আইন না করে সংশোধনী ভয়ংকর by মিজানুর রহমান খান

বিচারক ও অন্যান্য সাংবিধানিক পদধারীদের জবাবদিহির প্রশ্ন কেবলই অপসারণের মধ্যে নিহিত—সে কথা ঠিক নয়। বিচারকেরা যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন, সে কারণে গণতান্ত্রিক বিশ্ব প্রধানত অভিশংসন নিয়েই ভেবেছে। অভিশংসন কথাটি ব্যবহারিক অর্থে বলা। কারণ, বাংলাদেশ সংবিধান অভিশংসন ও সংসদের মাধ্যমে অপসারণের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। ‘সংবিধান লঙ্ঘন ও গুরুতর অসদাচরণের’ কারণে রাষ্ট্রপতির অভিশংসন ঘটে। এখন সংসদের প্রস্তাবের মাধ্যমে বিচারকেরা অপসারিত হবেন।

বিচারকদের স্বাধীনতার প্রতি সংসদীয় অভিশংসনপ্রথা হুমকি—এ কথা কোনো পণ্ডিত কখনো কোথাও লিখেছেন বা বলেছেন বলে জানা নেই। আমরা বিতর্ক করব, কিন্তু তথ্যনিষ্ঠও থাকব। ১৯৯১ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের চার সদস্যের একটি বেঞ্চ, যার মধ্যে ছিলেন বিচারপতি ভার্মা, যাঁর তৈরি বিচারক নিয়োগনীতি আমাদের সুপ্রিম কোর্ট ১০ বিচারকের রায়ে নিয়েছেন, ভারতের সেই বেঞ্চ বিচারকের জবাবদিহি প্রশ্নে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক কনভেনশনগুলো কী বলেছে, তা অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। এবং অভিমত দিয়েছেন, বিচারকের আচরণগত তদারকি বিচারকেরাই করবেন। কিন্তু বিচারকেরা বিচারক অপসারণ করবেন না। তাঁরা বিচারকদের লঘু শাস্তি দেবেন। অপসারণের জন্য সুপারিশ করবেন। এই রায়ের ভিত্তিতে ভারত সরকার বিচারক অপসারণ আইনে সংশোধনী বিল আনছে। তখন তদন্ত কমিটিতে বাইরের কেউ থাকবে না। শুধু বিচারকদের দিয়েই সংবিধিবদ্ধ কমিটি থাকবে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, জবাবদিহি ও নির্দিষ্টভাবে অপসারণসংক্রান্ত জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মৌলিক দলিলগুলো ভারতের আইন কমিশন তার ২০০৬ সালের প্রতিবেদনে (৩৮-৬৩ পৃষ্ঠা) বিস্তারিত আলোচনার পর তাদের সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে একমত হয়েছে যে, বিচারকেরা বিচারক অপসারণ করবেন না। এই বিষয়ে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টও একমত। তবে ভারতীয় আইন কমিশন জাতিসংঘের কনভেনশনগুলো হাজির করেছে ভারতীয় রাজনীতিকদের এটা বোঝাতে যে, তোমরাই বিচারকদের অপসারণ করবে, দণ্ডিত করবে। কিন্তু কারও আচরণ অপসারণযোগ্য কি না, সেই সিদ্ধান্ত তোমরা নেবে না। তদন্ত করে কাউকে দোষী কিংবা নির্দোষ প্রমাণ করার কাজটা বিচারকেরাই করবেন।
ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদননির্ভর বিদ্যমান কাউন্সিলকে শ্রেয়তর বললে জাতি হিসেবে আমাদের মর্যাদা বাড়বে না। তার চেয়ে বরং অভিশংসনের শ্রেষ্ঠত্ব কবুল করে এই প্রক্রিয়ার কোন অংশ বাংলাদেশের জন্য অসুবিধাজনক, সেটা ব্যাখ্যা করাই ভালো। যাঁরা ওঁচা সংসদ বলে মুখ ফেরাচ্ছেন, তাঁদের কাউকে এর আগে কাউন্সিলের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে সরব হতে দেখিনি; বরং সংসদে গিয়ে সবাই এক বাক্যে কাউন্সিলের তারিফ করে এসেছেন। তাঁদের কারও ভান্ডারে এই ব্যবস্থার সংস্কারে কোনো প্রস্তাব ছিল না, এখনো নেই।
সংসদের বৈধতা ও কর্তৃত্বপরায়ণ একটি সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা আর অভিশংসনের নীতিগত বিরোধিতা একসঙ্গে চলে না। বিদেশি বন্ধুরা খুব অবাক হবেন। কারণ, তাঁরা কেউ কখনো বিচারকের অভিশংসন-ভীতি শোনেননি। শ্রীলঙ্কা হয়তো শত বছরের ব্যতিক্রম, তবু দেশটির প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে কটাক্ষ করা আমাদের সাজে না। ২০১৪ সালের আইনের শাসন সূচকে শ্রীলঙ্কা ৯৯টি দেশের মধ্যে ৪৮, বাংলাদেশ নিকৃষ্ট ৯২তম। রাজাপক্ষে অন্তত বাংলাদেশ মডেলে প্রধান বিচারপতি শিরানিকে অপসারণ করেননি; বরং শ্রীলঙ্কার উচ্চ আদালত অভিশংসনের আগেই সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, এমনকি এই উদ্যোগকে অসাংবিধানিক বলে রায় দানের হিম্মত দেখিয়েছেন। আর কাউন্সিল নিয়ে আমাদের ‘গর্বিত’ জাতি অসহায়ভরে দেখেছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন রিটকারীর মর্যাদা পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেনকে অপসারণ প্রসঙ্গে জেনারেল এরশাদ অকপটে আমাকে বলেন, তাঁকে অপসারণে ‘কারণটা ছিল মতের অমিল’। এরশাদের সামরিক শাসনের অনেক কিছুই সুপ্রিম কোর্ট পাল্টেছেন। প্রধান বিচারপতিকে অপসারণ আদেশ তাঁরা উল্টে দেননি।
অভিশংসন আনতে সরকার রাজনৈতিক আবেগকে পুঁজি করলে যাঁরা এর কট্টর বিরুদ্ধ যুক্তি দিচ্ছেন, তাঁরাও বহুলাংশে আবেগান্ধ। অধস্তন আদালতের বিচারক নিয়োগ ও অপসারণে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার প্রকৃত সমর্থক সুপ্রিম কোর্ট বার থেকে আন্দোলনের হুমকি কৌতূহলোদ্দীপক বটে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বর্ণিত ‘দুই দলের এককাট্টা’ হওয়া একটি নিষ্ঠুর পরিহাস। দলীয়করণে জেরবার বার গত দুই দশকেও দুই নেত্রীর চক্ষুশূল হওয়ার মতো কোনো স্বাধীনতাবান্ধব কর্মসূচি দিতে অপারগ থেকেছে। ২০১০ সালে আমাদের আপিল বিভাগ, যেখানে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ছিলেন না, ছিলেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি এবং পরবর্তী জ্যেষ্ঠ বিচারপতি, তাঁরা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে বাতিল করেছিলেন। তখন বার টুঁ শব্দ করেনি।
সরকারের উদ্দেশ্য মহৎ মনে হয় না। কিন্তু যাঁরা এই কাউন্সিলকে একটি মীমাংসিত বিষয় মনে করেন, তাঁদের যুক্তিও যথেষ্ট সবল, তা মনে করার কারণ নেই। যদি সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, যদি সংসদের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, সেটা ভিন্ন বিষয়। এত বড় একটি সাংবিধানিক সংস্কার, আদালত ছাড়াও যার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের মতো আরও তিনটি সাংবিধানিক এবং আরও তিনটি আধা সাংবিধানিক সংস্থার জবাবদিহির প্রশ্ন জড়িত, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যতখানি প্রস্তুতি ও সমঝোতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা নেওয়া উচিত ছিল, সেটা তারা করেনি। ১৬তম সংশোধনী যে প্রক্রিয়ায় মন্ত্রিসভায় ধুম করে পাস করিয়ে ফেলল, তাতে মনে হচ্ছে, ক্ষমতাসীনেরা সংবিধানকে ভূর্জপত্র মনে করেন। গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা ও রীতিনীতি সমাহিত হচ্ছে। বিতর্কিত সম্প্রচার নীতিমালা করতেও সরকার এক বছর নিল, কিন্তু এত বড় একটি বৈপ্লবিক সাংবিধানিক পরিবর্তন আনতে তারা কথাই বলল না।
সংসদের আসন্ন অধিবেশনেই এটা পাস করিয়ে ফেলার যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তাতে আমরা শঙ্কিত। মূল সংবিধানের একটি বিধান আনা হচ্ছে। তাই এর বিরুদ্ধে কোনো রিট চলতে পারে না। আইনমন্ত্রী ও আইন কমিশন চেয়ারম্যান আমাদের আশ্বস্ত করছেন যে, আওয়ামী লীগ আমলে কাউকে অভিশংসন করা হয়নি। আসল সত্যটা হলো, এটা অকার্যর ছিল। কাউকে অভিশংসন করার সুযোগ ছিল না। কারণ, আইনটা করা হয়নি।
আইনমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে আলাপ করে মনে হলো, আইন করার ব্যাপারে তেমন কোনো প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। অথচ আমরা কতটা উদ্বিগ্ন হব, সেটা আইন না দেখে বলা যাবে না। আইনমন্ত্রী বলেছেন, তাঁরা তিন মাসের মধ্যে আইন করবেন। তাহলে প্রশ্ন হলো, আইন করা না হলে তড়িঘড়ি সংবিধান সংশোধন করতে হবে কেন। কী লাভ? বরং বিরাট সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। বাহাত্তর সালে বাংলাদেশ নবজাতক ছিল। তাই তখনকার আইন না থাকা আর এখন না থাকা এক নয়। প্রস্তাবিত বিল পাস হলেই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল যে আচরণবিধি ২০০০ সালে শেখ হাসিনার প্রথম আমলে কার্যকর করেছিলেন, সেটি বাতিল হয়ে যাবে। আর সংসদের কাছে ক্ষমতা নেওয়ার কারণে সুপ্রিম কোর্ট অনতিবিলম্বে নিজেদের গরজে একটি আচরণবিধি করবেন বলেও মনে হয় না। সুতরাং, সরকার এমন একটি বিপদ ডেকে আনছে, যা থেকে তাদের বিরত থাকা উচিত।
