আগাম নির্বাচনের কী দরকার! by এ কে এম জাকারিয়া

তুরস্কে নির্বাচন হয়েছে ৭ জুন। নির্বাচনে অংশ নিয়েছে ২০টি রাজনৈতিক দল। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) পেয়েছে প্রায় ৪১ শতাংশ ভোট, আসন ২৫৮টি। এরপরই আছে রিপাবলিকান পার্টি (সিএইচপি)। তারা ২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে পেয়েছে ১৩২টি আসন। ৫৫০ আসনের পার্লামেন্টে বাকি আসনগুলো পেয়েছে অন্য দলগুলো ভাগাভাগি করে। সরকার গঠন করতে যেহেতু অন্তত ২৭৬টি আসনের দরকার, তাই একা সরকার গঠন করতে পারছে না একেপি। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী ৯ জুন পদত্যাগ করেছেন এবং তা প্রেসিডেন্ট গ্রহণও করেছেন। তবে নতুন সরকার না হওয়া পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় থাকবেন। একই সঙ্গে অবশ্য সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়া দল হিসেবে তিনি নতুন সরকার গঠনের আমন্ত্রণও পেয়েছেন। ৪৫ দিনের মধ্যে কোনো দলের সঙ্গে মিলে সরকার গঠন করতে না পারলে আগামী নভেম্বর মাসে আবার নির্বাচন হতে পারে তুরস্কে।
তুরস্কে যদি নতুন বা আগাম নির্বাচন করতে হয়, তবে সেটা করতে হবে আইনগত বা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে। কিন্তু বাংলাদেশে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর (যে নির্বাচনে প্রায় ৮০ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩০০ আসনের পার্লামেন্টে এককভাবেই ২৪৩টি আসন পেয়েছে আওয়ামী লীগ) এখনই কেন আগাম নির্বাচন নিয়ে অঙ্ক কষা শুরু করল সরকার? (আগাম নির্বাচনের অঙ্ক কষছে সরকার, প্রথম আলো, ২৪ জুন)। বাংলাদেশে এ ধরনের আগাম নির্বাচনের উদ্যোগের পেছনে আইনগত বা সাংবিধানিক কোনো ব্যাপার-স্যাপার নেই। বিষয়টি পুরোপুরি রাজনৈতিক। সরকারের ভেতরে যদি সত্যিই এ ধরনের চিন্তাভাবনা শুরু হয়ে থাকে, তবে এর পেছনে কারণটি কী?
বাংলাদেশের ইতিহাসের বিতর্কিত নির্বাচনগুলোর একটি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। এই নির্বাচনে অর্ধেকেরও বেশি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, যেখানে জনগণকে ভোট দিতে হয়নি। প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচিত বিএনপি ও তার জোট এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এসব কারণে এই নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এই নির্বাচনের সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়াও কঠিন। এমন একটি নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতারা মুখে যা-ই বলুন, ভেতরের খচখচ থেকে নিশ্চয় মুক্তি পাননি। সেই খচখচ থেকে এত দিনে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তাতে কি আগাম নির্বাচনের মলম লাগাতে চাইছে আওয়ামী লীগ? অথবা মুক্তি চাইছে ভাবমূর্তির পূর্ণগ্রাস থেকে? কিন্তু আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই এটা জানে যে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একটি আগাম নির্বাচন দেওয়ার মানে দাঁড়াবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্য হয়নি, তা স্বীকার করে নেওয়া। তা-ই যদি হয়, তবে এখন আগাম নির্বাচনের যে অঙ্ক কষা হচ্ছে, সেই কাজটি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরপর করলে কী হতো? পানি এত ঘোলা করে কী লাভ হলো?
জনগণের কাছে এ ধরনের আগাম নির্বাচনের খবর বাড়তি কোনো আশা জাগায় না। খামোখা নির্বাচন করে পয়সা খরচ করার দরকার কী! টাকাটা অন্তত বাঁচুক!
৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে আওয়ামী লীগ শুরুতে ‘নিয়ম রক্ষার নির্বাচন’ হিসেবে জায়েজ করতে চেয়েছে। এই নির্বাচনের পর বছর খানেক দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত ছিল। আর এই সময়েই আওয়ামী লীগ তার অবস্থান পাল্টে কঠোর থেকে কঠোর হতে শুরু করে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ওপর ভর করেই তারা পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার আওয়াজ তুলতে থাকে। কিন্তু এই নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে এক হঠকারী আন্দোলনের সূচনা ঘটনায় বিএনপি। সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত দলটি কৌশল হিসেবে সাধারণ মানুষকে এর শিকারে পরিণত ও তাদের পুড়িয়ে মারার মতো বর্বরতার পথ ধরে। গণ-আন্দোলনের নামে এ ধরনের সন্ত্রাস ও নাশকতার পথ কাজে দেয় না, বিএনপির আন্দোলনও কোনো পরিণতি পায়নি। অনেকটা নাকে খত দিয়েই আন্দোলন থেকে সরে আসতে হয়েছে দলটিকে।
এখন আওয়ামী লীগ যে আগাম নির্বাচনের অঙ্ক কষছে তা কী বিএনপির বীভৎস আন্দোলনের ফসল? নিশ্চয়ই নয়। প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, আওয়ামী লীগ কিছু পরিস্থিতি ও ঘটনার জন্য অপেক্ষা করছে। এর মধ্যে রয়েছে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে চলা অন্তত দুটি মামলার নিষ্পত্তি ও বিএনপিকে ভাগ করা। এসব সারা হলে ২০১৬ সালের শেষে অথবা ২০১৭ সালের শুরুতে নাকি আগাম নির্বাচন দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে সরকার। এর মানে দাঁড়াচ্ছে বিএনপির চরম বেকায়দা দশা নিশ্চিত করা গেলেই একটি আগাম নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিএনপিও এই মধ্যবর্তী বা আগাম একটি নির্বাচনের সম্ভাবনার কথা নিশ্চিত করেছে। দলটির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে সরকার আরও কিছু সময় কাটাতে চাইবে। কিন্তু আমরা মনে করি, সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে।’ বিএনপি এ ধরনের আশা করতেই পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সরকারকে ‘বাধ্য’ করার ক্ষমতা আপাতত বিএনপি বা তাদের রাজনৈতিক মিত্রদের নেই। এবং সরকারও কোনো কারণে ‘বাধ্য’ হয়ে এই নির্বাচন দেবে না। আগেই বলেছি, আগাম বা মধ্যবর্তী নির্বাচনের কোনো সাংবিধানিক বা আইনগত বাধ্যবাধকতাও নেই। আগাম নির্বাচন নিয়ে সরকারের এই ‘অঙ্ক কষা’ বা হিসাব-নিকাশটি একেবারেই রাজনৈতিক।
আওয়ামী লীগ যদি সত্যিই আগাম নির্বাচনের চিন্তা–ভাবনা করে থাকে, তার পেছনের কারণটি সরকারের গা থেকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বাজে গন্ধ দূর করা। কিন্তু বিএনপিকে ভাগ করে বা ‘নতুন বিএনপি’ তৈরি করে অথবা খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের দণ্ড নিশ্চিত হওয়ার পর যদি আগাম নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তা যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের চেয়ে গ্রহণযোগ্য কিছু হবে, তার নিশ্চয়তা কী? আওয়ামী লীগের হিসাব-নিকাশের মধ্যে যদি রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো বিষয় না থাকে, তবে আগাম বা মধ্যবর্তী নির্বাচন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের চেয়ে ভিন্ন কোনো মর্যাদা পাবে বলে মনে হয় না। গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নটি ঝুলেই থাকবে।
বিএনপির বড় নেতাদের সবাই প্রায় বিভিন্ন মামলায় জেলে অথবা পলাতক। সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত এই দলটি আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে, এমন কোনো ভয় সরকারের সামনে নেই। সবকিছুর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও পরিষ্কার। এর ওপর যদি কোনো কোনো মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের দণ্ড নিশ্চিত হয়ে যায়, তাঁরা যদি নির্বাচনের জন্য অযোগ্য হয়ে যান, তবে তো সব বাধাই দূর হবে। তখন আর নির্বাচনের কী দরকার! ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে তো সরকারের কোনো বাধা নেই।
নির্বাচন মানেই খরচ। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গণতন্ত্রকে নিচে নামিয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ আগাম নির্বাচনের যে অঙ্ক কষছে, তা আর যা-ই হোক গণতন্ত্রের মান বাড়াবে বলে মনে হয় না। আমাদের মতো জনগণের কাছে এ ধরনের আগাম নির্বাচনের খবর বাড়তি কোনো আশা জাগায় না। খামোখা নির্বাচন করে পয়সা খরচ করার দরকার কী! টাকাটা অন্তত বাঁচুক!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.