নতুন নিষেধাজ্ঞা অন্যায্য

ট্রাম্পের ক্ষমতায় আরোহণের পর অনেক ইরানি বিশ্লেষক ভয় পেয়েছিলেন, নতুন প্রেসিডেন্ট হয়তো ঐতিহাসিক পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করবেন, যে চুক্তির মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিনিময়ে ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি সংকুচিত করে। কিন্তু তাঁরা এটা তেমন একটা বুঝতে পারেননি যে ইরানসহ সাতটি মুসলিম দেশের অভিবাসী, ছাত্র, ক্রীড়াবিদ ও অন্য দর্শনার্থীদের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরোক্ষ ক্ষতি হিসেবে ইরানকে নতুন করে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হবে। কথা হচ্ছে, গত ৩০ বছর সরকারি পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সম্পর্কে অনেক উত্থান-পতন সত্ত্বেও হাজার হাজার সাধারণ ইরানি যুক্তরাষ্ট্রে যাতায়াত করেছেন। তাঁরা যেমন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা, খেলাধুলায় অংশগ্রহণ ও শিল্পবিষয়ক অনুষ্ঠানেও যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। এখন পর্যন্ত কোনো ইরানির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগ ওঠেনি। তা সত্ত্বেও ট্রাম্প প্রশাসনের নির্দেশনার কারণে কোনো ইরানি অন্তত আগামী ১২০ দিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করতে পারবেন না।
একই সঙ্গে ইরানসহ সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন, সুদান ও সোমালিয়ার দর্শনার্থীরা আগামী তিন মাস এখানে আসতে পারবেন না। গত শুক্রবারের এই নির্বাহী আদেশ জারি করার আগে ট্রাম্প মার্কিন সরকারের অন্য অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা করেননি, ফলে বিদেশি সরকারের সঙ্গে আলোচনার তো প্রশ্নই আসে না। এতে মানুষের যেমন হৃদয়ভঙ্গ হয়েছে, তেমনি বহু মানুষকে বিমান থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে এসে পড়েছিলেন, তাঁরা বিমানবন্দরে আটকা পড়েছেন। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়ন কেনেডি বিমানবন্দরে আটকা পড়া দুই ইরাকি নাগরিকের পক্ষ থেকে যে আইনি উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে এই মানুষেরা আরও সাত দিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকার অনুমতি পেয়েছেন। কিন্তু তাঁদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এই নীতিটা নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো, যার কারণে পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। এতে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতা ব্যাহত হবে, তেমনি ইরাকের মতো দেশে মার্কিন কর্মকর্তারা আরও বিপদের মুখে পড়বেন। দুর্ভাগ্যবশত এটি ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য ব্লুপ্রিন্ট হিসেবে কাজ করবে: সমস্যা বানাও অথবা তাকে অতিরঞ্জিত করো আর প্রকৃত সমস্যা এড়িয়ে যাও, এরপর ‘সমাধান’ বের করো, যার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। মার্কিন গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ইতিমধ্যে আক্রান্ত দেশের শরণার্থী, এমনকি সাধারণ দর্শনার্থীদেরও ব্যাপকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা শুরু করেছে। সম্ভবত এ কারণেই তাদের কারও বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা ইউরোপের মতো নয়, অর্থাৎ ট্রাম্প যে ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনা টানেন, তা ঠিক নয়। কারণ, ইউরোপে ১০ লক্ষাধিক সিরীয় শরণার্থী প্রাক্ যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঢুকে পড়েছে,
যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে বাঁচতে সমুদ্র ও বন্ধুর সড়কপথ ধরে সেখানে আসছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যাচ্ছে, সেখানে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা মানুষেরাই সন্ত্রাসী কার্যক্রমে বেশি জড়িত। জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি প্রোগ্রাম অন এক্সট্রিমিজম অনুসারে, ২০১৪ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রে আইএসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে যে ১১৩ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই মার্কিন নাগরিক বা সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। দুর্ভাগ্যবশত এই ভিসা–নিষেধাজ্ঞার কারণে মার্কিন মুসলমানেরা সরকারের সন্ত্রাসীবিরোধী কার্যক্রমে সহায়তা করতে অনিচ্ছুক