যুক্তরাষ্ট্রের ব্যতিক্রমী নির্বাচন এটি

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব কাঠামোতে একক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। অনেকের মতে, যুক্তরাষ্ট্র এখনও যে কোনো রাষ্ট্রের তুলনায় বৈশ্বিক প্রভাব ও প্রতিপত্তিতে এগিয়ে আছে, যদিও তার রাজনৈতিক শক্তি ও অর্থনৈতিক সামর্থ্যে অনেকটাই ভাটা পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, যিনি একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান এবং সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক- বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত। এসব দিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বরাবরই একটি আলোচিত ঘটনা যার প্রভাব বিশ্বজুড়েই দৃশ্যমান। গোটা বিশ্বের চোখ এখন ৮ নভেম্বর ২০১৬-এর দিকে, সেদিন যুক্তরাষ্ট্রবাসী আগামী ৪ বছরের জন্য বেছে নেবে তাদের ৪৫তম প্রেসিডেন্টকে। ২০১৬-এর নির্বাচনকে বেশকিছু কারণে এক ঐতিহাসিক নির্বাচন হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়, যা এই লেখার প্রথম অংশে আমি তুলে ধরব। লেখার দ্বিতীয় অংশে আমি আলোকপাত করেছি এই নির্বাচন ঘিরে ভবিষ্যৎ বিশ্বকে নিয়ে জল্পনা-কল্পনার প্রচলিত পুরাকথা (myth)। শেষ অংশটিতে মূলত বাস্তবতার নিরিখে আমি আলোচনা করেছি এই নির্বাচনের ফলাফল বিশ্বকে প্রকৃত অর্থে কী পরিণামের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
দুই প্রেসিডেন্ট প্রদপ্রার্থী রিপাবলিকান দলের ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ডেমোক্রেট দলের হিলারি ক্লিনটনের কারণে এই নির্বাচনকে এক ঐতিহাসিক নির্বাচন হিসেবে গণ্য করা যায়। ১৯৩৩ সাল থেকে অদ্যাবধি যারাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তারা হয় ছিলেন সাবেক গভর্নর, সিনেটের কিংবা উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা। ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হলে তিনি হবেন এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম, যার এ ধরনের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। শুধু তাই নয়, তিনি হবেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রবীণতম প্রেসিডেন্ট। অপরদিকে হিলারি ক্লিনটন নির্বাচিত হলে তিনি হবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী এবং দ্বিতীয় প্রবীণতম প্রেসিডেন্ট, যিনি ইতিমধ্যে প্রথম নারী প্রার্থী হিসেবে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করে ইতিহাস গড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী ট্রাম্পের জন্য এই নির্বাচনে জয়ী হয়ে আরেকটি ইতিহাস গড়ার হাতছানি রয়েছে। ৪.৫ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা) সমমূল্যের সম্পদের মালিক ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ পর্যন্ত নির্বাচনী ব্যয় প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার যার তিন-চতুর্থাংশই এসেছে তার নিজস্ব অর্থ থেকে। গত চারটি নির্বাচনের প্রার্থীদের মোট ব্যয়ের সঙ্গে তুলনায় এটি সর্বনিু। আর এ পর্যন্ত হিলারির নির্বাচনী ব্যয়ের তুলনায় এটি কেবল এক-চতুর্থাংশের কিছু বেশি। তাই নির্বাচিত হলে ব্যবসায়ী হিসেবে ট্রাম্পের দক্ষতার আরেকটি নজির তৈরি হবে। কে হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট তা নিয়ে বিভিন্ন জনমত জরিপে যেমন- গ্যালাপ ও নিউইয়র্ক টাইম নির্বাচনী জরিপে হিলারিকে এখনও কিছুটা এগিয়ে থাকতে দেখা গেলেও ট্রাম্পের সঙ্গে তার জনপ্রিয়তার ব্যবধান দিন দিনই কমছে। তা ছাড়া কে প্রেসিডেন্ট হলে বিশ্বরাজনীতি কোন দিকে মোড় নেবে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, হিলারী নির্বাচিত হলে ওবামার গৃহীত অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই হিলারির নির্বাচিত হওয়াকে এক ধরনের ওবামানীতির স্থিতাবস্থা (status quo) হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
