সংলাপকে কেন সরকার ভয় পায়? by সোহরাব হাসান

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সংলাপ কথাটি যতবার উচ্চারিত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ঝংকার তুলেছে সংঘাত। এবং প্রায়ই সেই সংঘাত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। বারবার রক্তাক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ। তাই ৫ জানুয়ারির সমাবেশে এক পক্ষের সংলাপ আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে অন্য পক্ষের নাকচ করে দেওয়ার ঘটনায় অবাক হইনি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটাই স্বাভাবিক। এখানে সংলাপ, নির্বাচন কিংবা গণতন্ত্র সবকিছুই পরিমাপ করা হয় দলীয় লাভ-ক্ষতির নিক্তিতে। দেশের মানুষের লাভ-ক্ষতি বিবেচনার সময় কোথায় তাদের? এখন নিক্তিটি আওয়ামী লীগের দিকে ভারী বলে তারা বিরোধী দলের সবকিছু অবলীলায় নাকচ করে দিচ্ছে। নিক্তিটি বিএনপি বা বিরোধী দলের দিকে ভারী হলে সংলাপের প্রস্তাব এবং তার প্রতিক্রিয়া নিঃসন্দেহে ভিন্ন হতো।
২০০১-২০০৬ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট যখন ক্ষমতায় তখন নির্বাচন কমিশন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট বহুবার সরকারের প্রতি আলোচনার প্রস্তাব দিলেও ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি ২০০৬ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের শেষ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল ও বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত বহুল আলোচিত বৈঠকটিও ব্যর্থ হয় তৎকালীন সরকারের একগুঁয়েমির কারণে। পরবর্তীকালে বিএনপির মহাসচিব স্বীকার করেছিলেন যে দলীয় প্রধান চাননি বলেই দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়নি। বিএনপি প্রধান সমঝোতা চাইলে কিংবা জোর করে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা না করলে হয়তো এক–এগারোসহ দেশের অনেক অঘটন, অনেক প্রাণহানি এড়ানো যেত। সেই সময় বিএনপি যতটা বলবান ছিল, আওয়ামী লীগ এখন নিজেকে তার চেয়ে অনেক বেশি বলবান মনে করছে বলেই বিরোধী দলের সংলাপ প্রস্তাবটি সরাসরি উপেক্ষা করছে।
আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেছেন, ‘দেশে এখন কোনো সংকট নেই। তাই বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসারও প্রয়োজন নেই।’ ক্ষমতার চশমায় চোখ ঢাকা থাকলে কোনো কিছুকেই সংকট বলে মনে হয় না। নির্বাচনের কথা বাদ দিলেও ২০১৫ সাল জুড়ে যে একের পর এক ব্লগার-লেখক-প্রকাশক হত্যার ঘটনা ঘটল, এ দেশে দায়িত্ব পালন করতে এসে দুজন বিদেশি নাগরিক খুন হলেন, তাজিয়া মিছিলে ও শিয়া মসজিদে হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা করা হলো, বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের মন্দির ও গির্জা আক্রান্ত হলো, এগুলো সংকট না হলে আওয়ামী লীগ নেতারা কাকে সংকট বলবেন? আসলে রোগের উপসর্গ আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নয়, রোগের উপসর্গ হলো ক্ষমতা। