শাটল ডিপ্লোমেসির কার্যকারিতা কি ফুরল?

পূর্বসূরি হিলারি ক্লিনটনের রেকর্ড ভাঙতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির হাতে সময় আছে এখনও চার মাস। হিলারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে সফর করেছিলেন ১১২টি দেশ। এ ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে কেরি। তবে দেশ না ধরে মাইলকে সূচক হিসেবে ব্যবহার করা হলে হিলারির চেয়ে বিদেশ বেশিই সফর করেছেন তিনি। দ্রুততাকে মান হিসেবে ধরলেও মনে হয় জয় হবে তারই। হবেই না বা কেন? গত সপ্তাহের শুরুতে কেরি ছিলেন জেনেভায়; আইএসের জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিতে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে একটি চুক্তির বিস্তারিত শর্ত চূড়ান্তকরণের লক্ষ্যে। তারপর ঝটিকা সফরে এলেন বাংলাদেশ। সেখানে থেকে গেলেন ভারত। খেয়াল করার মতো বিষয়, ক্ষমতাসীন প্রশাসনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও কিন্তু বিদেশ সফর করেছেন তুলনামূলকভাবে অন্যান্য মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি। ইসরাইল ও তুরস্কের মাঝে সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠায় ইদানীং বেশ ছোটাছুটি করতে হচ্ছে তাকে। উভয় ঘটনা থেকে সহজেই অনুমেয়, ওবামা প্রশাসনের আচরণ অধিক বিশ্বমুখী এবং তারা জোর দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সফট পাওয়ার’ বৃদ্ধির ওপর; আর সেজন্যই হিলারি ক্লিনটন, জন কেরি ও জো বাইডেনদের শাটল ডিপ্লোমেসি। প্রশ্ন হল, একবিংশ শতাব্দীর এ প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের যুগে ব্যয়বহুল শাটল ডিপ্লোমেসির মাধ্যমে কী অর্জন করল যুক্তরাষ্ট্র? তা থেকে বোঝা যাবে শাটল ডিপ্লোমেসির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। সেক্ষেত্রে প্রথমে বলা দরকার,
বিশেষত গত বছর শাটল ডিপ্লোমেসি না চালালে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর বহুপক্ষীয় চুক্তি সম্পন্ন হওয়া কঠিন ছিল। একই সঙ্গে এও বলতে হবে, প্রধানত প্রযুক্তির কারণে চলতি শতাব্দীতে এসে খানিকটা কার্যকারিতা হারিয়েছে শাটল ডিপ্লোমেসি। লক্ষণীয়, কূটনীতির এ পরিভাষাটির উদ্ভব ও বিকাশ ১৯৭০-র দশকে; সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের হাত ধরে। তিনি এর প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন ইসরাইল, মিসর ও সিরিয়ার মাঝে। কার্যত শাটল ডিপ্লোমেসির কল্যাণেই ফিলিস্তিনিদের শান্তির রূপকার হয়ে ওঠে আমেরিকা। সাফল্য ছিল বলেই ওই ধারার কূটনীতি অব্যাহত রাখা হয় প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলেও। ২০১১ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের দায়িত্ব হিলারি ক্লিনটন গ্রহণের আগে শাটল ডিপ্লোমেসিই চালিয়েছেন সাবেক সিনেটর জর্জ মিশেলের মতো কূটনীতিকরা। বরং ২০১৩ সালে জন কেরি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর কাজটি সম্পন্ন হয়েছে বিক্ষিপ্তভাবে। তার কারণ, এ সময়ে এসে অনুভূত হয়, উচ্চ তথ্যপ্রযুক্তির পরিবেশে শাটল ডিপ্লোমেসি আসলে কূটনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষার এক ধরনের কবরস্থান। কেননা দেখা যাচ্ছে, কোনো চুক্তিকেই তার বাস্তবায়নের পথে বেশিদূর এগিয়ে নেয়া যায় না শাটল ডিপ্লোমেসির মাধ্যমে। ফলে হাতে যত সময়ই থাকুক, কেরির পক্ষে হিলারির রেকর্ড ভাঙা কঠিন বৈকি।
