নতুন কমিশন নিয়োগের জন্য বিবেচ্য

আমরা সব সময় সংবিধানমতে চলার কথা বলি। কিন্তু অনেক সময় মুখে বলি এক, বাস্তবে করি আরেক। অনেক সময় চিন্তার দীনতা প্রকট হয়ে ওঠে। আর কয়েক দিনের মধ্যেই নতুন নির্বাচন কমিশন পাব। আমাদের উচিত শুধু একজন সিইসি নয়, ভাবী সিইসি পেতে পারি এমন চার কমিশনারকে বেছে নেওয়া, যাতে এই কমিশনের মেয়াদ শেষে তাঁদের একজন সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। প্রাতিষ্ঠানিক স্মৃতি ও দায়িত্বের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বয়স অনধিক ৭০ বিবেচনার যে খবর পাই, তা যথাযথ নয়, কর্মক্ষমতা ও মানসিক সামর্থ্য ৭০ এর বেশে পরেও অনেকের টিকে থাকে। এটা মনে রেখেই সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের ২ দফার দিকে নজর রাখা উচিত। প্রজ্ঞাপনটি জারি করতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের ১ উপদফার উদ্দেশ্য পূরণের কথা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু একই অনুচ্ছেদের ২ দফার খ উপদফার দিকে নজর দিতে হবে। এতে বলা হয়েছে, ‘অন্য কোন নির্বাচন কমিশনার অনুরূপ পদে কর্মাবসানের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনাররূপে নিয়োগলাভের যোগ্য হবেন।’ সুতরাং পাঁচ বছর পরে নবনিযুক্ত চার কমিশনারের যখন কর্মাবসান ঘটবে, তখন তাঁদের যাতে আমরা অন্তত সিইসি করার কথা ভাবতে পারি। বর্তমানে যেটা চলছে তা একটা গলাকাটা ব্যবস্থা বটে! পাঁচজনের চারজনকেই আমরা মাত্র পাঁচ বছর কাজ করিয়ে তাঁদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান আমরা আর কাজে লাগাব না? বিদায়ী কমিশন অবশ্য একেবারেই ব্যতিক্রম।
সরকারের আজ্ঞাবহ হওয়ার কারণে তাঁরা যতটা বিতর্কিত হয়েছেন, তাতে কমিশনারদের কারোরই আর সেই সুযোগ পাওয়ার অধিকার আছে বলে মানা যায় না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের আগে একজন দায়িত্বশীল নেতা ভারত ঘুরে এসে বললেন, তিনি নিশ্চিত জেনে এসেছেন যে, সেখানে লোকসভা রেখেও লোকসভা নির্বাচন হয়। তাঁর যুক্তি: লোকসভা রেখে লোকসভা হওয়া গণতান্ত্রিক হলে এখানে হবে না কেন। বেশ কথা। তাহলে ভারতের মডেলেই পরের সিইসি করার মতো পরিবেশ তৈরি করা হোক। সাধারণত জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ পান, ভারতে এখন সেভাবে সিইসি নিয়োগের রেওয়াজ গড়ে উঠেছে। আমরা শুধু নই, বিশ্বের বহু দেশ জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগকেই মানে, কারণ এর সঙ্গে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতার প্রশ্ন জড়িত। একই যুক্তিতে সিইসি নিয়োগের সঙ্গে নির্বাচনব্যবস্থার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার প্রশ্ন জড়িত। সুপ্রিম কোর্টের যেভাবে স্বাধীন সচিবালয় আছে, সংসদের যেভাবে একটি স্বাধীন সচিবালয় আছে, সেভাবে ইসির একটি স্বাধীন সচিবালয় থাকবে। ভারতের আইন কমিশন বলেছে,
এই স্বাধীন সচিবালয় থাকার বিধান সংবিধানে লিখে নিতে হবে। আমরাও একই দাবি তুলছি। তবে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সিইসি নিয়োগ দিতে আমাদের রাজনীতিকেরা কেন পলায়নপরতার পরিচয় দিয়ে চলছেন, সেটা ভেবে দেখতে অনুরোধ করি। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করব, কিন্তু রেওয়াজটা থাকবে তত্ত্বাবধায়ক আমলের খেলোয়াড় ভাড়ায় আনার মতোই, সেটা তো গণতান্ত্রিক হতে পারে না। আগামী পাঁচ বছর পরে আরও একবার হায়ারের প্লেয়ার আনতে বঙ্গভবনে ছোটাছুটি না চাইলে, এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা এবারের নতুন মুখগুলোকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত থাকব, কিন্তু উৎকণ্ঠায় থাকব। এখন যাঁরা কমিশনের সদস্য হবেন, তাঁদের মধ্য থেকে পাঁচ বছর পরে কাউকে সিইসি করার কথা যদি এখনকার অনুসন্ধান কমিটি বিবেচনায় না নেয় তবে ধরে নিতে হবে, আমরা ভুল পথে হাঁটছি। পথ শুধরে নিতে হবে।ভারতে গত ১৪ বছরে নয়জন সিইসি এসেছেন। এর আগের ১৪ বছরে মাত্র তিনজন সিইসি ছিলেন। গড়ে তাঁরা পাঁচ বছর মেয়াদে দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু ভারত নীরবে একটা রেওয়াজ গড়ে তুলেছে যে, সিইসি হিসেবে জ্যেষ্ঠতমই নিয়োগ পাবেন। তাই ৩২৪ অনুচ্ছেদে ভারত আইন করেনি বলে যাঁরা বাংলাদেশে ১১৮ এ আইন না করার মধ্যে দোষ দেখেন না,
