মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি টাইমলাইন by ভোলকার পার্থেস

তিনটি পৃথক টাইমলাইন মধ্যপ্রাচ্যের সমকালীন ইতিহাসের রূপরেখা প্রণয়ন করছে: দৈনন্দিন সংগ্রাম ও রাজনীতির স্বল্পমেয়াদি টাইমলাইন, ভূরাজনীতির মধ্যমেয়াদি পরিবর্তন—যার ফল বোঝা যায় দশক কাল পরে, সামাজিক সংস্কৃতির দীর্ঘমেয়াদি রূপান্তরের টাইমলাইনে। ইতিহাসবিদ ফার্নান্দ ব্রডেল যেটাকে দীর্ঘমেয়াদি ঐতিহাসিক কাঠামো হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এ অঞ্চলের জন্য কার্যকর একটি কৌশল প্রণয়নের ক্ষেত্রে এর প্রতিটিকে আলাদাভাবে বুঝতে হবে। প্রথম টাইমলাইনটি নিশ্চিতভাবেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যকার যুদ্ধের খবর সংবাদমাধ্যমগুলো নিরন্তর প্রকাশ করে যাচ্ছে। এ তালিকায় আরও আছে ইরানের সাম্প্রতিক পারমাণবিক কর্মসূচিসংক্রান্ত আপসের খবর, মিসর ও বাহরাইনে চলমান বিরোধী কার্যক্রম ও রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং সিরিয়া ও ইরাকে খুন এবং মানবিক বিপর্যয়। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক চিন্তাধারা প্রায়ই দ্বিতীয় টাইমলাইনের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে গড়ে উঠছে। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর গড়ে ওঠা ও অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের বিষয়টি মাথায় না রাখলে এর সাম্প্রতিক ইতিহাস ও রাজনীতি বোঝা যাবে না।
যেমন এটা সব সময় মনে রাখা দরকার যে বহিঃস্থ শক্তিগুলো যেমন ব্রিটেন ও ফ্রান্স এ অঞ্চলের রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। এশিয়া মাইনর ঐকমত্যের বিরোধিতার মধ্যে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক আন্দোলনের মর্ম নিহিত রয়েছে। এই ঐকমত্য প্রায় এক শতাব্দী ধরে অক্ষুণ্ন ছিল। এর মাধ্যমে সিরিয়া, ইরাক, জর্দান, লেবানন ও ক্ষেত্রবিশেষে সৌদি আরব ও অন্যান্য উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর জন্ম হয়েছে, যদিও এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মৌলিক কোনো তফাত নেই। এর মাধ্যমে আরব দুনিয়ার চার থেকে পাঁচ প্রজন্মের রাজনৈতিক মানদণ্ড নির্ধারণ হয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানের নায়কেরাও রয়েছেন, যাঁরা এর জন্য লড়েছেন, এর সঙ্গে খাপ খাইয়েছেন এবং এমনকি এটাকে প্রভাবিত করারও চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ব্যবস্থার জট হয়তো খুলতে যাচ্ছে। সিরিয়া ও ইরাকের সীমানা মুছে যাচ্ছে, সুন্নি জঙ্গিরা এ রাষ্ট্র দুটোর একটি বড় অংশ দখল করে নিচ্ছে। আর কুর্দি সেনাদের উত্থানে একটি পূর্ণাঙ্গ কুর্দি রাষ্ট্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার বিরাজমান অবস্থাও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। সেখানে দুই রাষ্ট্রের সম্ভাবনা আগের চেয়ে কমে যাওয়ায় সে অঞ্চলের পরিস্থিতি ক্রমশ এক রাষ্ট্রের সমাধানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আপসরফা চলছে।
এ অঞ্চলের কৌশলগত প্রভাব, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে যে বিবাদ চলছে, সেটা মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংকটে সর্বশেষ সংযোজন। আর উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে দুনিয়ার তেল আহরণের ক্ষুধা সহসা মিটবে না বিধায় সেখানকার রাজনীতির বিন্যাসে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে। বহিঃস্থ শক্তির প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই সেখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে, ১৯৭০-এর দশকে তারা গ্রেট ব্রিটেনকে হটিয়ে দিয়ে প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠেছে। চীন ও ভারত ক্রমেই শক্তিমান হয়ে ওঠায় যুক্তরাষ্ট্রকে এখন তাদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হবে।
