‘দেয়ালেঘেরা আমেরিকা হবে জেলখানা’

‘আমার নাম ড্যানিয়েলা, আমার মাথায় এই যে সুন্দর কোঁকড়া চুলগুলো দেখতে পাচ্ছেন, এগুলো আমি পেতাম না, যদি না আমার ইরানিয়ান মা ভালোবেসে আমার আমেরিকান বাবার হাত না ধরতেন...আমার মা, সাবিয়েলার মতো এমন অসংখ্য মমতাময়ী মাকে বিমানবন্দরে আটকে রেখে, তাঁদের এ দেশে ঢুকতে না দিয়ে আমেরিকা কখনো গ্রেট হতে পারে না।’ এমন অসংখ্য মানুষের ছোট ছোট বেদনার গল্পে ভরে উঠেছিল গতকাল সান ফ্রান্সিসকোর সিভিক সেন্টার প্লাজার ‘নো ব্যান নো ওয়াল’ (কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়, দেয়াল নয়) প্রতিবাদ সভা। শনিবার বেলা তিনটা থেকে শুরু হওয়া এই প্রতিবাদ সভায় হাজির হন ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে নানা পেশার মানুষ। শুধু সান ফ্রান্সিসকোই নয়, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসিসহ কয়েকটি শহরে হয়েছে বিক্ষোভ মিছিল। মিছিল বেরিয়েছে আটলান্টিকের ওপারে লন্ডন, প্যারিসসহ ইউরোপের অনেক শহরে। ফেসবুকে এই প্রতিবাদ সভার খবর পেয়ে আমি কাল (শনিবার) রওনা দিলাম সেদিকে। সিভিক সেন্টার প্লাজা স্টেশনে নেমে মানুষের স্রোতের সঙ্গে একরকম ভাসতে ভাসতেই চলে এলাম প্লাজার সামনে। হাজার হাজার মানুষে ঘিরে থাকা ছোট্ট একটা মঞ্চে তখন একজন আবৃত্তি করছেন কেনিয়ান বংশোদ্ভূত সোমালিয়ান কবি ওয়ারসান শায়ারের কবিতা ‘হোম’ (ঘর)। কবিতার প্রথম চরণ: ‘কেউ ঘর ছাড়ে না,
যদি না ঘর হয় এক ভয়ংকর হাঙরের মুখ; মানুষ তখনই সীমান্তে দৌড়ায়, যখন পুরো শহর সেদিকে দৌড়ায়...’ কবিতা শুনতে শুনতে ভিজে আসে চোখ। ভেজা চোখেই মঞ্চে ওঠেন ডাক্তার ও আলোকচিত্রী র্যাচেল। মাইক ধরে বলেন, ‘আমরাই বোমা মেরে তাদের জীবনের এক করুণ বাস্তবতায় পৌঁছে দিয়ে এখন তাদেরকে শরণার্থী নাম দিয়ে নিষিদ্ধ করে দিচ্ছি। এটা আমার আমেরিকা না, এ আমার প্রেসিডেন্ট না।’ একের পর এক গান, কবিতা আর ছোট ছোট অভিজ্ঞার গল্পে প্রতিবাদ সভা চলে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। সভার আয়োজক ছিলেন সাবেক ফেসবুক, গুগল ও স্পেসএক্স কর্মকর্তা বার্টন ও ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার তিন সাবেক ছাত্রী। অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস ছিলেন সিরিয়ান শরাণার্থী পরিবারের সন্তান। সেদিকে ইঙ্গিত করে একজন প্ল্যাকার্ডে লিখেছেন, ‘নো সিরিয়ান, নো স্টিভ জবস, নো আইফোন।’ লেবানন থেকে মিসর, আরব শরণার্থীদের হাত ধরে ‘হামাস’ এখন খুব জনপ্রিয় খাবার আমেরিকায়। তাই একজন লিখেছেন, ‘আমরা শরণার্থীরা তোমাদের হামাস দিয়েছি, এর বেশি আর কী চাও?’ প্রতিবাদ সভা শেষে একদল বড় একটা ড্রাম বাজিয়ে শুরু করল নাচ, ইয়েমেনি একজন বাজানো শুরু করলেন বাঁশি। আমি হাঁটা দিলাম মেট্রো স্টেশনের দিকে। পথে আলাপ হলো এক আমেরিকান নাগরিকের সঙ্গে। তাঁকে বললাম, ‘আমেরিকা যদি মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তোলে, একজন আমেরিকান হিসেবে তোমার সমস্যাটা কী?’ শান্ত স্বরে সে বলল, ‘কোনো মুক্ত মানুষের চারদিকে কোনো দেয়াল থাকে দেখেছ? দেয়াল থাকে জেলখানায়। দেয়ালেঘেরা আমেরিকা হবে জেলখানা।’

No comments

Powered by Blogger.