এই তো আমাদের বিমানবন্দর!

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষক আলী রীয়াজ বাংলাদেশে এসেছিলেন। আমাদের প্রথম আলোয় তিনি নিয়মিত কলামও লেখেন। যাঁরা খোঁজখবর রাখেন তাঁরা জানবেন, গত বুধবার তিনি ঢাকায় সুশাসনবিষয়ক এক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পড়েছেন। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ আয়োজিত সেমিনারের শিরোনাম ছিল ‘গভর্ন্যান্স: অা ক্রিটিক্যাল এক্সামিনেশন। এই লেখার বিষয় সেই প্রবন্ধ বা সেমিনার নয়। সেমিনার শেষে আলী রীয়াজ শিকাগোর ইলিনয়ে তাঁর কাজের জায়গায় ফিরে গেছেন। বাংলাদেশ থেকে সেখানে পৌঁছাতে প্রায় ২৪ ঘণ্টা সময় লেগেছে। এই দীর্ঘ যাত্রার শেষে ইলিনয়ের বাসায় ফিরে তিনি যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেন, তার সূত্র ধরেই এই লেখা। আমাদের আনন্দ-বেদনা প্রকাশ বা রাগ-ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলার একটা জায়গা এখন ফেসবুকের ওয়াল। আলী রীয়াজ তাঁর ফেসবুকের ওয়ালে যা লিখেছেন তা অনেকটা এ রকম: দীর্ঘ যাত্রার পর তাঁর বাসায় ফেরার আনন্দ মাটি হয়ে গেছে সুটকেস খোলার পর। শিকাগো বিমানবন্দরে লাগেজের তলার অবস্থা দেখে তিনি যা অনুমান করেছিলেন, বাসায় গিয়ে দেখলেন সেটাই সত্য। তাঁর সুটকেসটি খোলা হয়েছিল এবং পরে তাড়াহুড়ো করে ঠেলেঠুলে কাপড়চোপড় আবার ঢোকানো হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে লাগেজের দশা খুবই খারাপ। একটা মূল্যবান জিনিস খোয়া গেছে সুটকেস থেকে। অর্থমূল্যের বিবেচনায় না হলেও দরকারি বিবেচনায় তাঁর কাছে তা যথেষ্ট মূল্যবান।
তবে এই মূল্যবান জিনিস খোয়ানোটা তাঁর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। সুটকেস খোলা ও লাগেজের দশা বর্ণনা করে আলী রীয়াজ লিখেছেন, ‘আমার উদ্বেগটা চুরি করে নেওয়ায় যতটা, তার চেয়ে বেশি নিরাপত্তা নিয়ে। আপনার ব্যাগ থেকে চুরি সম্ভব হলে, সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত এমনকি নিষিদ্ধ জিনিস ঢুকিয়ে দেওয়াও সম্ভব৷ সেটা আবিষ্কৃত হবে ভিন্ন দেশে, বাকিটা কল্পনা করতে পারেন৷ যাত্রীর কী হবে, সেটা বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিরা না ভাবতে পারেন, কিন্তু বিমানবন্দর হিসেবে ঢাকার নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে আগেও প্রশ্ন উঠেছিল, দ্বিতীয়বার উঠলে তার পরিণতি দেশের জন্য ইতিবাচক হবে না৷ ঘটনা ঘটার পর এই নিয়ে আলোচনার ঝড় না তুলে এখনই পদক্ষেপ নিন৷ আমার কত ক্ষতি হলো, সেটা খুব সামান্য বিষয়, বাংলাদেশের কত ক্ষতির আশঙ্কা সেই ভেবেই এই কথাগুলো৷’ আলী রীয়াজের এই ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়ে মনে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের ক্ষতি নিয়ে আমরা কি আদৌ চিন্তিত! এসবে কি আমাদের কিছু আসে-যায়? আমাদের বিমানবন্দর তো এভাবেই চলছে। এই বিমানবন্দর দিয়ে যাঁরা আসা-যাওয়া করেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা কী বলে? লাগেজ চুরি, লাগেজ কাটা, লাগেজের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, বিমানবন্দরের কর্মীদের লাগেজের প্রতি অসভ্য আচরণ, ইমিগ্রেশন পার হতে বেশি সময় লাগা, নিরাপত্তার নামে যাত্রী ও দর্শনার্থীদের হয়রানি—এসবের স্বাদ না নিয়ে কে কবে এই বিমানবন্দর পার হতে পেরেছেন! কখনো কখনো তা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। লাগেজের জন্য একবার তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার অভিজ্ঞতা আমার নিজেরই হয়েছে। আর বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনদের কাছ থেকে তো