এখন বরং হাতে যে ক’দিন বাকি রয়েছে জন কেরিকে ব্যস্ত থাকতে হবে সিরিয়া নিয়ে। তার মনোযোগ, সময় ও শক্তির কেন্দ্রবিন্দু হবে এটি। দেশটির সংকট কিন্তু গভীরতর হচ্ছে ক্রমে। তা ছড়িয়ে পড়তে পারে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অংশে। এরই মধ্যে কোনো কোনো বিশ্লেষক সিরিয়া ইস্যুকে অভিহিত করেছেন একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বিপর্যয় হিসেবে। আর এর সমাধান হিসেবে প্রয়োগ হয়েছে শাটল ডিপ্লোমেসির। বৈঠক জেনেভায় চলতে থাকুক সমস্যা নেই। তবে সিরিয়ায় মানুষ হত্যা অব্যাহত থাকলে কিন্তু শাটল ডিপ্লোমেসির কার্যকারিতা নিয়েই সংশয় দেখা দিতে পারে জনমনে। সিরিয়া ইস্যুর গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছেন জাতিসংঘের তিন তিনজন বিশেষ দূত- কফি আনান, লাখদার ব্রাহিমি ও বর্তমানে স্তাফান দো মিস্তুরা। তাদের উদ্যোগে ঘাটতি ছিল না। তবে সেগুলো শেষ পর্যন্ত আটকা পড়ে কানাগলিতে। সিরিয়ায় আন্তর্জাতিক কূটনীতি কেমন বিপাকে পড়েছে তা বর্ণনার জন্য এ ঘটনাই যথেষ্ট। সম্প্রতি জাতিসংঘ মানবাধিকার টাস্কফোর্স ভেঙে দিয়েছেন, নাকি ভেঙে দিতে বাধ্য হয়েছেন দো মিস্তুরা? বেশকিছু দিন ধরে কোনোভাবেই অবরুদ্ধ নগরীগুলোয় ত্রাণবহর পাঠাতে পারছিলেন না তিনি।
দৃশ্যত সিরিয়ায় শুরু হয়েছে নতুন স্নায়ুযুদ্ধ। এর একদিকে দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পক্ষে রাশিয়া ও ইরান এবং অন্যদিকে সিংহভাগ মধ্যপ্রাচ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলো। কেউ কেউ বলছেন, এ সংকট নিরসনে পশ্চিমাদের কূটনৈতিক উদ্যোগে কিছু ফাঁকফোকর ছিল। রাশিয়া ও ইরান সেই শূন্যস্থান বিপুল সামরিক সহায়তা দিয়ে পূরণ করে টিকিয়ে রেখেছে বাশারের ক্ষমতা। সিরিয়ায় কূটনৈতিক অচলাবস্থার এমন ঘাটতি সৃষ্টির মূল দুটি- একটি নতুন ও অপরটি পুরনো। নতুন দুর্বলতাটি হল, যেখানে ক্রমবর্ধমান হারে জঙ্গিরা আশ্রয় নিচ্ছে সিরিয়ায়, তদুপরি যে অঞ্চলের নিয়তির প্রধান নির্ধারক বর্তমানে জঙ্গিবাদ, সেখানে উৎসের উত্তাপ থেকে দূরবর্তী শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হোটেলে বসে শাটল ডিপ্লোমেসির মাধ্যমে সঠিক সমাধান আনা কঠিন। আর পুরনো দুর্বলতা হচ্ছে, জাতিসংঘের কূটনীতির নিজস্ব রীতি তথা ঐতিহ্য। ১৯৪৮ সালের পর থেকে জাতিসংঘ যে ক’জন বিশেষ দূত নিযুক্ত করেছে তাদের কারও বয়সই ৬৪ বছরের কম ছিল না। ব্রাহিমির ৮০, দো মিস্তুরার ৭০, আনানের ৭৮। অবশ্যই শান্তি আনয়নের কূটনীতিতে বয়স্ক, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পাঠানোর একটা ভালো যুক্তি আছে, তারা সর্বজন শ্রদ্ধেয়। তবে এর দুর্বলতা স্পষ্ট। সমস্যা হল, এ ধরনের পরিস্থিতিতে অপেক্ষাকৃত ‘তরুণ’ কূটনীতিকদের পাঠিয়ে বিশেষ লাভ হবে বলে মনে হয় না।
কারণ সিরিয়ার জঙ্গিদের উদ্দেশ্য হল সহিংসতা ও নৈরাজ্যের মধ্য দিয়ে আপন স্বার্থ হাসিল। তাদের বিপক্ষে ‘তরুণ’ কূটনীতিকরা দরকষাকষিতে তেমন সুবিধা করতে পারবেন না বলেই ধারণা অধিকাংশ বিশ্লেষকের। ফলে আগামীতে যদি আমরা জন কেরির মতো শাটল ডিপ্লোমেসিতে অভ্যস্ত আরেকজন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাও পাই, তবু ফুরোবে না শাটল ডিপ্লোমেসির চাহিদা। উপরন্তু আমার মনে হয়, বৈশ্বিক সমস্যাগুলো নিরসনে শাটল ডিপ্লোমেসির ওপর অধিক জোর দিতে হতে পারে জাতিসংঘের পরবর্তী মহাসচিবকে। নিয়তির পরিহাস, তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে মুখোমুখি শাটল ডিপ্লোমেসির প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে না গিয়ে কিছু ক্ষেত্রে তা বেড়েছে। এ ঘটনা কীভাবে ঘটল, তা সম্প্রতি ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে জানতে চেয়েছিল দ্য আটলান্টিক ম্যাগাজিন। রসিকতার সঙ্গে উত্তর দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, প্রতিপক্ষ কোন ব্যান্ডউইডথের ইন্টারনেট ব্যবহার করে, সেটা দেখার জন্যই আমরা যাই। অবশ্যই শাটল ডিপ্লোমেসি কূটনীতির ‘সর্বরোগ সংহারক মহৌষধ’ নয়। কিন্তু এর উপকারিতা ব্যয়ের (বিমান-হোটেল ভাড়া ইত্যাদি) চেয়ে বেশি বলে প্রতীয়মান। আমার কথা যদি মনে না ধরে, শুধু একবার তাকান ইয়েমেনের দিকে। দেশটি কি বিপুল জানমালের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রেহাই পেত না সৌদি আরব, ইয়েমেন ও ইরানের মাঝে শাটল ডিপ্লোমেসি থাকলে?
গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর : জায়েদ ইবনে আবুল ফজল
স্যার সাইমন জেনকিনস : লন্ডনের দ্য টাইমসের সাবেক সম্পাদক

No comments

Powered by Blogger.