অপরদিকে ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়াকে অনেকেই আখ্যায়িত করছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির এক কালো অধ্যায় হিসেবে। এই প্রেক্ষাপটে প্রচলিত পুরাকথার একটি হল- ট্রাম্পের অভিবাসী বিদ্বেষীনীতি, যার আওতায় রয়েছে অভিবাসী আইন সংশোধন থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমানায় দেয়াল তৈরি করার মতো পরিকল্পনা। তাই অনেকের ধারণা, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে অভিবাসী প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বহির্বিশ্বের টানাপোড়েন শুরু হবে। বিশেষ করে ট্রাম্পের বিভিন্ন বক্তব্যে মুসলিম বিদ্বেষী যেসব উপকরণ লক্ষ করা যায়, তার ফলে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক হুমকির মুখে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কেও বড় পরিবর্তনের ব্যাপারে ট্রাম্প বদ্ধপরিকর। এছাড়া অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপারে ওবামার গৃহীত পদক্ষেপের পরিবর্তন, প্রচলিত আগ্নেয়াস্ত্র নীতিমালার সংরক্ষণ এবং কর সংশোধন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো পরিকল্পনাও আছে ট্রাম্পের ওয়েবসাইটে ঘোষিত তার মূল সাতটি অবস্থানের মধ্যে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ট্রাম্প নির্বাচিত হলে ওবামার নির্বাহী ক্ষমতাবলে গৃহীত পদক্ষেপগুলো, যেমন- জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার লক্ষ্যে পরিচ্ছন্ন শক্তি উৎপাদনের পরিকল্পনা, এমনকি প্যারিস চুক্তিও হুমকির সম্মুখীন হবে। ট্রাম্পবিরোধীদের মতে এটি প্রায় নিশ্চিত যে, তিনি নির্বাচিত হলে ইরান ও কিউবার মতো দেশের সঙ্গে অগ্রসরমান সম্পর্কের ক্রম অবনতি হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে সামরিক অভিযানে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে, যা হবে ভবিষ্যৎ অর্থনীতির জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ।
এবারের বাস্তবতার নিরিখে দেখা যাক, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল আমাদের কোন পথে নিয়ে যাবে। প্রথমে বলতে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রেসিডেন্টকে এমন কিছু ক্ষমতা প্রদান করেছে যার ভিত্তিতে যে কোনো বিলকে আইনে পরিণত করা, পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে যুদ্ধ ঘোষণা, আইনের প্রয়োগ, বিচারপতি মনোনয়ন, রাষ্ট্রদূত এবং মন্ত্রিসভার সদস্য নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারেন। তবে এটা মনে রাখতে হবে, এসব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভায় সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসেরও নিয়ন্ত্রণ এবং সমন্বয় সাধনের সুযোগ থাকে। তাই বলা যায়, আপাতদৃষ্টিতে প্রেসিডেন্টকে যতটা স্বাধীন মনে হয় বাস্তবে তিনি ততটা নন। তবে বর্তমানে উভয় পক্ষে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় ট্রাম্প নির্বাচিত হলে তার পক্ষে অনেক আইন সংশোধন বা নতুন আইন প্রণয়ন যতটা সহজ হবে হিলারির জন্য তা ততটা সহজ হবে না। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সিনেটর বা রিপ্রেজেন্টেটিভগণ সব সময় প্রেসিডেন্টের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে বাধ্য নন। তাদের নিজস্ব মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। উপরন্তু, সিনেটররা ৬ বছরের জন্য নির্বাচিত হওয়ায় তারা অনেক ক্ষেত্রেই নিজস্ব ব্যক্তিসত্তার বলে দলীয় সিদ্ধান্তের ঊর্ধ্বে থেকে মত দিয়ে থাকেন। পরিশেষে বলা যায়, ৮ নভেম্বরের সিনেট নির্বাচন যার মাধ্যমে এক-তৃতীয়াংশ সিনেটর আগামী ৬ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন এবং রিপ্রেজেন্টেটিভ নির্বাচন, যার মাধ্যমে মোট ৪৩৫ জন প্রতিনিধি আগামী ২ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন- অনেক গুরুত্ব বহন করে, যা বলে দেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচলিত পুরাকথার কতটুকু বাস্তবে রূপলাভ করবে।
শেখ সামস মোরসালিন : সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.