নতুন আদলে আতিয়া মহল by ওয়েছ খছরু

নতুন আঙ্গিকে গড়ে তোলা হয়েছে আতিয়া মহলকে। সবকিছু পরিপাটি করে সাজানো। বিধ্বস্ত অবস্থার কোনো চিহ্ন নেই। ভাড়াটিয়াদের পদচারণায় মুখরিত গোটা বাসা। তদারকি করছেন মালিক হাজী উস্তার আলী নিজেই। কারও কোনো অভিযোগ নেই। সাংবাদিকদের দেখে স্ব-হাস্যে এগিয়ে আসছেন সবাই। কোনো আতঙ্ক কিংবা উদ্বেগ নেই। সবাই হাসিখুশি। সামনে যেন ভালো কাটে- এই প্রত্যাশা ভাড়াটিয়াসহ এলাকার মানুষেরও। এক বছর পর আতিয়া মহলে গতকাল গিয়ে দেখা গেল এমন পরিবেশ। সিলেট নগরীর পূর্বদিকের এলাকা শিববাড়ী। একাংশ পাঠানপাড়া। কোলাহলমুখোর এলাকা। সব সময় মানুষের আনাগোনা শিববাড়ীতে। বাজারকে কেন্দ্র করে পুরো এলাকা জনাকীর্ণ। একবছর আগে ওই শিববাড়ীর আতিয়া মহলে হয়েছিল সিলেটের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জঙ্গি অভিযান। টানা এক সপ্তাহ থমকে দাঁড়িয়েছিল জনজীবন। উদ্বেগ-আতঙ্ক ঘিরে ফেলেছিল মানুষকে। এলাকা ছেড়ে পালিয়েছিল মানুষ। গতকাল গিয়ে দেখা গেল সেই পরিবেশ আর নেই। সবকিছু স্বাভাবিক। সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কের শিববাড়ী পয়েন্ট দিয়ে পাঠানপাড়া গলিতে ঢুকতেই ডানে আতিয়া মহল। বাসার সামনে গিয়েই দেখা মিলল মালিক হাজী উস্তার আলীর। টিভি মিডিয়ার সাংবাদিকরা গেছেন আতিয়া মহলে। তাদের সঙ্গ দিতে ব্যস্ত তিনি। নতুন করে রঙ দেয়া হয়েছে আতিয়া মহলে। চিক চিক করছে রঙ। উস্তার আলীর মুখে হাসি। বললেন- সেই আতিয়া মহল এখন আর নেই। বদলে ফেলেছি সবকিছু। আবার সরব হয়েছে আতিয়া মহল। অনেক ক্ষতি হয়েছে। এরপরও আতিয়া মহল যে জেগে উঠেছে সেটিই বড় স্বার্থকতা। উস্তার আলীকে সিলেটে এক নামেই চিনেন অনেকে। সিলেটের একজন ব্যবসায়ীও তিনি। পরিচিত মুখ। সামাজিকভাবেও বেশ প্রতিষ্ঠিত। জঙ্গি অভিযানের সময় মুষড়ে যাননি তিনি। হা-হুতাশ করেছেন। মানবজমিনকে জানালেন- অভিযানের পর র‌্যাব’র কাছে আতিয়া মহল হস্তান্তর করা হয়েছিল। র‌্যাব ক্লিনিং অপারেশন চালায়। এরপর তারা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। অভিযানের প্রায় দুই সপ্তাহ পর তিনি সমঝে পেয়েছিলেন। তখন আতিয়া মহল এখনকার মতো ছিল না। ৫ তলাবিশিষ্ট ওই ভবনটি তিনি পেয়েছিলেন বিধ্বস্ত অবস্থায়। টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল আতিয়া মহলের দেয়াল। অভিযানে ক্ষত-বিক্ষত হয় পুরো ভবন। সমঝে পাওয়ার পর তিনি প্রথমে ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে সমীক্ষা চালান। কী কী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে জানতে চান। কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার তার এই সমীক্ষায় অংশ নেন। কয়েকদিন সীমক্ষা চালিয়ে জানান- ভবন ভাঙতে হবে না। রিপেয়ারিং করলেই সেরে যাবে। কিছুটা স্বস্তি পান হাজী উস্তার আলী। ভবনের মূল পিলারগুলো ছিল অক্ষত। তিনি জানান- ইঞ্জিনিয়ারদের কথামতো তিনি ফের কাজ শুরু করেন। শ্রমিক লাগিয়ে আতিয়া মহলকে সাজানোর কাজ চালান। বিধ্বস্ত এই ভবনকে নতুন করে