তাঁরা বাস্তবে ওই সত্য চাপা দেন। ১৯৯০ সালে গোস্বামী কমিটি সিইসি নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে ভারতের প্রধান বিচারপতি ও লোকসভায় বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে পরামর্শ করার বিধান আনতে সুপারিশ করেছিল। ১৯৯০ সালের ৩০ মে রাজ্যসভায় ১৭তম সংশোধন বিলে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে, সিইসি নিয়োগে রাষ্ট্রপতি, রাজ্যসভার চেয়ারম্যান, লোকসভার স্পিকার, লোকসভার বিরোধী দলের নেতার (অথবা বৃহত্তম দলের নেতা) সঙ্গে আলোচনা করবেন। কিন্তু সরকার ১৯৯৪ সালে বিলটি প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর থেকে কোনো পরামর্শ গ্রহণের প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়াই প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে রাষ্ট্রপতিই সিইসি নিয়োগ দিয়ে চলছেন। কিন্তু তাতে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠেনি বলেই জানি। ভারতের আইন কমিশন ২০১৫ সালের এক রিপোর্টে কয়েকটি দেশের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নেয়। আমাদের এবারের কমিশনে কোন পেশা ও শ্রেণির মধ্য থেকে বাছাই করা হবে, তাও আমরা আঁচটুকু পর্যন্ত করতে পারলাম না। এমনকি ১৬ জন আমন্ত্রিতদের মধ্যে সংখ্যালঘুরা বাদ পড়ল। দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা যে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছিলেন, তাতে আমরা দেখি, পাঁচ সদস্যের কমিশনে একজন কর্মরত বিচারককে রাখা হয়েছে। সংসদের সুপারিশে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন। সংসদের একটি আন্তদলীয় কমিটি অন্তত আটজন প্রার্থী বাছাই করে। চার সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি তাদের সহায়তা দেয়। অনুসন্ধান কমিটিতে মানবাধিকার এবং জেন্ডার ইকুয়ালিটি বিষয়ক দুই কমিশনের দুজন প্রতিনিধি, পাবলিক প্রসিকিউটর এবং সাংবিধানিক আদালতের সভাপতি আছেন। ঘানার প্রেসিডেন্ট কাউন্সিল অব স্টেটের পরামর্শে সাত সদস্যের ইসি গঠন করে থাকেন। কানাডায় সংসদের প্রস্তাবক্রমে টানা ১০ বছর মেয়াদে (পুনঃ নবায়ন অযোগ্য) সিইসি নিয়োগ পান। পাকিস্তান তার জন্ম থেকে হাইকোর্টে কর্মরত বিচারপতিদের সিইসি ও ইসি করেছে। এরপর তারা দেখে এটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্যÿ ক্ষতিকর। তাই তারা গত বছর জুনে সংবিধানে ২২তম সংশোধনী আনে। এখন কর্মরত বিচারক ছাড়াও অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, সিভিল সার্ভেন্ট এবং টেকনোক্র্যাটরা হতে পারবেন। ফেডারেল বা প্রাদেশিক সরকারে অন্তত ২০ বছর চাকরি আর টেকনোক্র্যাটদের অন্তত ১৬ বছরের শিক্ষাজীবন, সেই সঙ্গে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য অর্জনের রেকর্ড থাকার সাধারণ শর্ত সংবিধানে লিখে নিয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার মধ্যে যখন কারও নামের বিষয়ে সমঝোতা হবে না,
