অযৌক্তিক উন্নয়নের খপ্পরে পড়েছে ঢাকা নগর -বিশেষ সাক্ষাৎকারে: সামছুল হক by এ কে এম জাকারিয়া

সামছুল হক
সামছুল হক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক। যুক্তরাজ্যের সাদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পরিবহন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন। ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিডেটের পরিচালক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করছেন।
প্রথম আলো: ঢাকা শহরের যানজট ও পরিবহনব্যবস্থা এত শোচনীয় হয়ে পড়ল কেন?
সামছুল হক: আধুনিক একটি নগরের সুষ্ঠু যোগাযোগব্যবস্থা নির্ভর করে যথাযথ অবকাঠামোর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ওপর। ব্যবস্থাটি হয় বহুমাত্রিক এবং পরিকল্পনাটি হয় সমন্বিত। আর আমরা হেঁটেছি এর উল্টো পথে। এ ক্ষেত্রে আমাদের যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, তা ঘটছে অপরিকল্পিতভাবে। এটা আমি স্পষ্ট করেই বলতে চাই যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমাদের অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ অদূরদর্শী। বলা যায়, আমরা এক অযৌক্তিক উন্নয়নের খপ্পরে পড়েছি। এটা সমস্যার টেকসই সমাধানের পথে বড় বাধা। দিনে দিনে পরিস্থিতি এখানে এসে দাঁড়িয়েছে।
প্রথম আলো: শহরে জনসংখ্যার চাপ, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, ভূমিসংকট—এসবও তো পরিস্থিতিকে শোচনীয় করে তুলেছে।
সামছুল হক: উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে যানবাহন ও গাড়ির সংখ্যা বাড়বে, মানুষের পরিবহন চাহিদা বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। উন্নয়ন মানে কর্মসংস্থান বাড়বে, শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠবে, উৎপাদন বাড়বে, ভূমির চাহিদা ও ব্যবহার বাড়বে। নগরায়ণের ক্ষেত্রেও এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এসব বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যতে একটি শহরের চাহিদা কী দাঁড়াবে, তার হিসাব-নিকাশ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা নিতে হবে। সামনে যে চাহিদা হবে, সে অনুযায়ী আপনাকে জোগান নির্ধারণ করতে হবে। চাহিদা ও জোগানের পার্থক্যই হচ্ছে যানজট। এখন আমাদের গাড়ির সংখ্যা ও পরিবহনের চাহিদা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেই হিসাব-নিকাশটি আগে করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হলে আজ পরিস্থিতি এখানে এসে দাঁড়াত না। আমরা বর্তমান পরিস্থিতিই সামাল দিতে পারছি না। ভবিষ্যতের অবস্থা কী দাঁড়াবে? এটা তো একটা চলমান প্রক্রিয়া।
প্রথম আলো: বহুমাত্রিক বা সমন্বিত যে পরিকল্পনার কথা বললেন, ঢাকার ক্ষেত্রে তা কী হতে পারে?
সামছুল হক: ঢাকার পরিবহনব্যবস্থা মূলত সড়কনির্ভর। কিন্তু এ রকম একটা জনবহুল মহানগর শুধু সড়কব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে সচল রাখা সম্ভব নয়। ঢাকা এমন একটি অনন্য শহর, যার চারদিকে নদী রয়েছে। সড়কব্যবস্থার সঙ্গে নৌপথ ও নগর রেলব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে বহুমাত্রিক ও সমন্বিত একটি কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হবে। যোগাযোগের মূল ভিত্তি হতে হবে রেল ও নৌপথ, কিন্তু সেগুলো যেহেতু ডোর টু ডোর সার্ভিস দেবে না, সেটা পূরণ করতে হবে সড়কের মাধ্যমে। স্টেশন থেকে সড়কপথে বিভিন্ন যানবাহন ধরে বা হেঁটে মানুষ তার গন্তব্যে যাবে।
প্রথম আলো: বর্তমানে যেসব পরিকল্পনা ধরে এগোনো হচ্ছে তাতে কি এর কোনো প্রতিফলন নেই?
সামছুল হক: একটি আধুনিক নগরের জন্য দ্রুতগতির বহুমাত্রিক ও পরিকল্পিত যোগাযোগব্যবস্থা বলতে যা বোঝায়, তার কোনো ছাপ দেখা যাচ্ছে না; বরং যেসব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে বা বাস্তবায়িত হচ্ছে তা সমস্যা তৈরি করবে, যা আমার কাছে এক অশনিসংকেত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
প্রথম আলো: এই যে ফ্লাইওভার তৈরি হচ্ছে, বাস র্যা পিড ট্রানজিট বা বিআরটি, মেট্রোরেল—এগুলো কোনো কাজে দেবে না?
