বাংলাদেশি শান্তিসেনার চোখে কম্বোডিয়া

বাংলাদেশের মতো কম্বোডিয়াও একসময় বিদেশি শাসনে পীড়িত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে দেশটি জাপান দখল করে নেয়। তার আগে ও পরে দীর্ঘদিন ফরাসিরা কম্বোডিয়া শাসন করে। ১৯৫৩ সালে নরোদম সিহানুকের নেতৃত্বে স্বাধীনতা লাভ করলেও নব্বইয়ের দশকের আগ পর্যন্ত দেশটি বারবার গৃহযুদ্ধ ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার হয়; বিশেষ করে ১৯৭৫ সালে লননল সরকারকে হটিয়ে পলপটের নেতৃত্বে কট্টরপন্থীরা ক্ষমতা দখল করলে জনগণের ওপর ভয়াবহ আজাব নেমে আসে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে তারা সাধারণ মানুষের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে, ইতিহাসে তার নজির কম। ১৯৭৯ সালে পলপট সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলেও কম্বোডিয়ায় ক্ষমতার লড়াই চলতে থাকে।
এর সঙ্গে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের পাশাপাশি প্রতিবেশী ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্রও জড়িয়ে পড়ে। জাতিসংঘের উদ্যোগে দীর্ঘ আলোচনার পর গৃহযুদ্ধে লিপ্ত পক্ষগুলো রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে একটি সমঝোতায় উপনীত হয়, যা প্যারিস শান্তিচুক্তি নামে অভিহিত। পরে সেই চুক্তি কার্যকর করতে গঠন করা হয় কম্বোডিয়ায় জাতিসংঘ অন্তর্বর্তীকালীন কর্তৃপক্ষ বা (ইউএনটিএসি) আনটাক। কম্বোডিয়ায় আনটাকের একজন পর্যবেক্ষক ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেই সময়ের তরুণ কর্মকর্তা মো. বায়েজিদ সরোয়ার (বর্তমানে তিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে আসীন)। এর আগে গঠিত ইউনাইটেড নেশন অ্যাডভান্স মিশন ইন কম্বোডিয়া (ইউএনএএমআইসি) নামে যে অগ্রবর্তী মিশন গঠন করা হয়েছিল, তার নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশি কূটনীতিক এ এইচ এস আতাউল করিম। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য গর্বের। ইতিহাস ও নিসর্গপ্রেমী বায়েজিদ সরোয়ার তাঁর কম্বোডিয়া: শান্তিসেনার জার্নাল শুরু করেছেন ১৯৯২ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে, শেষ হয়েছে ১৯৯৩ সালের ৩০ মার্চ। এ সময়ে প্রায় প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও পর্যবেক্ষণ ডায়েরিতে লিখে রাখতেন।
তাঁর দায়িত্ব চুক্তি সইকারী পক্ষগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণপূর্বক প্রতিবেদন তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা। শান্তিসেনার সদস্য হলেও তাঁর কাজটি ছিল অনেকটা বেসামরিক। ফলে স্থানীয় সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ পেয়েছেন। বায়েজিদ বিবদমান পক্ষগুলোর সঙ্গে কথা বলে যেমন তাদের মনোভাব জানতে চেষ্টা করেছেন। সেটি ছিল তাঁর পেশাগত দায়িত্ব। কিন্তু এর বাইরে তিনি যে সাধারণ মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি ও মন বোঝার চেষ্টা করেছেন তার সরল অথচ সরস বর্ণনা আছে প্রতিটি পাতায়। অধ্যায়গুলো তিনি এমনভাবে বিন্যস্ত করেছেন, যাতে পাঠক সহজেই দেশটির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় সখ্য অনুভব করেন। আমরা তাঁর লেখা থেকে জানতে পারি, ভারতের প্রাচীন ইতিহাস-সংস্কৃতির সঙ্গে কম্বোডিয়ার ইতিহাস-সংস্কৃতির অনেক মিল আছে। বারবার তাঁকে টেনে নিয়েছে কম্বোডিয়ার প্রাচীনকালের স্থাপত্যসমূহের সৌন্দর্য, যার সঙ্গে ভারতীয় স্থাপত্যকলার আশ্চর্য মিল রয়েছে। অ্যাংকর সভ্যতার কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘এই সভ্যতার মূলে যেমন ছিল পাথর, তেমনি ছিল জল। তাদের চমৎকার জল ব্যবস্থাপনার জন্য প্রচুর শস্য উৎপাদন সম্ভব হয়েছিল।...