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে যখন সারা দেশে জঙ্গিবাদী হামলা চলছিল এবং তাদের হাতে বিচারক-পুলিশ-আইনজীবীসহ নিরীহ সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছিল, তখনো বিএনপি বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষাতেই কথা বলতেন। তৎকালীন সরকারের মন্ত্রীরা ‘দেশে জঙ্গি নেই, সব মিডিয়ার সৃষ্টি বলেও দায় এড়িয়েছেন, কেউ কেউ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জঙ্গিদের মদদও দিয়েছেন। এখন সময় পাল্টেছে। ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। তাই বিএনপি জঙ্গিবাদ রুখতে এবং সবার কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে সংলাপ চাইছে, আর আওয়ামী লীগ তুড়ি মেরে সেই প্রস্তাব উড়িয়ে দিচ্ছে। ‘জঙ্গিবাদের তোষণকারী বিএনপির’ নেতারা যখন জঙ্গিবাদ রুখতে সর্বদলীয় ঐক্যের আহ্বান জানান, তখন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণাকারী আওয়ামী লীগ নেতারা সেটি নাকচ করে দেন? তাঁরা যদি মনে করেন বিএনপিই জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, সেটি বন্ধ করতেও তো এ ধরনের প্রস্তাবকে লুফে নেওয়া উচিত, যদি সরকার সত্যি সত্যি দেশকে জঙ্গিমুক্ত করতে চায়।
আওয়ামী লীগের তরফে বলা হয়, বিএনপি রাজনীতিতে ভুল চাল দিয়ে, ভুল সঙ্গী বেছে নিয়ে হেরে গেছে। মানলাম। সেই সঙ্গে এ কথাও বলতে হবে যে বিএনপির হেরে যাওয়াই কিন্তু আওয়ামী লীগের বিজয় বলে ধরে নেওয়া যায় না। গণতন্ত্রে কতগুলো শাশ্বত বিষয় থাকে, যেগুলো কোনো দেশে, কোনো সরকারের আমলে পরিবর্তনের সুযোগ নেই। যেমন ভোটের মাধ্যমে পছন্দসই প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার সুযোগ। এখন দেখার বিষয় বিএনপিকে হারিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসা আওয়ামী লীগের আমলে সেই সুযোগ নিশ্চিত হয়েছে কিনা? জনগণ একটি ভালো নির্বাচন পেল কি না? তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা বলতেন, তাঁদের আমলে সাড়ে পাঁচ হাজার স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়েছে। কোথাও কারচুপি বা অনিয়ম হয়নি। তিন সিটি করপোরেশন এবং সর্বশেষ পৌর নির্বাচনের পর সেই কথাটি বলার সুযোগ আছে কি?
যদি পৌরসভা নির্বাচনটি বিএনপি সরকারের অধীনে হতো এবং সন্দ্বীপে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর ২০ হাজার ৬৯০ ভোটের বিপরীতে আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থীর ৪৬৪ ভোট পাওয়াকে তাঁরা কীভাবে নিতেন? সামরিক শাসনামলে স্বৈরশাসকেরা যে ধরনের নির্বাচন দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দিতেন, গণতান্ত্রিক আওয়ামী লীগের আমলে সেটি কেন হবে? ধরে নিলাম, বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ সন্দ্বীপে কিংবা সারা দেশে অনেক বেশি জনপ্রিয়। তাই বলে ৪৪ ভাগের এক ভাগ ভোটও পাবেন না বিএনপির প্রার্থী? তিন মাসের ধ্বংসাত্মক কর্মসূচির কারণে বিএনপির জনপ্রিয়তায় ধস নামলে গত এপ্রিলে অনুষ্ঠিত তিন সিটি নির্বাচনে মাঝ পথে সরে দাঁড়ানো বিএনপির প্রার্থীরা এত ভোট কীভাবে পেলেন?
