দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা by যুবরাজ ঘিমাইর

‘চলতি সপ্তাহে তিনি সত্য-পরবর্তী যুগের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক সাফল্য পেয়ে আমাদেরকে ভবিষ্যত নিয়ে ভীত হতে আরো কারণ ধরিয়ে দিলেন।’ ভারতে নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি উপর্যুপরি দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর ২৩ মে নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়তে এই মন্তব্য করেছিলেন পঙ্কজ মিশ্র। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ১৩০ কোটি মানুষ ও ৯০ কোটি ভোটারের দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি ছিল আগ্রহ এবং সেইসাথে উদ্বেগের বিষয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস যথার্থভাবেই উদ্বেগটি প্রকাশ করেছে। তবে ভারত ও এর বাইরে নির্বাচনী ফলাফলের অর্থ ও প্রভাব পত্রিকাটি অনুধাবন করতে পারেনি।
মোদির বিজেপির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) ৫৪৩ আসনবিশিষ্ট লোকসভায় ৩৫০টির বেশি আসন পেয়েছে। বিজেপি একাই পেয়েছে ৩০৩টি। তারা ৩৭.৫ ভাগ ভোট নিয়ে কেবল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই নিশ্চিত করেনি, সেইসাথে তার নির্বাচনী ইতিহাসে রেকর্ডও গড়েছে। প্রাক-নির্বাচনী যেসব সংশয় ছিল, সেগুলো দূর হয়ে গেছে। মোদি গত আমলের চেয়েও শক্তিশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি কেবল বেশি আসন বা ভোটই পাননি, সেইসাথে ব্যক্তিগত মহাবিজয়ও পেয়েছেন। কারণ বিরোধী দল ও জনমত নেতারা নির্বাচনকে মোদির প্রশ্নে গণভোট হিসেবে তুলে ধরেছিলেন।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় বিজেপি অব্যাহতভাবে জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যুগুলোতে শান দিচ্ছিল, পাকিস্তানের দিকে আঙুল তুলে বলছিল যে বাইরে থেকেই আসছে দেশের প্রতি সবচেয়ে বড় হুমকি, প্রতিবেশী দেশটি সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ করছিল। যুদ্ধের আশঙ্কা সত্ত্বেও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব ঈদ উল ফিতরের উৎসবের সময় ব্যক্তিগত সফরে ৫ জুন ভারতে যান, আর ইসলামাবাদে ভারতীয় হাই কমিশনার অজয় বিশ্বাস পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভির সাথে সাক্ষাত করেন।
এগুলো কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ। দুই দেশ কিভাবে সামনে এগুবে তার ওপর নির্ভর করবে ৩৩ বছরের পুরনো দক্ষিণ এশিয়ান সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) ভবিষ্যত।
দক্ষিণ এশিয়ার এজেন্ডা
যাই হোক না কেন, পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ভারতের কূটনীতি আগামী বছরগুলোতে সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান, শান্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত। চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিষয়টিও তাদের মাথায় আছে।
পাকিস্তান ছাড়াও শ্রীলঙ্কা ও নেপাল বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশে পরিণত হয়ে বিপুল বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে। আর চীনের কাছে নিজের স্টক এক্সচেঞ্জ খুলে দিয়েছে বাংলাদেশ। ভুটান ও চীন আবাসিক মিশন দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু করা নিয়ে আলোচনা করছে। নেপাল ও চীন পার্বত্য রুটে রেলওয়ে কানেকটিভিটি নিয়ে সমীক্ষা শুরু করেছে।
অন্য দিকে চীনা ঋণ ফাঁদে না পড়ার জন্য নেপালকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। হাম্বানতোতা বন্দর নিয়ে শ্রীলঙ্কার সাথে চীনের ৯৯ বছরের ইজারা চুক্তি নিয়ে ভারত অস্বস্তিতে রয়েছে। এসব দেশের কাছে চীনা প্রত্যাহারের পর ভারতের আগমন ভালো বিষয় নয়।
