হয়েছে, এমন ঘটনাও আছে। সিন্ধুর পানি বণ্টন চুক্তি, কার্গিল সঙ্ঘাত বন্ধ ইত্যাদি ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাছাড়া ভারতীয় গুপ্তচর কূলভূষণ যাদবের বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় উভয় দেশই মেনে নিয়েছে। অর্থাৎ প্রায়ই তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্ততায় দ্বিপক্ষীয় ইস্যুর সমাধান হতে পারে।

তৃতীয়ত, আফগানিস্তানের মতো কাশ্মিরেও কোনো সামরিক সমাধান নেই। একমাত্র বাস্তব ও স্থায়ী সমাধান হতে পারে ব্যালটের মাধ্যমে। আর কাশ্মিরি জনগণকে জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদে দেয়া অধিকারও নিশ্চিত করতে হবে। ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় কাজটি করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সহজই হবে।

বস্তুত, কাশ্মির সমস্যার সমাধানের চেষ্টা আগেও যুক্তরাষ্ট্র করেছে। কিন্তু অতীতের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। অতীতে যখন পাকিস্তান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ, ভারত ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশে, তখন ওয়াশিংটনকে বিশ্বাস করত না নয়া দিল্লি।

অবশ্য ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনাও রয়েছে। ওয়াশিংটনের কৌশলগত মিত্র হওয়া সত্ত্বেও মস্কোর কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনায় দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাছাড়া ইরান থেকে তেল কেনা নিয়েও জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। এমন এক পরিস্থিতিতে ভারতের বদলে আফগান পরিস্থিতি সামাল দিতে পাকিস্তানের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কামনা করায় ওয়াশিংটন-দিল্লি সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটেছে।

No comments

Powered by Blogger.