তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ? by আনিসুল হক

ঈদের আগে একদিন টেলিভিশনে আল-জাজিরা দেখছিলাম। ইসরায়েলের একজন আর ফিলিস্তিনের একজন টক শোয় অংশ নিচ্ছিলেন, যার যার জায়গা থেকে, আর কেন্দ্রে বসে একজন সঞ্চালক মধ্যস্থতা করছিলেন।
ফিলিস্তিনি প্রশ্ন করলেন, আজ আমরা ১০ হাজার মানুষ শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করছিলাম, সেখানে কেন ইসরায়েলি সৈন্যরা গুলি করল?
ইসরায়েলি ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, আপনি সন্ত্রাস সমর্থন করেন, নাকি শান্তি?
ফিলিস্তিনি আলোচক বললেন, আমি হিংসার বিরুদ্ধে। আমি অহিংস আন্দোলনের পক্ষে। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সমাবেশে ইসরায়েলি সৈন্যরা কেন গুলি করবে? তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন ইসরায়েলি ভদ্রলোককে—যিনি কিনা আবার একজন সাবেক কূটনীতিক—আপনি ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতাকে সমর্থন করেন কি না?
ইসরায়েলি বললেন, হ্যাঁ। আমি ফিলিস্তিনিদের নিজেদের ভাগ্য নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার সমর্থন করি। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের মিছিল থেকেও গুলি করা হয়েছিল।
>>ইসরায়েলি আগ্রাসন থেকে রেহাই পায়নি এই শিশুরাও
আল-জাজিরা টেলিভিশনের ফুটেজে দেখা গেল, বিচ্ছিন্নভাবে হাতে তৈরি অস্ত্র থেকে গুলি ছোড়া হচ্ছে সৈন্যদের দিকে। আল-জাজিরা এই ফুটেজ কোথায় পেয়েছে, আমি জানি না। কাজেই এর সত্যতা নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। তবে আল-জাজিরা ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করে, অন্তত ইসরায়েলি বর্বরতার বিরোধিতা করে, এটা কোনো গোপন বিষয় নয়। আর ইসরায়েলি সৈন্যরা আল-জাজিরার অফিসের ভেতরেও এবার গোলা ছুড়েছে। ইসরায়েলে আল-জাজিরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এই রকম খবর আল-জাজিরা টেলিভিশনেই দেখলাম বলে মনে হচ্ছে।
যাই হোক, এরপর একবার বিবিসি, একবার সিএনএন দেখি। খুব বেশিক্ষণ দেখেছি তা নয়। কিন্তু মনটা খুব বিষণ্ন হয়ে আছে। যে নিউইয়র্ক টাইমস-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে ইসরায়েল পক্ষপাতিত্বের, তাদের হিসাবেই ১৩২৮ জন ফিলিস্তিনি এবং ৫৯ জন ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন ৮ জুলাইয়ের পরে গাজায় ইসরায়েলি হামলায়। ৮ থেকে ৩০ জুলাই ২৩ দিনে প্রায় ১৪০০ মানুষের মৃত্যু! তার মধ্যে আছে নারী আর শিশুরা। ইসরায়েলি সৈন্যরা হামলা করেছে হাসপাতালে, স্কুলে, জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্রে। বাড়িঘর ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আশ্চর্য যে কোথাও কোনো বিকার নেই। এই শিশুহত্যা, নারীহত্যা বিশ্ববিবেককে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারছে বলে তো মনে হচ্ছে না।
আমেরিকার একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে, ইস্ট ওয়েস্ট সেন্টার। আমি একবার তাদের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলাম দিন পনেরোর জন্য। সেখানে আলোচনা হচ্ছিল, সন্ত্রাস কী? তাতে আমরা কয়েকজন মোটামুটিভাবে এই রকম একটা সংজ্ঞা দাঁড় করাতে পেরেছিলাম, কোনো একটা উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য, কোনো দাবি-দাওয়া আদায় বা জানান দেওয়ার জন্য, সংশ্লিষ্ট নয়, এমন মানুষ মারা, কে মারা যাবে তার পরোয়া না করেই হামলা করা—এটাই হলো সন্ত্রাস। ১১ সেপ্টেম্বরের টুইন টাওয়ারে হামলায় যারা মারা গিয়েছে, তারা নিরস্ত্র বেসামরিক সাধারণ মানুষ। এটা সন্ত্রাসী হামলা। কোনো একটা রেলস্টেশনে বোমা ফাটানো, এটা সন্ত্রাসী কাজ।
আজকে আমার মনে সেই সংজ্ঞাটা ঘুরেফিরে বাজছে। যে ফিলিস্তিনি শিশুটা মায়ের কোলে ঘুমুচ্ছে, যে শিশুরা রাস্তায় বা সৈকতে দৌড়ঝাঁপ করছে, তার সঙ্গে সন্ত্রাস, সন্ত্রাসী, রাজনীতি, সীমান্ত, দল, মূল্যবোধের সম্পর্ক কোথায়? একজনকে নিরস্ত করতে গিয়ে ১৩২৮ জন মানুষ মেরে ফেলা হলো, স্কুল-হাসপাতাল-জাতিসংঘ আশ্রয়কেন্দ্র-টেলিভিশন কেন্দ্রে বোমা-গোলা ছোড়া, এটা কি তাহলে সন্ত্রাস নয়?
তাহলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যাঁরা লড়াই করছেন, যাঁরা সন্ত্রাসমুক্ত পৃথিবী গড়বেন বলে ছারখার করলেন ইরাক, আফগানিস্তান, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে তছনছ করলেন মধ্যপ্রাচ্যের একটার পর একটা দেশ, আর পাহারা দিয়ে রাখছেন মধ্যপ্রাচ্যেরই আমির-ওমরাহতন্ত্র, তারা এখন কোথায়?
আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি টেলিভিশনের প্রকাশ্য সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলিদের নিজেদের রক্ষা করার জন্য যেকোনো কিছু করার অধিকারকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু তিনি একটা ফোন ধরেছিলেন অফ দ্য রেকর্ড। তিনি জানতেন না ক্যামেরা খোলা আছে। তিনি গাজায় পরিচালিত ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞকে বলে ফেলেন, ‘ইটস আ হেল অব এ পিনপয়েন্ট অপারেশন।’ তিনি এও বলেন, তাঁর এখনই ওই এলাকায় চলে যাওয়া উচিত।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, ঘুমন্ত শিশুদের ওপর হামলার চেয়ে লজ্জাজনক আর কিছুই হতে পারে না। প্রেসিডেন্ট ওবামাও নাকি গাজায় ক্রমবর্ধমান নারী-শিশু-সাধারণ মানুষের মৃত্যুতে খুবই উদ্বিগ্ন। তা সত্ত্বেও এঁরা কেউই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটা কড়া বিবৃতিও দিতে পারেন না। রূপকথার গল্পের বাঁদরের কলজে যেমন গাছের মগডালে বাঁধা থাকে, তেমনি মনে হয়, এদের কোনো একটা স্বার্থ ইসরায়েলিদের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। আল-জাজিরা টেলিভিশনেই দেখলাম, ইসরায়েলি সংহতির সভা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। কর্তারা সেখানে গিয়ে সংহতি জানাচ্ছেন। ওবামা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে, এটা প্রমাণিত হলে ওবামা নিজেই ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না।
আমাদের কিছুই করার নেই, তাই আমরা প্রতিবাদ করি। ফেসবুকে হ্যাশট্যাগ দিয়ে গাজা সমর্থন করি। কিন্তু তার দ্বারা ফিলিস্তিনি দুধের শিশুর রক্তাক্ত হওয়া আমরা ঠেকাতে পারি না। শুধু আমরা এটা বুঝি, বিশ্বশান্তির জন্যই দরকার ফিলিস্তিনিদের জন্য একটা স্বাধীন আবাসভূমি। যেকোনো স্বাধীনতার আন্দোলনই এক পক্ষের জন্য মুক্তির আন্দোলন, আরেক পক্ষের চোখে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিরা তাদের মুক্তির জন্য লড়ছে। আর ইসরায়েল তাদের নাগরিকদের শান্তি ও নিরাপত্তার
জন্য জিরো টলারেন্স প্রদর্শন করে চলেছে। একটার পর একটা যুদ্ধ হয়েছে। ইসরায়েল নিজেদের এলাকা বাড়িয়ে নিয়েছে।
ইসরায়েল ইরানে বিমান পাঠিয়ে সম্ভাব্য পারমাণবিক বোমার কারখানা বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে।
ছোট ছোট কবরে ছোট ছোট শরীরগুলোকে শোয়ানো হচ্ছে। সেই শিশুদের যাদের নিজেদের কোনো দোষ নেই, যারা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য ভুগছে না। এই পৃথিবীতে এত অবিচার কেন? রবীন্দ্রনাথের মতো বলতে হচ্ছে, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.