ভারত–বিরোধিতা বনাম দেশপ্রেম by আসিফ নজরুল

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ভারত–বিরোধিতা’র ইতিহাস বহু পুরোনো। বাংলাদেশের জন্মের আগে ভারত–বিরোধিতার রাজনীতিতে কোনো না কোনো সময় সক্রিয় ছিলেন অনেক বরেণ্য নেতা। স্বাধীনতার পর ফারাক্কা মার্চের নায়ক মাওলানা ভাসানী এবং কিছু মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের দলছুট একটি অংশের নেতৃত্বে গঠিত জাসদের রাজনীতির একটি বড় পরিচয় ছিল ভারত–বিরোধিতা। অনেকের মতে, এই ভারত–বিরোধিতা ছিল মূলত দেশের স্বার্থে, দেশের সম্পদ ও জনগণের স্বার্থ রক্ষার পক্ষে। তুলনায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু ধর্মাশ্রয়ী দলের ভারত-বিরোধিতা ছিল সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত-বিরোধিতার এই দুটো ধারা আগেও ছিল, এখনো আছে। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির উত্থানের একটি বড় কারণ ছিল জাতীয়তাবাদী ও জাতীয় স্বার্থের চেতনায় বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের সমালোচনা করা। তবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দলটির বাড়াবাড়ি ঘনিষ্ঠতা এবং সর্বশেষ ক্ষমতায় থাকাকালীন ভারতের অখণ্ডতা-বিরোধী কিছু অপতৎপরতার কারণে বিএনপির ‘ভারতবিরোধী’ রাজনীতি একসময় প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করে।
এ ধরনের বেপরোয়া ভারত-বিরোধিতার কঠিন মূল্যও দিতে হয় বিএনপিকে একসময়। জনগণের ব্যাপক সমর্থন থাকা সত্ত্বেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন রুখতে পারেনি তার একটি বড় কারণ হিসেবে দেখা হয় সেই নির্বাচনের পক্ষে ভারতের সক্রিয় সমর্থনকে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন এবং এর পক্ষে ভারতের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বহু মানুষের কাছে এই বার্তা দেয় যে জনগণের সম্মতি শুধু নয়, ভারতের সম্মতিও এ দেশে ক্ষমতায় আরোহেণর বড় একটি শর্ত।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক সফরে ভারত-বিরোধিতার ‘কলঙ্ক’ মোচনে তড়িঘড়ি করে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বিএনপি। অন্যদিকে ভারত সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতার কারণেই হয়তো দ্বিপক্ষীয় বিষয়াবলিতে সর্বোচ্চ উদারতা দেখাতে উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের আগে রাজনীতির এই চিত্রটি নিজ জনগণের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দর-কষাকষির ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে হ্রাস করে।
২...
এমন এক সময়ে বাংলাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসেন অতু্যজ্জ্বল এক ইমেজ নিয়ে। এই সফরের মাত্র কয়েক দিন আগে ভারতের পার্লামেন্টে স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুমোদিত হয়েছিল। এটির অনুমোদন নিয়ে দীর্ঘ অপেক্ষা ছিল বাংলাদেশের। কারণ, ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত এই চুক্তিটি বাংলাদেশ তখনই অনুসমর্থন করে। ২০১১ সালে একটি প্রটোকলে (সংযুক্ত চুক্তি) অনিষ্পন্ন সীমান্ত, ছিটমহল ও অপদখলীয় জমিসংক্রান্ত আরও কিছু বিষয়ের মীমাংসার পর ভারত তা অনুমোদন করে চুক্তি স্বাক্ষরের দীর্ঘ ৪১ বছর পরে। এই ঘটনাকে ঐতিহাসিক অর্জন আখ্যায়িত করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়।
বহু বিলম্বে অনুমোদিত হলেও স্থলসীমান্ত চুক্তির জন্য ভারত সরকারের প্রশংসা প্রাপ্য ছিল। মোদি সরকারকে অভিনন্দন জানানো তাই সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল বিএনপির। কিন্তু বড় দল হিসেবে বিএনপির উচিত ছিল মোদির সফরের আগে বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের যৌক্তিক অবস্থান কী হওয়া উচিত তা–ও জনগণের কাছে তুলে ধরা। কিন্তু স্থলসীমান্ত চুক্তির উচ্ছ্বাসে প্রভাবিত হয়েই হয়তো বিএনপি তা না করে হাস্যকরভাবে ঘোষণা দেয় যে তারা কখনোই ভারতবিরোধী ছিল না, ভবিষ্যতেও তা হবে না। ভারতবিরোধী লেবেল না লাগাতে হঠাৎ করেই অতিসতর্ক হয়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনার কথা বলতে বিরত থাকে। একমাত্র বাম মোর্চা এসব ইস্যুতে একটি অবস্থান কর্মসূচি দিলে পুলিশ তা পণ্ড করে দেয়।
মোদির বাংলাদেশ সফর শেষ হয় প্রবল উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনার মধ্যে। কোনো বিশদ আলোচনা এমনকি আভাস-ইঙ্গিত ছাড়াই তাঁর এই দুই দিনের ঝটিকা সফরে বহু চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।।
৩...