অন্যদিকে ধর্ম-দর্শন ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ভারতীয় প্রভাব এই ভূভাগের সাংস্কৃতিক কাঠামো প্রদান করেছিল।...অ্যাংকর ওয়াট মনুমেন্ট কেবল কম্বোডিয়ার নয়, সারা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য। প্রতিবছর লাখ লাখ বিদেশি পর্যটক আসেন এই মন্দির দেখতে। বায়েজিদ কম্বোডিয়ার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে নিজেই প্রশ্ন রেখেছেন, ‘এমন শান্তিপ্রিয় জাতি কেন যুদ্ধে লিপ্ত হলো, খেমাররুজেরাই বা কেন বিপ্লবের নামে ধ্বংসযজ্ঞ চালাল?’ জবাবে সাবেক সরকারি কর্মকর্তা সো নিম তাঁকে বলেছেন, ‘ভিয়েতনাম ও লাওসে যখন যুদ্ধ চলেছে, কম্বোডিয়া তখন শান্ত। তবে কিছুটা ভাঙনের শব্দ পাচ্ছিলাম। সিহানুক যদি তাঁর স্বেচ্ছাচারিতা ও একনায়কসুলভ নীতি বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক শাসন চালু করতেন, তাহলে এই গৃহযুদ্ধ ও অমানবিক খেমাররুজ বিপ্লব এড়ানো যেত।’ সো নিমই তাঁকে জানান, ১৯৭০ সালে এক পাকিস্তানি নারী চিত্রশিল্পী তাঁর ফরাসি বন্ধুকে নিয়ে এসেছিলেন সয়ামরিপ ও অ্যাংকর ওয়াট মন্দির পরিদর্শন করতে। তিনি তাঁদের সহায়তা করেছিলেন। নানা তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে বায়েজিদ নিশ্চিত হয়েছেন, ওই নারী চিত্রশিল্পীই ছিলেন নভেরা আহমেদ। তিনি থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে ভিয়েতনামের যুদ্ধবিধ্বস্ত বিমানের টুকরো টুকরো অংশ নিয়ে একটি প্রদর্শনীও করেছিলেন। কম্বোডিয়ার অধিকাংশ মানুষ জাতিতে খেমার। তাদের অধিকাংশ মানুষের এক ধর্ম, এক ভাষা, একই সংস্কৃতি। তারপরও তারা বছরের পর বছর যুদ্ধে জড়িয়েছে। বাংলাদেশেও অধিকাংশ মানুষের ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি অভিন্ন। আমরাও বিবাদ ও বিভেদের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। বায়েজিদ অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি কম্বোডিয়ার শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী ও বেসামরিক কর্মীদের উজ্জ্বল ভূমিকার কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আনটাক শুধু শান্তিরক্ষা নয়, কম্বোডিয়ার পুনর্নির্মাণের জন্যও ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত। গৃহযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো উন্নয়ন ও পুনর্নির্মাণের এই বিশাল কাজ চলছে; বিধ্বস্ত এয়ারফিল্ড, এয়ার স্ট্রিপ, সড়ক-আবাসন, সেতু মেরামত, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও পুনর্বাসন। মেজর শহিদুল্লাহ বর্তমানে ফিল্ড সাপোর্ট গ্রুপে কাজ করছেন।’ বাংলাদেশের শান্তি মিশনে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা ও লেখক উম্মে মুসলিমাসহ অনেকে ছিলেন। বায়েজিদের মতে, ‘কমিউনিস্ট পার্টি অব কম্পুচিয়ার নেতৃত্বে বিপ্লবের দাবানল সমগ্র কম্বোডিয়াকে জ্বালিয়েছিল (এপ্রিল ১৯৭৫, জানুয়ারি ১৯৭৯), তা ছিল বিপ্লবের ইতিহাসে নৃশংসতম ও প্রাণঘাতী।
মনে করা হয়, খেমাররুজ শাসনামলে ১০ লাখ লোক যুদ্ধ, অনাহার, অতিরিক্ত খাটুনি, বিনা চিকিৎসা ও হত্যার শিকার হয়েছে।’ পলপট সরকার বিপ্লবের নামে জোর করে শহরের মানুষকে গ্রামে পাঠিয়েছিল। এমনকি স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে থাকাও তারা বিপ্লববিরোধী কাজ বলে মনে করত। কম্বোডিয়ায় গণহত্যা নিয়ে যেসব বিদেশি সাংবাদিক লিখেছেন, তাঁদের অনেকের কথা এসেছে বায়েজিদের বইয়ে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক সিডনি শনবার্গ তাঁর কম্বোডীয় আলোকচিত্রী ডিথ প্রানের সহযোগিতায় পলপট বাহিনীর অত্যাচার ও সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠাতেন। একাধিকবার তিনি পলপট বাহিনীর হাতে ধরা পড়েও বেঁচে যান ডিথ প্রানের