প্রয়াত প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন আমাকে বলেছিলেন, ‘জিয়া এটা ফিরিয়ে আনার পরে তাঁরা তিনজন মিলে আচরণবিধি করেছিলেন।’ পাকিস্তনের যেটা ছিল, সেটাই দু-চারটি বাক্য এদিকে-সেদিক করে তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন। সেই আচরণবিধি দীর্ঘকাল আলোর মুখ দেখেনি। এমনকি বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরীর আচরণ নিয়ে যখন আপিল বিভাগ রায় লিখতে বসলেন, তখন তাঁরা এই আচরণবিধির নাম নিলেন না। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত আমার একটি বইয়ে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল: পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সংবিধানের অনন্য বৈশিষ্ট্য’ নামে একটি চ্যাপ্টার আছে। এতে একজন বিচারপতি শওকতের উল্লেখ করেছিলাম। স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে ঢাকার হাইকোর্টে বিচারক থাকার সময় তিনি স্ত্রীর নামে অর্ধডজন মার্সিডিজ আমদানি করেছিলেন। ডন পত্রিকার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখি, উদাহরণ আজও ওই একটি। মিল আছে। বাংলাদেশও একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। মনে রাখব, পাকিস্তানকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের টপ টেনে ওঠা এই কাউন্সিল ঠেকাতে পারেনি। অথচ পাকিস্তানে সামরিক শাসনে ডজন ডজন বিচারক অপসারিত হয়েছেন।
বিচারপতি শওকতের বিরুদ্ধে আচরণবিধির প্রায় ১০টি ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। শুনানিকালে তিনি বলেছিলেন, আমি তো আচরণবিধিই পাইনি। কী অপরাধ করলাম জানব কী করে? এরপর বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রারকে তদন্ত করতে দিলেন। প্রমাণিত হলো, নিয়োগপত্রের সঙ্গে তিনি আচরণবিধি পেয়েছিলেন (বিস্তারিত দেখুন পিএলডি, ১৯৭১ এসসি৫৮৫)। বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বাধীন কাউন্সিল একাত্তরের যুদ্ধকালে বিচারক শওকতকে অপসারণের সুপারিশ করেছিলেন। খুব বেশি দিন হয়নি, আমাদের বিচারপতিরা নিয়োগপত্রের সঙ্গে আচরণবিধি পাচ্ছেন।
আচরণবিধি মান্য করা নিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে তেমন কোনো স্পন্দন নেই। প্রশ্নের জবাবে সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান আমাকে সম্প্রতি বলেন, বিচারকের বিব্রত হওয়ার কারণ প্রধান বিচারপতিকে জানাতে তাঁর উদ্যোগেই নতুন বিধি হয়েছিল। কিন্তু তার কার্যকারিতা তিনি দেখেন না। সম্পদের বিবরণী দানের বিধিও সচল নয়। একটি আলোনিরোধক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে উচ্চ আদালত। দীর্ঘকাল বিচারক নিয়োগকালে আচরণবিধি দেওয়া হতো না। ১৯৯৪ সালে বিচারপতি মনোয়ার উদ্দিনের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এর কপি বারকে দিয়েছিলেন। সেই প্রথম এটা উন্মুক্ত হয়। ধরে নিই, সংবিধান বিল পাসের ৯০ দিনের মধ্যে আইন হবে। সেটা করার অর্থ দাঁড়াবে, এই ৯০ দিনের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকে আইনের ঊর্ধ্বে যাবেন। এই সময়ে কেউ গুরুতর অসদাচরণ করলেও তাঁর বিচার করা কঠিন হবে। কারণ, ভূতাপেক্ষ আইন দিয়ে ওই সময়ের অপরাধের বিচার করা যাবে না। জবাবদিহি আদায় করা যাবে না। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এ ক্ষেত্রে যাঁরা বলেন, বাহাত্তরে যাই, তাঁরা আসলে বলেন চলেন মহাশূন্যে যাই।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.