চীনের সাথে ভারতের সূক্ষ্ম ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা ছাড়াও ভারত তার হারানো জমি কিছুটা ফেরত পেতে পারে যদি দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি ও প্রকল্পগুলোতে তাল মেলাতে পারে। ভারতের জন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে অন্য দেশগুলোর সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও হস্তক্ষেপ না করার চীনা নীতি অনুসরণ করা। বৈশ্বিক খেলোয়াড় ও আঞ্চলিক উন্নয়ন ও রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত চীন ও ভারতের এই অঞ্চলে গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হবে শান্তি ও উন্নয়নে তাদের অবদানের ওপর নির্ভর করে।
ভারতের নির্বাচনের মাঝপথেই গত মে মাসে জৈশ-ই-মোহাম্মদের প্রধান মাসুদ আজহারকে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের কালো তালিকাভুক্তির প্রতি সমর্থন দেয়।
অথচ আজহারকে সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা করতে আগের প্রস্তাবগুলোতে চীন ভেটো দিয়েছিল। চীনের এই উদ্যোগ ছিল মোদির ‘জাতীয়তাবাদী কার্ডের’ প্রতি সমর্থন প্রকাশ। তাছাড়া মোদি ও প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ২০১৮ সালের এপ্রিলের ওহান শীর্ষ বৈঠকের আদলে আবারো বসতে যাচ্ছেন। তারা এর মাধ্যমে নিজেদের সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতে চান।
দক্ষিণ এশিয়ায় পরিবর্তিত ভূরাজনীতি: নেপালের উদাহরণ
ওই দুই খেলোয়াড় তাদের মধ্যকার বিরোধগুলো মীমাংসা করবে এবং তাদের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ও শিল্প স্বার্থ রক্ষা করবে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তবে তা কিন্তু এই অঞ্চলের দেশগুলোর প্রতিটির সাথে দ্বিপক্ষীয়ভাবে ভারতের সম্পর্ক কূটনৈতিকভাবে সামাল দেয়ার গুরুত্ব হ্রাস করবে না।
পাকিস্তান-ভারত সম্পর্ক বিশেষ ধরনের। কিন্তু এই অঞ্চলের অন্য সব দেশের সাথেই ভারতের কোনো না কোনো অমীমাংসিত বিষয় রয়ে গেছে। এগুলোর জন্য আলাদা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ প্রয়োজন। তবে অন্যরা ভারতকে যে ‘বড় ভাইসুলভ’ আচরণের জন্য ভয় পায়, তা থেকে তাকে সরে আসতে হবে। নেপালের সাথে সম্পর্ক মেরামত করার ভারতীয় উদ্যোগ এ ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সভ্যতা, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্ম একই হওয়া সত্ত্বেও ভারত ও নেপালের মধ্যে অবিশ্বাস রয়েছে। বিশেষ করে গত ১৩ বছর ধরে সম্পর্কে ভাটা চলছে। ১৯৮০-এর দশকে শ্রীলঙ্কায় যেমন করা হয়েছিল, একইভাবে নেপালের মাওবাদী গেরিলাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল ভারত। এসব গেরিলা ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত নেপালে বিদ্রোহ চালিয়েছিল। ভারতের মধ্যস্ততায় এই বিদ্রোহের অবসান ঘটে। পরে বিশ্বের একমাত্র হিন্দু দেশ নেপাল হয় সেক্যুলার প্রজাতন্ত্র।
আবার এই ভারতই ২০১৫ সালে নেপালি সংবিধানের ব্যাপারে তাদের আপত্তির জের ধরে ১৩৪ দিনের অবরোধ আরোপ করে। এতে নেপালে ভারত আরো অজনপ্রিয় হয়ে পড়ে।
অর্থাৎ চরমপন্থী বামদের প্রতি ভারতের প্রাথমিক সমর্থন ও পরে অর্থনৈতিক অবরোধের ফলে নেপালে ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। এখন পরবর্তী পদক্ষেপগুলোই নির্ধারণ করবে নেপালে মোদি কিভাবে মূল্যায়িত হবেন, কিভাবে নেপালে তিনি ভারতের ভূমিকা ও প্রভাব বিস্তার করবেন। মোদি পরিচিত কাজের লোক হিসেবে। তিনি এই অঞ্চলে আশাবাদ সৃষ্টি করতে পারেন এগিয়ে যাওয়ার জন্য।

No comments

Powered by Blogger.