সামছুল হক: একমাত্র মেট্রোরেল পরিস্থিতি পরিবর্তনে কিছু ভূমিকা রাখবে। নগরবাসী দেখবে যে কত সহজে, দ্রুত ও একটি নির্দিষ্ট সময়ে চলাচল করা সম্ভব। এটাই হয়ে উঠবে নগরবাসীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরিবহন। ঢাকার মতো নগরে আরও আগেই এ ধরনের পরিবহন চালু হওয়া উচিত ছিল। আর বিআরটি যখন হবে, তখন এটা কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, তা বলা কঠিন। প্রতি ঘণ্টায় যাত্রী পরিবহনের যে হিসাব করে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যখন এর কাজ শেষ হবে, তখন চাপ বাড়বে বহুগুণ। আরও ২০ বছর আগে এ ধরনের কিছু হলে এখন আমরা সেটাকে আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে পারতাম বাসের সংখ্যা বাড়িয়ে, দোতলা বাস দিয়ে বা এই লেন ধরে মেট্রোরেল বানিয়ে।
প্রথম আলো: এখন যুগোপযোগী করার সুযোগ নেই?
সামছুল হক: দেখুন, বিআরটির যে তিনটি রুট ঠিক করা হয়েছে, তার অন্তত দুটি সাংঘর্ষিক হবে মহাখালী ফ্লাইওভার ও নির্মাণাধীন মৌচাক-মালিবাগ ফ্লাইওভারের সঙ্গে। এ দুটি ফ্লাইওভারের কারণে বিআরটির কার্যকারিতা নষ্ট হবে। সমন্বয় আর পরিকল্পনাহীনতাই বড় সমস্যা। বিআরটি হচ্ছে কিন্তু সেখান দিয়ে শেষ পর্যন্ত দ্রুতগতিতে, একটি নির্দিষ্ট লেনে ও কোনো বাধা ছাড়াই বাস চলাচল নিশ্চিত করা যাবে কি না, সেটা বিবেচনায় নেই। এই যে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন করার কাজ চলছে, সেটা শেষ হলে যে এই রাস্তা দিয়ে দ্রুতগতিতে যান চলতে পারবে, তার কি নিশ্চয়তা আছে? দ্রুতগতিতে ট্রেন চালানোর জন্য আমরা ডেমু ট্রেন আনলাম, সেগুলো চলে কিন্তু সেই পুরোনো ট্রেনের গতিতে। কারণ, অন্য বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে কাজটি করা হয়নি।
প্রথম আলো: আপনি মেট্রোরেলকেই সবচেয়ে কার্যকর বলছেন?
সামছুল হক: আধুনিক ও বড় নগরগুলোতে মেট্রোরেল বা শহরাঞ্চলের রেলই সবচেয়ে বড় দাওয়াই। দূরপাল্লার যে রেলওয়ে আছে, তা থেকে এটা ভিন্ন এক নেটওয়ার্ক। এর মাধ্যমেই নগরে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে অনেক যাত্রী পরিবহন সম্ভব। আমাদের মতো দেশে এ ধরনের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। অথচ দৃশ্যমান যেসব পরিকল্পনা রয়েছে, তাতে এ ধরনের ভাবনা নেই।
প্রথম আলো: ভূমির সংকট ও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এই নগরে এখন এ ধরনের রেল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা কতটুকু সম্ভব?