ভারত-বাংলাদেশ চুক্তিগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ এই নিবন্ধে সম্ভব নয়। তবে শুধু দুই দেশের যৌথ নদীর পানি ব্যবহার প্রশ্নে কিছু আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের অপ্রাপ্তির বিষয়টি আঁচ করা সম্ভব। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি যৌথ নদীর মধ্যে একমাত্র গঙ্গা নদীর পানি ব্যবহারে দুই দেশ চুক্তিতে উপনীত হতে পেরেছিল ১৯৯৬ সালে।
ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান ও নেপালের যৌথ নদীর বিষয়ে চুক্তি আরও অনেক ব্যাপক এবং দীর্ঘস্থায়ী। এই দুটো দেশের তুলনায় বাংলাদেশ নিম্ন অববাহিকার দেশ। চুক্তি ছাড়াই উচ্চ অববাহিকার দেশ ভারত একতরফাভাবে পানি ব্যবহার করতে থাকায় স্বাভাবিকভাবে এর অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের ওপর। পানি প্রাপ্তির পরিমাণে অনিশ্চয়তার কারণে এমনকি বাংলাদেশের পক্ষে বাস্তবভিত্তিক পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনাও অসম্ভব হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তাই যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বাংলাদেশ বারবার ন্যূনতম পানি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা চাইতে থাকে ভারতের কাছে।
তিস্তা নদী নিয়ে স্বাধীনতার পরপর আলোচনা শুরু হলেও ১৯৮৩ সালে প্রথম একটি সমঝোতা হয়। এই সমঝোতা অনুসারে তিস্তার পানির ৩৯ শতাংশ ভারত ও ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশের পাওয়ার কথা ছিল। বাকি ২৫ শতাংশের কতটুকু বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত তিস্তার গতিপথকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন এবং এটি কীভাবে ভাগাভাগি হবে তা নিয়ে পরে আরও আলোচনার কথা ছিল। এই আলোচনা কখনো আর সুসম্পন্ন হয়নি। বারবার বাংলাদেশকে ক্রমান্বয়ে আরও কম পানি নিতে রাজি হতে বলা হয়েছে, বারবার সমঝোতার শুধু আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। অন্য নদীর পানি দূরের কথা, এক তিস্তার ক্ষেত্রেও এই চুক্তি এখনো হয়নি, যদিও ইতিমধ্যে তিস্তার আরও উজানে একতরফাভাবে ভারত নির্মাণ করে চলেছে একের পর এক পানি ব্যবহার প্রকল্প।
মনমোহন সিং-হাসিনার আমলে তিস্তার পানি দেওয়া হবে এমন আশাবাদের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের বহু প্রত্যাশা পূরণ করে দেওয়া হয়। ভারতের পণ্য আর চাকরিজীবীদের জন্য প্রায় একতরফাভাবে খুলে দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশের দুয়ার। চরম ঝুঁকি নিয়ে শেখ হাসিনার সরকার ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশের মাটিতে গ্রেপ্তার ও দমন করার অসাধারণ বন্ধুত্বের নিদর্শন দেখিয়েছিল।
ভারতকে প্রায় সর্বস্ব দিয়ে তখন কী পেয়েছিল বাংলাদেশ? পুরোনো কিছু দায়দায়িত্ব কিয়দংশে পালন (তিনবিঘা করিডর) কিংবা তা পুনরায় পালনে রাজি (নেপালে রেল ট্রানজিট) হয়েছিল ভারত। আর বাংলাদেশ দিয়েছিল যা দেওয়ার ছিল তার প্রায় সবই। বাকি ছিল এক ট্রানজিট। বলা হয়েছিল সেটি নাকি দেওয়া হবে না তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি না হলে। তিস্তার পানি আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে আমাদের অধিকার। ট্রানজিট পাওয়া ভারতের অধিকার নয়, প্রত্যাশা। তবু তিস্তার পানির অধিকার না পেয়েই কখনো কখনো ভারতকে সীমিতভাবে সড়ক ও নৌ ট্রানজিট দেওয়া হয়। সেও বিনা মাশুল এবং রুলস অব বিজনেস লঙ্ঘন করে।
