সরল-বিধ্বংসী মুস্তাফিজ by তারেক মাহমুদ

মুস্তাফিজুর রহমানের হাততালি এখন রীতিমতো আলোচনার বিষয়। উইকেট পেলে কখনো শূন্যে লাফিয়ে ওঠেন, কখনো উদ্বাহু হয়ে শরীর ঝাঁকান। তা উদ্যাপন যেভাবেই হোক, শেষটা করেন দুটো হাততালি দিয়ে। সহজ-সরল এই উদ্যাপনে কতজন কত কিছু যে খুঁজে পাচ্ছেন!
কেউ বলেন, ও নতুন। উইকেট পাওয়ার আনন্দ কীভাবে উদ্যাপন করতে হয় এখনো বুঝে ওঠেনি। একটু সময় দিতে হবে।
কেউ খুঁজছেন সারল্য। একটা ছেলে কতটা সহজ-সরল হলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেও উইকেট পাওয়ার উদ্যাপনটাকে আন্তর্জাতিক মানের করতে পারেনি!
আরও কত কিছু! তবে সব ধারণার মধ্যেই ‘কমন’ একটা ব্যাপার থাকছে। মুস্তাফিজের সারল্য। কে কী ভাবছে সেটা না ভেবে মনের আনন্দে উল্লাসে মাতার বেখেয়াল। সতীর্থদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে, ড্রেসিংরুমেও মুস্তাফিজ যথেষ্টই সপ্রতিভ। অথচ সেই মুস্তাফিজ সংবাদ সম্মেলনে কী যে আড়ষ্ট! উল্টো দিকে থাকা টেলিভিশন ক্যামেরাগুলো যেন একেকটা বন্দুকের নল! সাংবাদিকেরা নল তাক করে তাঁর কাছ থেকে কথা আদায়ের চেষ্টা করছেন।
এই চিত্র জাতীয় দলে আসার পর তাঁর প্রথম দুই সংবাদ সম্মেলনের। কালকের সংবাদ সম্মেলন সেসবের সঙ্গে পুরোপুরি মিলল না। অনেক সাংবাদিকের মতে ব্যবধানটা ‘আকাশ-পাতাল।’ এই পরিবর্তনের একটা প্রেক্ষাপট আছে। দিনের খেলা শেষে প্রথমে হলো দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে একমাত্র ফিফটি করা টেম্বা বাভুমার সংবাদ সম্মেলন। ওই সময় মাঠে বসে মুস্তাফিজকে বেশ খানিকক্ষণ পরামর্শ দিলেন বিসিবির মিডিয়া ম্যানেজার রাবীদ ইমাম। কান পেতে যা শোনা গেল, তাতে মূল বার্তা একটাই—অনেক সময় কিছু প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে হয়। তবে আজ (গতকাল) ভালো খেলেছ। এমন দিনে প্রাণ খুলে কথা বলবে।
ওই টোটকাই হয়তো একটু বদলে দিল মুস্তাফিজকে। যেখানে ‘আজ কি একটু বেশি জোরে বল করতে চাইলেন’ প্রশ্নে সাবলীল উত্তর, ‘আরে, শরীর ভালো থাকলে সবই ভালো হয়।’
তবে সংবাদ সম্মেলনে যে তিনি আসলেই ‘আকাশ-পাতাল’ বদলে গেছেন, তা নয়। আগে যে কথা এক লাইনে সেরেছেন, সেটা কাল দুই-তিন বাক্যে বলেছেন, এই আরকি। উদাহরণ দিলে আরও পরিষ্কার হবে—
ওয়ানডে অভিষেক ম্যাচে পাঁচ উইকেট পেয়েছিলেন। টেস্ট অভিষেকে পেলেন চার উইকেট। কোনটাকে এগিয়ে রাখছেন?
মুস্তাফিজ: ওয়ানডে এক রকম, টেস্ট এক রকম। এগিয়ে থাকার দিক দিয়ে টেস্টটাই...। ওয়ানডেতে যা-ই করি না কেন, সবাই রান করার চেষ্টা করে। টেস্টে সহজে উইকেট পাওয়া যায় না।
