‘জনগণই আমার জীবন’ by ড. আবু সাইয়িদ

২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সামরিক বাহিনী তাকে বন্দি করে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। ইয়াহিয়া খান ২৬ মার্চ এক ভাষণে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনেন। বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালে ১৯ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হয়। আদালতের কার্যক্রমের বিবরণী তাকে দেয়া হলে তিনি এর ওপর লেখেন, ‘সব মিথ্যা’। আরেকবার লেখেন, ‘কাকে বলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা? আমরা যে নির্যাতিত এটি মনে করাটা কি রাষ্ট্রদ্রোহিতা?’ বঞ্চিত-নির্যাতিত মানুষের অধিকার কেউ স্তব্ধ করতে পারে না। অন্ধকার কারাগারে এমনি ছিল তার আত্মপ্রত্যয়। সামরিক ট্রাইব্যুনালে প্রিসাইডিং বিচারপতি ছিলেন একজন ব্রিগেডিয়ার। কোর্টের অন্যান্য সদস্যের মধ্যে দুজন ছিলেন সামরিক অফিসার, একজন নেভাল অফিসার এবং পাঞ্জাব থেকে আগত একজন জেলা জজ। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ১২টি অভিযোগ উত্থাপন করা হয়, যার মধ্যে ছয়টি ছিল মৃত্যুদণ্ডের। সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করা। ২৬ মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটে চলেছে সেসবের কিছুই জানতেন না বঙ্গবন্ধু। তবে তিনি অনুমান করেছেন ইয়াহিয়ার সৈন্যরা যদি পূর্ব পাকিস্তান দখলে নিয়ে আসতে পারে, আওয়ামী লীগ যদি আত্মসমর্পণ করে থাকে, তবে তাকে হত্যা করা হবে। জিম্মি হিসেবে যতক্ষণ পর্যন্ত তার কোনো কার্যকারিতা ইয়াহিয়া খানের কাছে থাকবে, তাকে ততক্ষণ বাঁচিয়ে রাখা হবে। তিনি বলতেন, জনগণই আমার জীবন। তারা এক থাকলে কেউ আমাকে মারতে পারবে না।
২. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তীব্রতর হতে থাকে। বিশ্বজনমত সংগঠিত হতে থাকে। ৪ ও ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের আলোচনায় নিক্সনের প্রস্তাব ছিল যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহার। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সরাসরি বলেন, বাংলাদেশ সংকট সমাধানের কেন্দ্রবিন্দু হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মিসেস গান্ধী স্পষ্টভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে জানিয়ে দেন বাংলাদেশের সংকটকে তিনি আর ঝুলিয়ে রাখতে চান না। পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে মিত্রবাহিনী একযোগে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে।
৩. ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ২০ ডিসেম্বর পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইয়াহিয়াকে সরে যেতে হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতা দখল করেন। কারাগার থেকে স্থানান্তরিত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভুট্টো দেখা করেন। পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানকে ন্যূনতম শিথিল শর্তে এক রাখার জন্য বারবার অনুরোধ করেন। কিন্তু মুজিব কোনো কথাই বললেন না। চুপ করে থেকে শুধু বললেন, ‘আমর জনগণই আমার প্রাণ। আমি মৃত্যুকে পরোয়া করি না। আমাকে হত্যা করলে আমার লাশটা বাংলার মাটিতে পাঠিয়ে দেবেন। তারা আমায় বড্ড ভালোবাসে। জনগণের কাছে না শুনে আমি কিছুই বলতে পারব না। জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে দেয়া একটি যৌথ ইশতেহার প্রত্যাখ্যান করলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বললেন, ‘আমি কি এখন দেশে যেতে পারি?’ ভুট্টো বললেন, ‘হ্যাঁ, যেতে পারেন। কিন্তু কীভাবে যাবেন? পাকিস্তানের পিআইএ ভারতের ওপর দিয়ে যায় না।’ শেখ মুজিব বললেন, ‘সেক্ষেত্রে আমি লন্ডন হয়ে যাব।’ ৮ জানুয়ারি শেখ মুজিব পিআইএ’র একটি বিশেষ বিমানে ওঠার আগে জুলফিকার আলী ভুট্টো তার দিকে ৫০ হাজার ডলার হাত খরচের জন্য দিতে চাইলে বঙ্গবন্ধু বলেন এটি চার্টার বিমানের জন্য আপনি রেখে দেন। এমনি ছিল তার আত্মমর্যাদা ও উন্নতশির। তিনি লন্ডনের উদ্দেশে অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা করেন।
অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ : ৭২ খসড়া সংবিধান প্রণেতা, গবেষক ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী

No comments

Powered by Blogger.