জেলা পরিষদ নির্বাচন পদ্ধতি বনাম সংবিধান

সরকার খুব দ্রুতই জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে মনস্থির করেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মহোদয় ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন করবেন এমন ঘোষণা দিয়েছেন প্রকাশ্যে। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের প্রশাসনিক সংস্কারের দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৮৮ সালে জেলা পরিষদ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট জেলার একজন এমপিকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে স্থানীয় সরকারের এ ইউনিটটিকে কিছুদিন অল্প বিস্তর সচলও রাখা হয়েছিল। এরশাদ-পরবর্তী খালেদা জিয়ার সরকার সেদিকে একবারও তাকায়নি। ১৯৯৬-এর আওয়ামী লীগ সরকার ২০০০ সালে শরিক বন্ধু এরশাদের জেলা পরিষদ আইন বাতিল করে একই বছর নতুন আইন প্রণয়ন করে। পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সেটি কার্যকর করেনি। মহাজোট সরকার ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পার্বত্য তিন জেলা বাদে সমগ্র দেশের ৬১টি জেলায় নিজেদের লোকদের জেলা পরিষদ প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়। সেই অনির্বাচিত দলীয় প্রতিনিধি দিয়ে এখনও চলছে জেলা পরিষদ। জেলা পরিষদ হচ্ছে আমাদের স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ স্তর (Top layer)। আমাদের সাংবিধানিক চেতনা গণতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক চেতনায় ছেদ পড়ুক এমন কিছু আমাদের সংবিধান অনুমোদন করে না।
বিদ্যমান জেলা পরিষদ আইনে চেয়ারম্যান ও সদস্য নির্বাচনের যে পদ্ধতি নিহিত রয়েছে, তেমন পরোক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা কী সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, না সাংঘর্ষিক এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই মূলত আমার আজকের এ লেখার অবতারণা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বর্ণিত রয়েছে, 'The republic shall be a democracy in which fundamental human rights and freedom and respect for the dignity and worth of the human person shall be guaranteed and in which effective participation by the people through their elected representatives in administration at all levels be ensured.' ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক, মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ এ অনুচ্ছেদটি সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে সন্নিবেশিত আছে। এ অনুচ্ছেদটির বিশ্লেষণ করলে আমাদের যে উপলব্ধি হয়, তাতে আমরা মনে করি জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের অর্থ জনগণ প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবে।
স্থানীয় সরকারের অন্য দুটি স্তরেও জনগণের সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধি রয়েছে। এ স্তরে অর্থাৎ জেলা পরিষদে জনগণের সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধির বিকল্প হিসেবে অন্য স্থানীয় সরকারগুলোর প্রতিনিধিদের নির্বাচকমণ্ডলী মনোনীত করে স্থানীয় সরকারের এ গুরুত্বপূর্ণ স্তরে পরোক্ষভাবে প্রতিনিধি মনোনীত করলে তা একদিকে সংবিধানে লিখিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি থেকে বিচ্যুতি ঘটবে, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য থেকে রাষ্ট্র দূরে সরে যাওয়ার একটি পথও প্রশস্ত হবে, যা সংবিধান পরিপন্থী এবং জনআকাক্সক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিদ্যমান জেলা পরিষদ আইনের ১৭ ধারায় জেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচকমণ্ডলীর যে সংজ্ঞা নির্দিষ্ট করা হয়েছে তা এমন : ‘প্রত্যেক জেলার অন্তর্ভুক্ত সিটি কর্পোরেশন যদি থাকে এর মেয়র ও কমিশনাররা, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান (উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যানদেরও অধ্যাদেশের মাধ্যমে ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে), পৌরসভার চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য সমন্বয়ে উক্ত জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হইবে।’ এ ধারার বক্তব্য থেকে সন্দেহ জাগে যে, জনগণের সরাসরি ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার খর্ব করে অন্যের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে আইন, তা সংবিধানসম্মত কিনা। স্থানীয় সরকারবিষয়ক সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের প্রয়োগ করে সংসদ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের সরাসরি ভোটাধিকার বিলোপ করতে পারে কিনা। ৫৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে। আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্ব^য়ে গঠিত স্থানীয় সরকার বলতে সরাসরি বা প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার সংকুচিত করে তাদের শাসনের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন বোঝায় না।
জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ করে সরকার স্থানীয় সরকারের এ ইউনিটটি পরিচালনা করে আসছে, সরকার সেটা করতেই পারে, সরকারের সে রকম ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব রয়েছে; কিন্তু যখন জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে প্রশাসনের কোনো স্তর বা ইউনিট পরিচালনার প্রশ্ন আসবে তখন সরকার সংবিধানে লিখিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতির বাইরে যেতে পারে না। তবুও আমরা দেখছি সরকার সেদিকেই হাঁটছে। সরকারের এ সংবিধানপরিপন্থী হাঁটার উত্তর পেতে খুব বেশি দূর যেতে হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ে এর উত্তর লেখা আছে খুব সুন্দর ও সাবলীলভাবে। জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি অনুষ্ঠিত প্রহসনের নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা আনীত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ে সর্বোচ্চ আদালত ৪৪ দফায় যেসব নির্দেশনা প্রদান করেছেন, সেগুলোর মধ্য থেকে দুটি নির্দেশনা এখানে উল্লেখ করতে চাই। ৪৪ দফার ৫নং নির্দেশনায় সংশ্লিষ্ট সবার জন্য একটি সতর্কবার্তা সব সময়ের জন্য সব মহলের জন্য রয়েছে। ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো ধরনের ছেদ (Interruption) বাংলাদেশের সংবিধান অনুমোদন করে না।’ এ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বলতে শুধু জনগণের সরাসরি ভোটে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচন বোঝায় না। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ কেন্দ্রীয় সরকার, স্থানীয় সরকারসহ সব সরকারের প্রতিনিধি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত করার ইচ্ছাটাই ব্যক্ত করছে। ৪৪ দফার ৩নং দফার নির্দেশনা হচ্ছে, ‘সংবিধান বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন। ইহা বাংলাদেশের সব প্রতিষ্ঠান ও পদ সৃষ্টি করিয়াছে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ও দায়িত্ব অর্পণ করিয়াছে’। ১১ অনুচ্ছেদ রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি। এটা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিয়েছে, তবে পরোক্ষভাবে নয়।
জয়নাল আবদিন : আইনজীবী

No comments

Powered by Blogger.