চার উইকেটের মধ্যে কোনটা পেয়ে বেশি ভালো লেগেছে? হ্যাটট্রিক না পাওয়ায় আফসোস আছে নিশ্চয়ই...
মুস্তাফিজ: হাশিম আমলার প্রথম উইকেটটা। হ্যাটট্রিকের চেষ্টা ছিল। যেভাবে বল করতে চেয়েছিলাম, সেটাই হয়েছে। কিন্তু হ্যাটট্রিক হয়নি।
টেস্ট না ওয়ানডে, কোনটা বেশি চ্যালেঞ্জিং?
মুস্তাফিজ: টেস্টটাই বেশি কষ্ট।
তবে মুস্তাফিজ মাঝে মাঝে কম কথায় আসল বক্তব্যটা দিতে পারছেন, এটাও বড় পরিবর্তন। অভিষেক টেস্টে নতুন বলে অভিজ্ঞ কাউকে সঙ্গী পাননি। ক্যারিয়ারের মাত্র চতুর্থ টেস্ট খেলতে নামা মোহাম্মদ শহীদের সঙ্গে জুটি সম্পর্কে বললেন, ‘পরিকল্পনা ছিল ডট বল বেশি করা। ডট বল বেশি হলে ওরা একটা পর্যায়ে রান নেওয়ার চেষ্টা করবে। তখন উইকেটও আসবে।’
এমন কোনো মহাকাশবিজ্ঞান নয়। তবে প্রথম টেস্টেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সাফল্যকে কৃতিত্ব দিতেই হবে। তা ছাড়া ওয়ানডেতে বিস্ময় ছড়ানো অফ কাটার কমিয়ে এনে যেভাবে অন্য অস্ত্রগুলো ব্যবহার করলেন, শুরুতেই অনেক কিছু বুঝে ফেলার প্রমাণ তাতেও। অভিষেক টেস্টের প্রথম স্পেলটা (৫-০-২০-০) অবশ্য মনমতো হয়নি মুস্তাফিজের। ভয়ংকর হয়ে উঠলেন ৪ ওভারের তৃতীয় স্পেলে। ৬ রান দিয়ে দুই মেডেনসহ ৩ উইকেট, সেটাও হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা জাগিয়ে মাত্র চার বলের মধ্যে! হঠাৎ বিধ্বংসী হয়ে ওঠার রহস্য ফাঁস করলেন নিজেই, ‘লাঞ্চের সময় কোচ আমাকে ডেকে প্রথম স্পেলের বোলিং দেখালেন।’ স্বল্পভাষী মুস্তাফিজ আর কিছু না বললেও সাংবাদিকেরা বুঝে নিলেন, ভুলগুলো শুধরে নিয়েছিলেন তখনই।
কিন্তু এভাবে বুঝে নেওয়া আর কত! সংবাদ সম্মেলন শেষে মাঠ পাড়ি দিয়ে ড্রেসিংরুমে যাওয়ার পথেও তাই মুস্তাফিজের পিছু পিছু সাংবাদিকদের দল। খোলা আকাশের নিচে যদি আরেকটু প্রাণখোলা হন! হলেন এবং তাতে বেরিয়ে এল মাঠের মুস্তাফিজও—
—উইকেটগুলো কি খুব সহজে পেয়ে যাচ্ছেন?
মুস্তাফিজ: ওপরওলা দিচ্ছেন, তাই সহজ হয়ে যাচ্ছে।
—তৃতীয় উইকেটটা পাওয়ার পর কেমন লাগছিল?
মুস্তাফিজ: তা কি আর বলা লাগে...!
কথা শেষ না হতেই হঠাৎ সেই হাততালি। সারল্যের মধ্যেই ফুটে উঠল বিধ্বংসী মুস্তাফিজের চেহারা।
উইকেট পাওয়ার পর সতীর্থদের আনন্দের মধ্যমণি হবেন—মুস্তাফিজুরের জন্য গত কিছুদিনে এটি নিয়মিত অভিজ্ঞতাই। এই ছবিটি ডিআরএসে ডুমিনির আউট নিশ্চিত হওয়ার পর। আগের বলটিতেই হাশিম আমলাকে কটবিহাইন্ড বানিয়ে টেস্টে প্রথম উইকেট পেয়েছেন বাংলাদেশের বাঁহাতি পেসার l প্রথম আলো

No comments

Powered by Blogger.