মোদির এবারের সফরে তাই বাংলাদেশের বহুল প্রতীক্ষিত ন্যায্য কিছু প্রত্যাশা পূরণ করা হলে দুই দেশের সম্পর্ক ভারসাম্যমূলক হতো। কিন্তু এবারও তা হয়নি। তিস্তার পানি বণ্টনের কোনো সুরাহা না করে এবার ভারতকে তার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সড়ক চলাচল করিডর দেওয়া হয়েছে, মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়।
ভারতকে এই সফরে আরও বহু একতরফা সুবিধা দেওয়া হয়েছে অভিযোগ রয়েছে। যেমন: কোনো টেন্ডার ছাড়াই ভারতের রিলায়েন্স ও আদানিকে বিশাল মাপের বিদ্যুৎ প্রকল্প দেওয়ার জন্য সমঝোতা হয়েছে বিদ্যুৎ খাতের বিশেষ আইনের অপব্যাখ্যা করে। আমার কথা শুধু ট্রানজিট নিয়েই। আমরা জানি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে সবচেয়ে বড় যে কারণে তা হচ্ছে ট্রানজিট। ফলে ভারতের কাছে বহু পাওনা ও প্রত্যাশা আদায়ে এটি আমাদের সবচেয়ে বড় দর-কষাকষির শক্তি। এসব পাওনা ও প্রত্যাশার প্রায় কোনো কিছু আদায় না করে ভারতকে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, করিডর সুবিধা দেওয়ায় তাই দেশের স্বার্থ রক্ষা হয়নি।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে যাতায়াতের জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ঝুঁকি রয়েছে বলেও বহু বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন। বন্ধুত্বের খাতিরে এই ঝুঁকি নেওয়াও হয়তো অযৌক্তিক নয়। কিন্তু দুই রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেই বন্ধুত্ব অবশ্যই হতে হয় পারস্পরিক। শুধু একটি দেশ ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাসুবিধা গ্রহণ করলে আর অন্য দেশ বন্ধুত্বের আশ্বাস পেয়েই খুশি থাকলে তা কখনোই সত্যিকারের বন্ধুত্ব হতে পারে না।
৪...
নিজ দেশের স্বার্থের কথা বলা ভারত-বিরোধিতা নয়। ভারতের ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়ার পাশাপাশি নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষা করাও সত্যিকারের দেশপ্রেম। ক্ষমতায় থাকার নিশ্চয়তা পেয়ে বা অদূর ভবিষ্যতে এর আশা করে আমাদের বড় দুটো দল তা ভুলতে বসেছে বোধ হয়। দেশের বাম দলগুলোর একটি বড় অংশও ভারত-বিরোধিতা ফোবিয়ায় ভুগে নিজেদের দায়িত্ব ভুলতে বসেছে মনে হয়।
মোদির সফরে আমরা শুভেচ্ছা ও শুভকামনা জানিয়েছি, স্থলসীমান্ত চুক্তির জন্য তাঁকে অভিনন্দিত করেছি, ঠিক আছে। কিন্তু কেন আমাদের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বলতে ব্যর্থ হলো যে আমরা সীমান্তে বাংলাদেশের মানুষের হত্যাকাণ্ড বন্ধ চাই, পরিবেশবিনাশী রামপাল বা নদী সংযোগ প্রকল্পের অবসান চাই, যৌথ নদীর পানির ওপর আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই, ভারতের মানুষ যেমন সহজে এখানে ব্যবসা আর চাকরি করেন, বাংলাদেশের মানুষের জন্যও তেমন সুযোগ চাই, ভিসার নামে বিড়ম্বনা বন্ধ চাই, ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট দেওয়া হলে তার জন্য ন্যায্য অর্থনৈতিক সুবিধা চাই, ভারতের ভেতর দিয়েও অবাধে নেপাল, ভুটানসহ অন্যান্য দেশে যেতে চাই।
এসব বলা ভারত-বিরোধিতা নয়। বরং এসব না বলা হচ্ছে বাংলাদেশ-বিরোধিতা।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.