কিন্তু এ অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্র ইরান ও সৌদি আরবই মধ্যপ্রাচ্যকে বদলে দিতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কি আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারে নিজেদের মধ্যে বিবাদ করে যাবে, নাকি এ অঞ্চলের নিরাপত্তাকাঠামোর খুঁটি হয়ে উঠবে? প্রধান শক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্যের সংকটে নিজেদের আর যুক্ত রাখতে না চাওয়ায় এরূপ একটি কাঠামো জরুরি হয়ে উঠেছে। এ অঞ্চলের রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ ফলপ্রসূ হবে না, এটা বুঝে যাওয়ায় পশ্চিম আর সেখানে তাদের স্বার্থ রক্ষায় খুব একটা তৎপর হবে না। এর সঙ্গে রাশিয়া, চীন ও ভারতও একই কাতারে শামিল হয়েছে। সেখানকার কোনো শক্তি আঞ্চলিক হুমকি হয়ে উঠলেও তারা আর সেখানে খুব একটা নাক গলাবে না।
স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি টাইমলাইন থেকে কোনো শৃঙ্খলা ও সুস্থিরতা না এলে দীর্ঘমেয়াদি ঐতিহাসিক কাঠামো থেকে যে নৃতাত্ত্বিক বা আত্মসত্তার রাজনীতি গড়ে উঠেছে, সেটাই তখন প্রধান হয়ে দাঁড়াবে। আত্মসত্তার ঠিকুজি কত দূর পর্যন্ত সন্ধান করা হলো সেটা কোনো কাজের কথা নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত এগুলোর নাম নিয়ে ইতিহাস বিকৃতি করা যায় বা সেটাকে চলমান রাজনৈতিক লক্ষ্যের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।
এই টাইমলাইনের পর্বগুলো সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর মতোই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ১৪০০ বছর আগে ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর নেতৃত্ব নিয়ে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়, সেখান থেকেই শিয়া ও সুন্নি বিভাজনের সূত্রপাত হয়। আব্বাসীয় ও ফাতিমীয়দের মধ্যকার যুদ্ধ, এরপর ক্রুসেড, মোঙ্গলদের অভিযান ও অবশ্যই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ—এসব কিছুই মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমান দ্বন্দ্ব-বিবাদের উৎস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কিন্তু এসব ঘটনা থেকে শুধু ব্যাখাই দেওয়া হয় না, এসব থেকে কখনো কখনো জোরালো সাড়াও পাওয়া যায়। আইএস যে সম্প্রতি ইরাক ও সিরিয়ায় খিলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে, সে বিষয়টির প্রতি একটু নজর দিন। অধিকাংশ সুন্নিই ইসলামি রাষ্ট্রের স্বনিয়োজিত খলিফা আবুবকর আল-বাগদাদির নৃশংস আচরণে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। এই ব্যক্তি দাবি করেন, কালে কালে তিনি রোম দখল করবেন—এ কথা শুনে সুন্নিরা হাসাহাসি করে।
তার পরও বাগদাদি দীর্ঘমেয়াদি ঐতিহাসিক কাঠামোর যে ‘স্মৃতি’ ও প্রতীকের অবতারণা করেন, সেগুলোর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে: আব্বাসীয়দের কালো পতাকা, ইসলামের স্বর্ণযুগে খিলাফতের প্রবল প্রতাপ প্রভৃতি। অবশ্যই, আইএসের হাতে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র না থাকলে এই স্বর্ণযুগের অবতারণা করে তেমন কোনো কাজ হতো না বা ইরাক ও সিরিয়া রাষ্ট্র হিসেবে সংহত হলেও এসব ধোপে টিকত না। কিন্তু তারা ইসলামি রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে এত শক্তিশালী এক ঐতিহাসিক আখ্যান যুক্ত করেছে যে সেটাকে একদম ফেলে দেওয়া যায় না।
এই অ্যাখ্যানের ভেতরে ঢুকলে বিদেশিরা ধাঁধায় পড়ে যেতে পারে। তারা না পারবে দীর্ঘমেয়াদি ঐতিহাসিক কাঠামোর তাৎপর্য উপেক্ষা করতে, না পারবে এই দাবি বিশ্বাস করতে যে এই যুদ্ধ একটি তরিকার ধর্মীয় ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে।
আরও সাধারণভাবে বললে, এই অঞ্চলে কোনো বহিঃস্থ শক্তির এটা বিশ্বাস করা চলবে না যে শিয়া, সুন্নি বা কোনো ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী তাদের সঙ্গে আছে। মধ্যপ্রাচ্যের সব টাইমলাইনের একটি অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সব স্থানীয় কুশীলবই নিজেদের পক্ষে। বিদেশিদের কাছে টানলে তাদের লাভ হবে, এমন সম্ভাবনা থাকলে তারা বিদেশিদের দলে ভেড়ানোর জন্য জান দিয়ে দেবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ভোলকার পার্থেস: জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের চেয়ারম্যান।

No comments

Powered by Blogger.