‘প্রধানমন্ত্রী কি আর আমাগো কথা শুনবে? রাকিব হত্যাকাণ্ডে রাকিবের মায়ের ক্ষোভ

খুলনায় বীভৎস কায়দায় গ্যারেজের কর্মী শিশু রাকিবকে (১২) হত্যার ঘটনায় তার পরিবারে চলছে মাতম। চোখের পানিতে ভাসছে স্বজনদের বুক।
এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মানববন্ধন ও সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা দ্রুত বিচার দাবি করেছেন। ক্ষোভ-আর্তি জানিয়েছেন রাকিবের মা লাকি বেগম।
গতকাল বুধবার বেলা তিনটায় টুটপাড়ার সেন্ট্রাল রোডে রাকিবদের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বাসার অদূরে একটি ঘরে বসে আছেন শোকাতুর লাকি বেগম। কয়েকজন মিলে তাঁকে খাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। গালে কান্নার ছোপ। মাঝে মাঝে হু হু করে কেঁদে উঠছেন। বারবার বলছেন, ‘বাবা রে, মানিক রে, তোকে বাঁচাতে পারলাম না।’
রাকিবের মায়ের কান্না দেখে চোখে পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না উপস্থিত প্রতিবেশী-স্বজনেরা। এই প্রতিবেদককে দেখে লাকি বেগম যেন ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। বলে উঠলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমার ছেলেরে যারা মেরেছে, তাদের যেন ফাঁসি হয়। আমরা তো গরিব। প্রধানমন্ত্রী কি আর আমাগো কথা শুনবে?’
মায়ের পাশে বসে ভাই রাকিবের মৃত্যুতে ছোট্ট বোন রিমিও (৮) কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। ‘আমি কাকে ভাইয়া বলে ডাকব’—ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে। অদূরে মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলেন রাকিবের বাবা নুরুল আলম। সন্তান হারানোর বেদনায় কাতর এই বাবা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমি তো কোনো দিন বাবারে ফিরে পাব না, কিন্তু ওদের যেন ফাঁসি হয়। ওরা যেন কোনো ছাড় না পায়।’
আসামি বিউটি বেগমের রিমান্ড শুনানি আজ
: শিশুশ্রমিক রাকিবকে বর্বর নির্যাতনে হত্যার ঘটনার অন্যতম আসামি বিউটি বেগমের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে গতকাল বুধবার আদালতে আবেদন করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার এর শুনানি হবে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাজী মোস্তাক আহম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামীকাল (আজ) সকাল ১০টায় বিউটি বেগমের শুনানি হবে। অন্য দুই আসামি শরিফ ও মিন্টু খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন সেলে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সুস্থ হলে আদালতে পাঠিয়ে তাঁদেরও রিমান্ডের আবেদন জানানো হবে।’
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘যে মেশিন দিয়ে বাচ্চাটির শরীরে বাতাস ঢোকানো হয়েছে, সেটি গত মঙ্গলবার রাতে জব্দ করা হয়েছে। গ্যারেজটি বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সাক্ষী-প্রমাণ যেটুকু নেওয়ার নিয়েছি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে চার্জশিট দিয়ে দেব।’
তদন্ত কমিটি গঠন: মামলার তদন্ত পর্যবেক্ষণ করতে মঙ্গলবার গঠিত হয়েছে তিন সদস্যের কমিটি। কমিটি ইতিমধ্যে কাজও শুরু করে দিয়েছে। এর সদস্যরা হলেন খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মাহবুব হাকিম, অতিরিক্ত উপকমিশনার শেখ মনিরুজ্জামান ও সহকারী কমিশনার (সদর দপ্তর) হুমায়ুন কবির।
মানববন্ধনে অংশ নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে একপর্যায়ে মূর্ছা যান
শিশু রাকিবের মা লাকি বেগম। খুলনার পিকচার প্যালেস
মোড়ে ওই মানববন্ধনের আয়োজন করা হয় -প্রথম আলো
গতকাল সকালে কমিটি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ও আসামিদের সঙ্গে কথা বলে। পরে ঘটনাস্থল টুটপাড়ায় শরিফ মটরস নামের সেই গ্যারেজে যায়। এরপর রাকিবদের ভাড়া বাসায় যায়। সেখান থেকে ফিরে খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকুমার বিশ্বাস ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) কাজী মোস্তাক আহম্মদের সঙ্গেও কথা বলেন তাঁরা।
শেখ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘রাকিব হত্যা মামলাটি যেন যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় এবং তদন্ত কার্যক্রম দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয় তা পর্যবেক্ষণে রাখতে ও তদন্ত কর্মকর্তাকে সহায়তা দিতে কমিটি কাজ করছে।’
প্রতিবাদী মানববন্ধন: রাকিব হত্যা মামলাকে সরকারের জনগুরুত্বপূর্ণ মামলা হিসেবে বিবেচনা করে তা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে প্রতিবাদী মানববন্ধন করেছে খুলনার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জন-উদ্যোগ ও মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা।
গতকাল বেলা ১১টায় নগরের পিকচার প্যালেস মোড়ে এ দুই সংগঠনের উদ্যোগে হওয়া মানববন্ধনে অংশ নেন রাকিবের মা-বাবা ও ছোট বোনও। এ সময় ‘ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই, রাকিব হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই’—স্লোগান দিতে থাকে সমবেত জনতা।
মানববন্ধনে রাকিবের মা বলেন, ‘রাকিব বাঁচার জন্য কত আকুতি করেছে, কিন্তু কেউ বাঁচাতে যায়নি। শরিফ ও মিন্টু আমার বাবারে মাইরে ফেলাইছে। আমি ওকে বাঁচাতে পারিনি।’ এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, সিলেটের সামিউল হত্যার দ্রুত বিচার না করাতেই ঘটল এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আর এর শিকার খুলনার রাকিব। এ ধরনের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে দেশবাসী হতবাক। এই হত্যা মামলা দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। কোনোভাবেই যেন অপরাধীরা আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে না পারে, সে জন্য প্রশাসনকে সচেষ্ট থাকতে হবে।
মানববন্ধনে খুলনা-২ আসনের সাবেক সাংসদ নজরুল ইসলাম, মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা খুলনার সমন্বয়কারী মোমিনুল ইসলাম, জন-উদ্যোগ খুলনার সদস্যসচিব মহেন্দ্রনাথ সেন, বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির মহিউদ্দীন আহমেদ, টিআইবির রমা রহমান, মহিলা পরিষদের রসু আক্তার, বাংলাদেশ মানবাধিকার আন্দোলনের সাইদুর রহমান, কাউন্সিলর হুমায়ুন কবির প্রমুখ বক্তব্য দেন।
একই দাবিতে বিকেল পাঁচটায় একই স্থানে মানববন্ধন করে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, খুলনা জেলা সংসদ।

No comments

Powered by Blogger.