সামছুল হক: পুরো পরিবহনব্যবস্থাকে সমন্বিতভাবে বিবেচনায় নিয়ে যদি পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তবে অবশ্যই সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা, এটা এমনভাবে করতে হবে যাতে নির্বিঘ্ন ও দ্রুতগতিতে ট্রেন চলাচল নিশ্চিত করা যায়। আগেই বলেছি, আমরা ডেমু ট্রেন এনেছি কিন্তু যে গতিতে এই ট্রেন চলার কথা, সেই গতিতে চালাতে পারছি না। রেললাইনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ট্র্যাকে পরিবর্তন আনা হয়েছে, স্লিপার বদলানো হয়েছে, ডুয়েল গেজ করা হয়েছে, কিন্তু দ্রুতগতি নিশ্চিত করা যায়নি। এ জন্য পরিবেশের যে উন্নতি ঘটানো প্রয়োজন সেদিকে নজর দেওয়া হয়নি। লেভেল ক্রসিং নিয়ে ভাবা হয়নি। এটা আমাদের মানতে হবে যে বিআরটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। বিশ্বের বিভিন্ন বড় নগরের অভিজ্ঞতায় এটা অনেকটাই প্রমাণিত ও পরীক্ষিত যে মেট্রো বা নগর রেলই হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর ও টেকসই সমাধান। ঢাকার জন্যও এর কোনো বিকল্প নেই।
প্রথম আলো: আপনি ঢাকার জন্য বহুমাত্রিক বা সমন্বিত যে যোগাযোগব্যবস্থার কথা বলছেন, সেখানে নৌপথের কথাও রয়েছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তো সেটা কার্যকর করা যাচ্ছে না।
সামছুল হক: আমি শুরুতেই বলেছি, এক অযৌক্তিক ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের খপ্পরে আমরা পড়েছি। সে কারণে অর্থ খরচ করে, নানা অবকাঠামো নির্মাণ করেও আমরা এর সুফল পাচ্ছি না। নদীবেষ্টিত ঢাকা মহানগরের পরিবহনব্যবস্থায় নৌপথের ব্যাপক সম্ভাবনার পরও আমরা তা কাজে লাগাতে পারছি না। এই নদীগুলোর ওপর তৈরি করা ১৩টি সেতু একটি কার্যকর নৌপথের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো এমন নিচু করে বানানো হয়েছে যে এর নিচ দিয়ে অনেক নৌযান চলাচল করতে পারে না। বর্ষার সময়ে তো সব ধরনের নৌযানের জন্যই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। উন্নয়নের জন্য সেতু বানানো হয়েছে, অথচ এই উন্নয়ন বরং জট বাড়িয়েছে। যদি যথাযথ ও সমন্বিত পরিকল্পনা থাকত, তাহলে সেতুগুলো বানানোর সময় এত নিচু করে বানানো হতো না।
প্রথম আলো: এই নৌপথ কার্যকর হলে ঢাকার ট্রাফিক পরিস্থিতি উন্নয়নে কতটুকু ভূমিকা রাখত বলে আপনি মনে করেন?
সামছুল হক: আমার মনে হয়, ঢাকার ট্রাফিক লোডের ২০ থেকে ৩০ ভাগ নৌপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু পরিকল্পনাটি হতে হবে যথাযথ। দেখুন, ঢাকার সদরঘাট নৌ টার্মিনাল বড় হচ্ছে, দৈর্ঘ্যে বাড়ছে। কিন্তু এখানে এসে যে মানুষগুলো নামবে, তারা সেখান থেকে কীভাবে তাদের গন্তব্যে যাবে, তার কোনো যথাযথ ব্যবস্থা নেই। নেমেই কোনো বাস বা গণপরিবহন পাওয়া যাবে এমন পরিস্থিতি নেই। যেসব যাত্রী এখানে আসবে, তাদের গাড়ি রাখার কোনো পার্কিং নেই। সদরঘাট টার্মিনাল ঘিরে আপনি দোকানপাট ছাড়া আর কিছু দেখবেন না।
প্রথম আলো: আপনার পরামর্শ কী?
সামছুল হক: রেল, সড়ক ও নৌপথ মিলিয়ে একটি সমন্বিত ও বহুমাত্রিক যোগাযোগব্যবস্থা বিবেচনায় নিতে হবে, যেখানে ব্যক্তিগত যানবাহনের চেয়ে গণপরিবহনই বেশি প্রধান্য পাবে। রেল, নৌ ও সড়ককাঠামো এমন পরিকল্পিত হতে হবে, যাতে একটি অন্যটির সহায়ক হয়। সামগ্রিক পরিকল্পনাহীনতার কারণে এখন অনেক কিছুই সাংঘর্ষিক ও অকার্যকর হয়ে পড়ছে। চিন্তাভাবনা না করে যেভাবে ফ্লাইওভার বানানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা গণপরিবহনব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। যানজটের দোহাই দিয়ে অযৌক্তিক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া বন্ধ করতে হবে। এগুলো বরং দৃশ্যত মৃত নগরে পরিণত হতে যাওয়া ঢাকার শেষকৃত্যের আয়োজন হিসেবেই বিবেচিত হবে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
সামছুল হক: ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.