অস্বীকার করা যাবে না যে গত বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ—বিএনপির এই তিন মাসের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড কিংবা নির্বাচনের আগে ও পরে তাদের নাশকতায় বহু মানুষ মারা গেছে, দেশের বহু ক্ষতি হয়েছে। বিএনপি নেতৃত্ব সেই ভুল বুঝতে পেরে যখন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে এল তখন আওয়ামী লীগের কি উচিত নয়, তাকে স্বাগত জানানো? কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাদের হাবভাব দেখে মনে হয় না তাঁরা বিএনপির কোনো কাজকে উদারভাবে দেখতে চান। বিএনপি আন্দোলন করে সরকারকে ফেলে দিতে না পারুক, হরতাল-অবরোধ ডেকে দেশকে অস্থিতিশীল করে রাখতে পারে। সেটি দেশ ও সরকার কারও জন্যই ভালো হবে না। নয় মাস ধরে বিএনপির জ্বালাও–পোড়াও না থাকলেও জনজীবনে স্বস্তি ফিরে এসেছে সে কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। গত বছরটিতে বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধে যেমন বহু মানুষ মারা গেছে, তেমনি বহু মানুষ ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, আইনের শাসন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা একসঙ্গে চলে না। রাজনৈতিক কৌশলে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেওয়া এবং সুষ্ঠু নির্বাচনও সমার্থক শব্দ নয়। বছর শেষে ধারাবাহিক জঙ্গি উৎপাতেরও কোনো কিনারা করতে না পারা সরকারের বড় ব্যর্থতা হিসেবেই চিহ্নিত থাকবে।
এ কথা ঠিক যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অনেকটা বেকায়দায় পড়েই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের কথা বলেছেন। একই সঙ্গে তিনি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, সদ্য সমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচন, তার আগে অনুষ্ঠিত তিন সিটি করপোরেশন এবং নির্বাচন কমিশন নিয়েও প্রশ্ন করেছেন। সেনাবাহিনী, সিভিল প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিয়েও তাঁর কড়া মন্তব্য ছিল। সেসব প্রশ্ন ও মন্তব্যের জবাব না দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা যেভাবে তাঁর সংলাপ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন, তাতে মনে হবে তিনি বোধ হয় তাঁর বক্তৃতায় ওই একটিই না-হক কথা বলেছেন। কিন্তু আমাদের বিবেচনায় ওই একটি কথাই হক বলেছেন। হতে পারে আওয়ামী লীগ তাঁর প্রস্তাবে সাড়া দেবে না জেনেই খালেদা জিয়া বারবার সংলাপ ও সহনশীলতার কথা বলছেন। এর মাধ্যমে দেশের মানুষকে ও বিদেশের বন্ধুদের বোঝাতে চাইছেন, বিএনপি শান্তির পক্ষে আর আওয়ামী লীগ অশান্তি করছে। আওয়ামী লীগ নেতারা যেভাবে খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে ক্ষিপ্র প্রতিক্রিয়া দেখালেন তাতে মনে হয়, সংলাপে বসতে রাজি হলেই আওয়ামী লীগ বোধ হয় রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হয়ে যাবে। এই মানসিকতা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক নয়।
আর সংকট থাকলেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে সংলাপ হয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান সে কথা বলে না। সংকট ও সম্ভাবনা দুটো নিয়েই রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আলোচনা হতে পারে, হওয়া উচিত। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে দেশে কোনো সংকট দেখেনি বলেই তারা মারাত্মক গাড্ডায় পড়েছিল, যা থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি। আজ আওয়ামী লীগও যদি অব্যাহত জঙ্গি হানা সত্ত্বেও দেশে কোনো সংকট না দেখে, তাহলেও তাদেরও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। সাত বছর ধরে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানোর পর জঙ্গিদের উৎপাত বেড়ে যাওয়া প্রমাণ করে যে হয় তারা সমস্যাটির গভীরতা বুঝতে পারেনি অথবা সেটি মোকাবিলা করার সক্ষমতা তাদের নেই। জঙ্গিবাদ নিছক আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা নয়, সেটি শক্তিধর আমেরিকা বুঝলেও বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনেরা বুঝতে পারছেন না। নির্বাচন তাঁদের কাছে অনেক দূরের বাদ্য। অতএব, সে নিয়ে এখন তাঁরা মাথা ঘামাতে চাইছেন না। ভালো কথা। কিন্তু জঙ্গিবাদের ছুরি যে বাংলাদেশকে রক্তাক্ত করে চলেছে, সেটি দেখে না দেখার ভান কি বোকামি নয়? কথার তূণে একে অপরকে ঘায়েল না করে জঙ্গিবাদের ছোবল ঠেকান। অন্তত একটি বিষয়ে আপনারা একমত হন।
সরকার মুখে স্বীকার না করলেও জঙ্গিবাদ জনগণের মধ্যেই কেবল ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেনি, সরকারের মনেও ভয় পাইয়ে দিয়েছে। সেই ভয়কে জয় করার উপায় কী? সংলাপ, সংলাপ এবং সংলাপ। সেটি কেবল সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে নয়, জনগণের সঙ্গে সরকারের সফল ও অর্থবহ সংলাপ হওয়া চাই। পৌর নির্বাচন সেটি দিতে পারেনি। আগামী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পারবে কি?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.