কারণে। পরে তিনি ডিথ প্রানকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে চাকরিও দিয়েছিলেন। ডিথ প্রানের কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয় একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র কিলিং ফিল্ড। ওয়াশিংটন পোস্ট-এর এলিজাবেথ বেকার ও ফরাসি সাংবাদিক রোনাল্ড নেভুও পলপট সরকারের গণহত্যার মর্মস্পর্শী বিবরণ তুলে ধরেছেন। উল্লেখ্য, সিডনি একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যা নিয়েও নিউইয়র্ক টাইমস–এ ধারাবাহিক প্রতিবেদন করেছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রা ক্ষমতাচ্যুত খেমার গেরিলাদের ‘বীরত্বকাহিনি’ ছেপেছে ‘হটাও ভিয়েতনাম’ শিরোনামে। কিন্তু ভিয়েতনাম কম্বোডিয়া দখল করেনি, স্বৈরাচারী পলপট সরকার উৎখাতে সহায়তা করেছিল মাত্র। কম্বোডিয়ার জাতিসংঘ মিশন ১৯৯৪ সালের মে পর্যন্ত পরিচালিত হয়েছিল। ব্যাপক আশঙ্কা, হুমকি ও চ্যালেঞ্জের মুখে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ১৯৯৩ সালের মে মাসে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়। বায়েজিদের শেষ মন্তব্য, ‘একজন শান্তিরক্ষী হিসেবে গভীর সন্তুষ্টির বিষয় হলো ধীরগতিতে হলেও কম্বোডিয়া গৃহযুদ্ধ থেকে বেরিয়ে এসে মোটামুটি স্থিতিশীল একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সেখানে এখন গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে। দেশটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির পথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। কম্বোডিয়া এখন সরকারি বিদেশি বিনিয়োগের আকর্ষণীয় লক্ষ্যস্থল।’ বাংলাদেশের অনেক উদ্যোক্তাও সেখানে বিনিয়োগ করেছেন। গণহত্যার দায়ে সেখানে পলপটের কয়েকজন সহযোগীর বিচার হয়েছে। বাংলাদেশেও একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। পার্থক্য হলো, কম্বোডিয়ার বিচারটি হয়েছে জাতিসংঘের সহায়তায়, বাংলাদেশ কারও সহায়তা ছাড়াই বিচার করছে। বায়েজিদ বইয়ের শেষে একটি ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন, যা আমাদের সবার চোখ খুলে দিতে পারে।
নরওয়ের অধ্যাপক ডুয়ার হেইজ, যিনি কম্বোডিয়ার যুদ্ধের কারণ অনুসন্ধানে সেখানে গিয়েছিলেন। ডুয়ার হেইজ সাংবাদিক রবার্ট ফিস্কের বন্ধু। তাঁরা দুজন যখন বিমানে দামেস্ক থেকে দক্ষিণ সুদানের জুবা যাচ্ছিলেন, তখন ফিস্ক তাঁকে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার একটি মানচিত্র দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘গোটা অঞ্চলে ভয়ংকর আগুনে জ্বলছে। আরব দুনিয়ার একেকটি দেশ কবরস্থানে পরিণত হচ্ছে। এসব দেশ থেকে হাজারো শরণার্থী ছোটে ইউরোপের দিকে।’ এরপর ডুয়ার হেইজ ফিস্কের কথা টেনে যা বলেছেন, তার সারমর্ম হলো এসব দেশের কুশীলবেরা যেমন এই গৃহযুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন না, তেমনি ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোও একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে দেদার ফায়দা লুটছে। প্রায় আট শ পৃষ্ঠার বৃহৎ আকারের বইয়ে কম্বোডিয়ার ইতিহাস-ঐতিহ্যের পাশাপাশি দেশটির হালনাগাদ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি জানতে সাহায্য করবে। জার্নাল আকারে হলেও বায়েজিদের লেখায় আছে গভীর অনুসন্ধিৎসা ও প্রচুর তথ্য–উপাত্ত। দেশে দেশে শান্তি প্রয়াস নিয়ে যাঁরা জানতে আগ্রহী, তাঁদের জন্য বইটি অবশ্যপাঠ্য বলে মনে করি।
কম্বোডিয়া: শান্তিসেনার জার্নাল। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার। প্রকৃতি, ১ এম্পোরিয়াম, কাঁটাবন, ঢাকা, ১২১৫ প্রচ্ছদ: দেওয়ান আতিকুর রহমান, দাম: ৮৫০ টাকা।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.