বগুড়ায় ‘লোক দেখানো’ উচ্ছেদ অভিযান

করতোয়া নদী দখল করে গড়ে তোলা কয়েকটি স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে অবৈধ দখলদারের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে বগুড়া জেলা প্রশাসন। গত বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হাবিবুল হাসান র্যা ব-পুলিশ নিয়ে শহরের নওয়াববাড়ি সড়কের জহুরুল ইসলাম ঘাট-আনন্দ আশ্রম এলাকায় করতোয়ার ওপর গড়ে তোলা অবৈধ দুটি স্থাপনার সামান্য কিছু অংশ ভেঙে দেন। তবে ওই দুটি স্থাপনার পাশে করতোয়া দখল করে গড়ে তোলা বেসরকারি সংস্থা টিএমএসএস মহিলা মার্কেট, ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ ও অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বিসিএল বিপণিকেন্দ্র, ডায়াবেটিস হাসপাতালসহ প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অবৈধ স্থাপনায় হাত দেননি অভিযান পরিচালনাকারী দলের সদস্যরা। ঢাকঢোল পিটিয়ে অভিযানে নেমেও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অবৈধ স্থাপনা অক্ষত থাকায় এই অভিযানকে ‘লোক দেখানো’ বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই।
অবশ্য হাবিবুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, করতোয়ার অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করে ইতিমধ্যেই ২৮ জনের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ মামলা করা হয়েছে। উচ্ছেদ মামলার নিষ্পত্তির ভিত্তিতে প্রথম ধাপে ছয়জন দখলদারের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এ অভিযান অব্যাহত থাকবে ও পর্যায়ক্রমে সব দখলদার উচ্ছেদ এবং নদীর সীমানায় সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করা হবে।
নদীর সীমানার ভেতরে অবৈধ স্থাপনা থাকলেও এসব স্থাপনার সামান্য অংশ ভেঙে ফেলার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি শুধু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করছি, নকশা অনুসরণ করে নদীর সীমানা নির্ধারণ করছেন ভূমি কার্যালয়ের সার্ভেয়ার। তিনি যেভাবে সীমানা দেখে দিচ্ছেন, সেভাবেই স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।’
জেলা প্রশাসন যে ছয়জন অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে অভিযান শুরু করেছে, তাঁরা হলেন আনন্দ কুমার, সঞ্জীব কুমার বিহানী, জোবাইদুল ইসলাম, মাজেদ হোসেন, মতিয়ার রহমান ও ফরিদ উদ্দিন। উচ্ছেদ অভিযানের বাইরে জেলা প্রশাসন করতোয়া নদী দখলদার আরও যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ মামলা করেছে, সেগুলো হলো টিএমএসএস ও বিসিএল, বগুড়া ডায়াবেটিক সমিতি, ব্যবসায়ী শংকর প্রসাদ (শংকর বাবু), আরাবিয়াতুল সালাফিয়া ওয়া হাফেজিয়া মাদরাসা ও মসজিদ মোবারক ফতেহ আলী, আবুল কালাম আজাদ, খয়রতুজ্জামান, রাধা প্রসাদ (রাধা বাবু), আবদুস সোবহান, কানাইলাল বসাক, এ কে এম ফজলুর রহমান, মুক্তার হোসেন, প্রদীপ কুমার রায়, আবদুল জলিল, সাইফুল ইসলাম, লাভলী বেগম, আবুল হোসেন, বজলার রহমান, কাশেম আলী, গোলাম মোস্তফা, কৃষ্ণা সাহা ও আরতি রানী।
গত ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) করতোয়া নদী দখলমুক্ত করে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে বগুড়ার জেলা প্রশাসকসহ ২২ জনকে আইনি নোটিশ পাঠায়। ১৫ দিনের মধ্যে নোটিশের জবাব চাওয়া হলেও তাতে কেউ সাড়া না দেওয়ায় গত ২২ জুন হাইকোর্টের বিচারপতি মির্জা হোসাইন হায়দার ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে রিট মামলা করে। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে করতোয়া দখলমুক্ত এবং নদীতে সব ধরনের বর্জ্য ফেলা বন্ধসহ দূষণরোধ ও নদীর গতিপথে পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টিকারী গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালীতে নির্মিত জলকপাট উন্মুক্ত করে নদীর পানিপ্রবাহ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে রুল জারি করেন আদালত।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের বগুড়া জেলা কমিটির সভাপতি সামির হোসেন বলেন, করতোয়ার দখলদারের সংখ্যা অনেক। জেলা প্রশাসন কিসের ভিত্তিতে ২৮ জনের তালিকা করেছে, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে। শুধু চুনোপুঁটি নয়, প্রভাবশালী দখলদারদেরও উচ্ছেদ করে করতোয়ার প্রাণ ফিরিয়ে দিতে হবে।
জানতে চাইলে বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) হায়াত-উদ-দৌলা খান প্রথম আলোকে বলেন, করতোয়ার ২৮ দখলদারের বিরুদ্ধে হওয়া উচ্ছেদ মামলার শুনানি অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে ছয়টি মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে। ‘লোক দেখানো অভিযান’ বিষয়ে তিনি বলেন, সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয় থেকে মাপজোখ করে ২৮ দখলদারকে চিহ্নিত করেছে। আপাতত ওই ২৮ জনের বিরুদ্ধেই উচ্ছেদ প্রক্রিয়া চলছে। এর বাইরে অন্য কোনো অবৈধ দখলদার থাকলে চিহ্নিতকরণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। আর উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনাকালে ভূমি কার্যালয়ের সার্ভেয়াররা যেভাবে সীমানা নির্ধারণ করে দিচ্ছেন, ওই সীমানার মধ্যে থাকা অবৈধ স্থাপনা সেভাবেই ভেঙে ফেলা হচ্ছে। হাইকোর্টের রিট সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘হাইকোর্ট থেকে এখনো কোনো নির্দেশনা আমরা পাইনি।’
করতোয়া নদী দখলমুক্ত করার অভিযানে স্থাপনা ভাঙছেন শ্রমিকেরা। গতকাল দুপুরে বগুড়া শহরের নওয়াববাড়ি সড়কের পৌরসভার কেন্দ্রীয় ঘাট থেকে তোলা ছবি l প্রথম আলো

No comments

Powered by Blogger.