নিয়মিতই নানা বাজে অভিজ্ঞতা ও এ নিয়ে রাগ-ক্ষোভের কথা শুনি। আলী রীয়াজের ফেসবুক স্ট্যাটাসের নিচে দেখলাম, অনেকেই তাঁদের বিভিন্ন সময়ের নানা অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। অবস্থার আসলে কোনো বদল হয় না। বিশ্বের সবচেয়ে ভালো ও খারাপ বিমানবন্দরের একটি তালিকা নিয়মিত বের হয়। সেবার মান, সুযোগ-সুবিধা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ভিত্তিতে তালিকাটি তৈরি করে ‘দ্য গাইড টু স্লিপিং ইন এয়ারপোর্টস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৪ সালে এশিয়ার সবচেয়ে বাজে ১০টি বিমানবন্দরের মধ্যে ৯ নম্বরে জায়গা হয়েছিল ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের। ২০১৪ সালের ১৯ অক্টোবর সে খবর প্রথম আলো পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। ২০১৬ সালের একটি তালিকাও বের হয়েছে গত বছরের অক্টোবরে।
ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখলাম, এশিয়ার সবচেয়ে বাজে বিমানবন্দরের তালিকায় বাংলাদেশের শাহজালাল বিমানবন্দর দুই বছর পর সেই ৯ নম্বরেই আছে। বোঝা যায় বিমান, বিমানবন্দর ও বেসামরিক বিমান চলাচলের দায়িত্ব নিয়ে যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের টনক বলে তেমন কিছু নেই। আর থাকলেও তা নড়ে না। জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান দ্য গাইড টু স্লিপিং ইন এয়ারপোর্টসের প্রশ্নের জবাবে শাহজালাল বিমানবন্দর সম্পর্কে একজন বলেছেন, ‘উড়োজাহাজ থেকে টার্মিনালে আসার জন্য আমাদের একটি বাসের দরকার ছিল। এ জন্য আমাদের ২০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। বলা হয়েছে অনিবার্য কারণে বাস আসতে দেরি হচ্ছে।’ আমাদের বিমানবন্দর সম্পর্কে সেখানে আরও বলা হয়েছে, এখান থেকে কোথাও যেতে বা আসতে অতিরিক্ত সময় লাগবে। ইমিগ্রেশনের জন্য দীর্ঘ সময় লাগে এবং ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ার কাজের গতি খুবই ধীর। লাগেজের জন্য একইভাবে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়। টার্মিনালের সবখানেই দীর্ঘ লাইন ও সবখানেই বিশৃঙ্খলা। এই হচ্ছে আমাদের বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা। আর নিরাপত্তা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবেই উদ্বেগ আছে। নিরাপত্তার ‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে’ ঘাটতি থাকায় গত বছর যুক্তরাজ্য এই বিমানবন্দর থেকে সরাসরি পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছিল। পরিস্থিতির উন্নতি করতে না পারলে যুক্তরাজ্যে বিমান বাংলাদেশের যাত্রীবাহী ফ্লাইটও নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়তে পারে বলেও তখন সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। ব্রিটেনের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লিখে আমাদের বিমানবন্দর নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা জানিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের বেসরকারি অ্যাভিয়েশন সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠান রেডলাইনের সঙ্গে দুই বছরের পরামর্শসেবা নেওয়ার চুক্তি করে সেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেছে। তবে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে নানা পদক্ষেপের পরও তাতে যে ফাঁকফোকর আছে, তা টের পাওয়া গেল ছুরি হাতে এক যুবকের হামলা ও এক আনসার সদস্যের মৃত্যুর ঘটনায়।