হতে পারেন। বিষয়টি হচ্ছে ইরাক, লিবিয়া ও ইয়েমেনের মতো দেশে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি সামরিক বল প্রয়োগ করেছে, সেখানকার মানুষের ওপর ভ্রমণ–নিষেধাজ্ঞা আরোপ করাটা ক্ষীণদৃষ্টির পরিচায়ক, যেটা তার কঠিন হৃদয়ের সাক্ষ্য দেয়। সিরীয়দের ওপর অনির্দিষ্টকালের জন্য অভিবাসন–নিষেধাজ্ঞাও একই ব্যাপার, যেখানে গৃহযুদ্ধের কারণে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ গৃহচ্যুত এবং প্রায় ৫০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়েছে। সারা পৃথিবীতে এখন প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ শরণার্থী রয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে যে অর্থবছর শেষ হলো, সেবার যুক্তরাষ্ট্র ৮৫ হাজার শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, যাদের মধ্যে ১৩ হাজার সিরীয় নাগরিক। ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের আগে ওবামা প্রশাসন আরও ৪ হাজার ৭৭০ জন সিরীয়সহ ২৫ হাজার শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, যাদের ২০১৭ অর্থবছরে মোট ১ লাখ ১০ হাজার শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল।
ট্রাম্প প্রশাসন ইতিমধ্যে এই সংখ্যা কমিয়ে ৫০ হাজার নির্ধারণ করেছে। তারা হয়তো আর কোনো সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দেবে না, যদিও তারা ৬০ হাজার সিরীয় নাগরিককে ইতিমধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। শনিবার জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ট্রাম্পকে ফোন করে এটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন যে শরণার্থীদের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন। অন্যদিকে ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের এই সিদ্ধান্তও একটি গুরুতর ব্যাপার। যে মার্কিন নাগরিকেরা ইরান সফল করেছেন, তাঁরা জানেন, অধিকাংশ ইরানি মানুষের গভীর যুক্তরাষ্ট্রপ্রীতি রয়েছে। তাঁরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে স্বাধীনতা ও সুযোগের আলোক-সংকেত। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার পর মুসলিম দুনিয়ার মধ্যে শুধু ইরানি নাগরিকেরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিল করেছেন। রাজধানী তেহরানে তাঁরা মোমবাতি মিছিল করেছেন। পারমাণবিক চুক্তির পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। যদিও ইরান কিছু ইরানি মার্কিন নাগরিককে ভুয়া অভিযোগে অন্তরীণ করেছিল, তা সত্ত্বেও আরও বেশি মার্কিন নাগরিক ইরান ভ্রমণ শুরু করেছিলেন। সেই প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে ইরানি ছাত্রদের আগমন এবং ক্রীড়াবিদদের (অ্যাথলেট) যাতায়াত বেড়ে যায়। ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের পর ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলে, ইরানকে পাল্টা নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ দ্রুতই টুইট বার্তায় বলেন,
যে মার্কিনদের হাতে এখন ভিসা রয়েছে, তাঁরা ইরান ভ্রমণ করতে পারবেন। কথা হচ্ছে, ট্রাম্পের পিতামহ জার্মানি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন, তাঁর মা এসেছিলেন স্কটল্যান্ড থেকে, তাঁর স্ত্রী স্লোভেনিয়া থেকে। ট্রাম্পের নির্বাচনে বিজয়ের আংশিক কারণ হচ্ছে, তিনি লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কালো চামড়ার মানুষের সম্পর্কে ভীতি সৃষ্টি করেছিলেন। এমনকি তিনি মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তোলারও অঙ্গীকার করেছেন, যদিও কয়েক বছরে অবৈধ অভিবাসন অনেকটা কমে গেছে। দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে। এ অবস্থায় সেই প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করা নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য কতটা বিজ্ঞোচিত হবে, তা বলা মুশকিল। এই জটিল পৃথিবীতে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও জনগণের আন্তসম্পর্ক পণ্য হিসেবে বেশ মূল্যবান। আশা করা যায়, নতুন প্রশাসন এই নতুন নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্ত বাতিল করবে অথবা এই দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপারটি নবায়ন করবে না।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, ভয়েস অব আমেরিকা থেকে নেওয়া।
বারবারা স্লাভিন: ফিউচার অব ইরান ইনিশিয়েটিভের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.