তখন তাঁরা পৃথক তালিকা একটি সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠাবেন। তারাই তখন একটি নাম নিশ্চিত করবে। ভারতের কথায় ফিরি। তাদের আইন কমিশন ২০১৫ সালে নির্বাচন সংস্কার-বিষয়ক এক দীর্ঘ প্রতিবেদন (আমাদের এমন নজির নেই) তৈরি করেছে। তারা রাষ্ট্রপতির কাছে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশনের জন্য নাম প্রেরণে তিন সদস্যের একটি কলিজিয়াম বা বাছাই কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছে। এতে প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা এবং ভারতের প্রধান বিচারপতি থাকবেন। ভারতের আইন কমিশন মনে করে, ক্ষমতাসীন সরকারের একজন প্রতিনিধি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে বাছাই কমিটিতে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জন্যও সেটা বাস্তবতা মনে করি। তবে তারা কিন্তু সিইসি নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীকে খুশিমতো চলতে দেয়নি। বলেছে, সিইসির পদ শূন্য হলে দুই নির্বাচন কমিশনারের মধ্যে যিনি জ্যেষ্ঠতম তিনিই সিইসি হবেন। ৬৫ বছরে পৌঁছা বা পাঁচ বছরের মেয়াদ পুরো হওয়া, যেটা আগে হবে, সেই মেয়াদে কেউ সিইসি থাকবেন। তবে ভারতের আইন কমিশন বলেছে, যদি তিন সদস্যের বাছাই কমিটি কোনো জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনারকে তাদের বিবেচনায় সিইসি হতে অযোগ্য মনে করে, তাহলে তার লিখিত কারণ ব্যাখ্যা করে বিকল্প নাম প্রস্তাব করবে। ভারতের বর্তমান সিইসি নাসিম জায়দি ২০১৫ সালের ৩১ মে পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ‘বিচারক নিয়োগের মতোই সিইসি নিয়োগে একটি কলিজিয়াম’ পদ্ধতি চান। তাঁর এই মন্তব্য জেনে আমরা প্রীত হই।
কারণ, ভারতে বিচারক বাছাইয়ে কলিজিয়াম আছে। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে নেই। জায়দি তাই এখানে কলিজিয়াম চাইছেন। এই একই যুক্তিতে আমরা বলি, ২০১৭ সালে ইসি গঠনে যে কলিজিয়াম (অনুসন্ধান কমিটি) আমরা পেলাম, এটাই আইনে পরিণত হোক, আর একইভাবে তা বিচারপতিসহ অন্যান্য সাংবিধানিক প্রার্থী বাছাইয়েও কাজে লাগুক। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই ভারতের প্রধান বিচারপতি এইচ এল দাত্তুর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ সরকারকে একটি নোটিশ দিয়েছেন। তাঁদের যুক্তি: কেন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে নির্বাহী বিভাগের ‘এক্সক্লুসিভ’ ভূমিকার অবসান ঘটিয়ে একটি স্বচ্ছ ব্যবস্থা চালু করা হবে না? এবং এ জন্য প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার সমন্বয়ে কেন একটি উচ্চপর্যায়ের বাছাই কমিটি গঠন উপযুক্ত মনে করা হবে না। শক্তিশালী ইসি গঠন লগ্নে আমরা মনে রাখব, এ রকম একটি নোটিশ আমাদের দেশে নির্মোহভাবে দেখতে আমরা পারি নাকি পারি না। দলীয় সরকারের অধীনে ভারতের যে স্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থা, তার প্রধান ঢাল হলো দেশটির সুপ্রিম কোর্ট।
(দি হিন্দু, ১৩ জুলাই, ২০১৫) এবার অনুসন্ধান কমিটি যেভাবে কাজ করল, সেটা অন্যান্য সাংবিধানিক পদধারীদের বাছাইয়ে একটা মডেল হোক। তারা যা করল, তা এখনই একটি আইনে এবং পরে তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্য স্থির হোক। রাষ্ট্রপতি ‘স্বীয় বিবেচনায়’ নিয়োগ দেবেন, কিন্তু অপসারণ? সরকার বলতে পারে, সেটাও রাষ্ট্রপতি স্বীয় বিবেচনায় করবেন। বিশিষ্ট আইনবিদ এম এ মতিন (আপিল বিভাগের সাবেক বিচারক) আমাকে বলেন, হাইকোর্টে ১৬তম সংশোধনী বাতিলের কারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যকর রয়েছে। তারাই সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনারদের আচরণ প্রয়োজনে তদন্ত করবে। জ্যেষ্ঠতা মানা হলে ২০১৯ সালের নির্বাচনকালে বর্তমান অনুসন্ধান কমিটির সভাপতিই প্রধান বিচারপতি হতে পারেন। সেই হিসাবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সভাপতি তাঁরই হওয়ার কথা। অবশ্য হাইকোর্টের ওই রায় আপিলে পাল্টে গেলে ভিন্ন কথা।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.