সাজাতে তার সময় লেগেছে প্রায় ৬ মাস। এই সময়ে তিনি পুরাতন সব চিহ্ন মুছে নতুন করে গড়ে তোলেন। এরপর বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ও স্যানেটারি লাইন স্বাভাবিক করেন। গেল বছরের ডিসেম্বর থেকে আতিয়া মহলে ভাড়াটে উঠা শুরু হয়। একে একে প্রায় সব ফ্ল্যাটেই উঠেছেন ভাড়াটিয়া। বাকি ছিল নিচতলার ওই জঙ্গি ফ্ল্যাট। সেখানে কোনো ভাড়াটে উঠছিলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই ফ্ল্যাটেও উঠছেন নতুন ভাড়াটিয়া। সিলেটের একটি প্রবাসী পরিবারের সদস্যরা প্রায় দুই মাস আগে ওই ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। উস্তার আলী জানালেন- ওই ফ্ল্যাটে যারা বাস করছেন তাদের অতীত ঘটনা জানিয়েছি। সবকিছু জেনে-শুনেই তারা এই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন। এখন আতিয়া মহলে র‌্যাব, পুলিশসহ প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তারা ভাড়াটিয়া হিসেবে রয়েছেন। তাদের সব সময় দেখভাল করছেন তিনি নিজেই। আতিয়া মহলের ঘটনার সময়ের ৪ ভাড়াটে পরিবারও এসে উঠেছেন নতুন করে সাজানো বাড়িতে। তারা জানালেন- ঘটনার সময় তাদের পরিবারের সদস্যরাও আতিয়া মহলের ভেতরে আটকা পড়েছিলেন। দুইদিন তারা যেন ছিলেন মৃত্যুর গুহায়। কখন কী হয়- সেই আতঙ্ক তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। অবশেষে সেনা সদস্যরাই তাদের জিম্মি দশা থেকে মুক্ত করেন। বাসার মালিক জানালেন- আতিয়া মহলকে নতুন করে গড়ে তুলতে তার প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। যতদিন ভাড়াটিয়ারা ছিলেন না ততদিন তিনি নিজ থেকে বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল পরিশোধ করতে হয়েছে। পাশাপাশি অভিযানকালীন সময়ে ভাড়াটিয়াদের মালপত্রের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু তারাও কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। অনেকেই নিঃস্ব হয়ে আতিয়া মহল থেকে চলে গেছেন। আতিয়া মহলের পাশেই রয়েছেন আতিয়া মহল-১ নামে আরো একটি বহুতল বাসা। সেই বাসার মালিকও উস্তার আলী। উঠানো ছিল কয়েকটি টিনশেডের ঘর। সেই ঘরগুলো অভিযানের সময় ভেঙে ফেলা হয়েছিল। সেগুলো আর তোলেননি। এখন ভাড়াটিয়াদের যাচাই করে তিনি ফ্ল্যাট ভাড়া দিচ্ছেন। আর ভাড়াটিয়াদের সব পরিচিতি তিনি স্থানীয় মোগলাবাজার থানায় জমা দিয়েছেন। শুধু উস্তার আলীই নন, আশপাশের লোকজনও ভাড়াটিয়া সম্পর্কে সচেতন। সবাই থানায় ভাড়াটিয়াদের তথ্য প্রদান করেছেন। নিজ উদ্যোগে বাসার মালিকরা সেটি করছেন। অভিযানের পর থেকে রাতের বেলা অনেকটা নিরাপদ আতিয়া মহল ও আশপাশের এলাকা। একবছর ধরে প্রতিনিয়তই পুলিশ এলাকায় পাহারা দিচ্ছে। রাত হলে পুলিশের টহল আরো জোরদার করা হয়। স্থানীয় গলি ও বাজারের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- তারা আর সেই ভয়াবহ স্মৃতি মনে করতে চান না। যা ঘটেছে তা কেবল অতীত। সামনে যেন ভালো যায়- সেই প্রত্যাশা তাদের।

No comments

Powered by Blogger.