গত বছরের ৭ নভেম্বর এ ঘটনা ঘটে। এর আগে গুলশান হামলার পর নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে গিয়ে বিমানবন্দরে যাত্রী ছাড়া সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। যেখানে যাত্রী ছাড়া কেউ ঢুকতে পারে না, সেখানে নানা বাহিনীর নজরদারির মধ্যে এক যুবক কীভাবে ছুরি হাতে বিমানবন্দরের প্রবেশমুখের ড্রাইভওয়ে পর্যন্ত চলে এলেন, তা সত্যিই বিস্ময়ের। বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা যে কতটা দুর্বল, সেটাও ওই হামলার সময়ে টের পাওয়া গেছে। ছুরির আঘাতে গুরুতর আহত হতভাগা আনসার সদস্যকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে কোনো অ্যাম্বুলেন্স তো দূরে থাক, গাড়িও পাওয়া যায়নি। যাত্রীদের সহায়তায় একটি অটোরিকশায় করে তাঁকে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। বোঝা যায় কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো জরুরি সুযোগ-সুবিধা এখানে নেই। জরুরি চিকিৎসা-সুবিধা আছে—এমন একটি আধুনিক অ্যাম্বুলেন্সে করে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেওয়া গেলে হয়তো সেই আনসার সদস্যকে বাঁচানো যেত। বিমানবন্দর একটি বড় ও বিস্তৃত স্থাপনা। অসংখ্য লোক সেখানে কর্মরত। শত শত যাত্রী সেখান দিয়ে আসা-যাওয়া করেন। এখানে সার্বক্ষণিক জরুরি চিকিৎসাব্যবস্থা থাকবে না! এমন একটি বিমানবন্দর নিয়েই তো আমরা চলছি! ফেসবুকে মাঝেমধ্যে কিছু ভিডিও চোখে পড়ে। পাঠকদের অনেকেই নিশ্চয়ই সেগুলো দেখেছেন। আমাদের বিমানবন্দর ব্যবহারকারী ক্ষুব্ধ যাত্রীদের কেউ কেউ মোবাইল ফোনে রেকর্ড করে এসব ভিডিও ফেসবুকে দিয়েছেন। বিমান থেকে আসা লাগেজগুলোকে কীভাবে বেল্টের ওপর ফেলছেন সেখানকার কর্মীরা! অনেকটা ইচ্ছে করেই যেন লাগেজগুলোকে তাঁরা আছাড় দিচ্ছেন। এমন একটি ভিডিও দেখে আমার মনে হয়েছে অসুস্থ মানসিকতার কেউ অথবা কোনো কারণে ক্ষুব্ধ একজন কর্মী তাঁর সব রাগ–ক্ষোভ ঝাড়ছেন লাগেজগুলোর ওপর। লাগেজ ঠিক থাকবে কীভাবে?
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কোনো কর্তাব্যক্তির নজরে কি এসব ভিডিও কখনো পড়েনি? কোনো ব্যবস্থা হয়েছে কি? পরিস্থিতি পাল্টাবে কীভাবে? নিরাপত্তা এখন এমন ইস্যু যেখানে কোনো আপস নেই। বিশ্বের সব বিমানবন্দরেই নিরাপত্তার নানা বাড়াবাড়ি রয়েছে। কিন্তু কেউ কি এমন বিমানবন্দর দেখেছেন, যেখানে যাত্রীর সঙ্গে কাউকে বিমানবন্দরে টার্মিনালের কাছাকাছিও যেতে দেওয়া হয় না? আপনি কাউকে বিমানবন্দরে নামিয়ে দিতে গেছেন, আপনি যেহেতু যাত্রী নন, আপনাকে ড্রাইভওয়ের নিচেই নামিয়ে দেওয়া হবে। গাড়ি যাত্রীকে নামিয়ে দিয়ে ঘুরে আসবে আর আপনাকে নিচ দিয়ে হেঁটে ওই পারে গিয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ৭০ বছর বয়সী একজন ‘সিনিয়র সিটিজেন’ তাঁর এক আত্মীয়কে বিমানবন্দরে নামাতে গিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী দুর্ভোগে পড়েছিলেন, তার বর্ণনা শোনালেন সেদিন। এসব নিয়ে কারও কি কোনো চিন্তা আছে? নিরাপত্তার কারণে কারও লাগেজ বা সুটকেস খুলতে পারে নিরাপত্তা বাহিনী। কিন্তু যাঁর লাগেজ বা সুটকেস খোলা হয়েছিল, তাঁকে অন্তত তা জানাতে হবে। লাগেজের সঙ্গে একটি চিঠি বা নোট থাকবে। আর চোরেরা খুলে থাকলে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে তার দায় নিতে হবে। আমাদের বিমানবন্দর এমনই এক বিমানবন্দর যে এখানে কারও কোনো দায় নেই। আসলে দায় তখনই থাকে, যখন দায়িত্বে অবহেলা বা ব্যর্থতার জন্য কাউকে শাস্তির মুখোমুখি অথবা চাকরি হারাতে হয়। আমাদের দেশে কারও সেই ভয় নেই। মন্ত্রীরও নেই, লাগেজ নামানো কর্মীরও নেই। ফলে কারও কোনো দায়ও নেই। আমাদের বিমানবন্দর যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলবে!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.