বেবী মওদুদ আছে, থাকবে by মালেকা বেগম

বেবী মওদুদ (১৯৪৮-২০১৪) (আফরোজা নাহার মাহফুজা খাতুন) দীর্ঘ সময় ধরে তীব্র রোগযন্ত্রণা পেয়ে আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছে ২৫ জুলাই ২০১৪। তবু বলতে চাই, বেবী আছে, বেবী থাকবে; তার নানাবিধ কর্মকাণ্ডের ইতিবাচক উদ্যোগ-উদ্যমের সফলতার ইতিহাসে তার নাম বাদ পড়বে না।
বেবীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার প্রথম সূত্রপাত একটি চিঠির মাধ্যমে। ১৯৬৬-৬৭ সালে আমি যখন ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভানেত্রী, তখন সুদূর রাওয়ালপিন্ডি থেকে (স্মৃতিতে যদি ভুল না হয়ে থাকে) মাহফুজা খাতুন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি এসেছিল ছাত্র ইউনিয়নের ঠিকানায়, আমার নামে। প্রবল আকাঙ্ক্ষায় চিঠির কালো হরফগুলোকে বেবী রক্তিম করে তুলেছিল ভাষার আগুনছটায়! ঢাকায় আসবে শিগগিরই, যোগ দেবে ছাত্র ইউনিয়নে, ভর্তি হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইত্যাদি তথ্যে ঠাসা ছিল সেই চিঠি। রক্তিম ভালোবাসা জানিয়েছিল। অটুট ছিল এত বছর ধরে সেই ভালোবাসা, অটুট থাকবে সেই ভালোবাসা।
সাক্ষাতে যখন পরিচয় হলো নিবিড়, জানলাম বাংলা সাহিত্যচর্চায়, সংগ্রামমুখর বিপ্লবী ধ্যানধারণায় সে অগ্রগামী দলের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। তার বাবা আবদুল মওদুদ বিচারপতি ছিলেন। বাবার মওদুদ নামটি নিজের নামের সঙ্গে ব্যবহার করতে চায়নি, যদি কেউ সুবিধাভোগী মনে করে। স্বামী হাসান আলীর নামও যুক্ত করেনি। কিন্তু হঠাৎ করেই বাবার নাম যুক্ত করে ‘বেবী মওদুদ’ নামে সে আত্মপ্রকাশ করেছে। এসব তার একান্ত ব্যক্তিগত হলেও আত্মমগ্ন হয়ে এ বিষয়েও কিছু একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিল। সেসব একান্ত ব্যক্তিগত। থাক সে কথা।
বেবী ছাত্র ইউনিয়নের সবার প্রিয় হয়ে ছিল। বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল, ১৯৬৭-৬৮ সালে রোকেয়া হল ছাত্রী সংসদের সদস্য ছিল। আমি সেই ছাত্রী সংসদের সহসভানেত্রী ছিলাম। মনে পড়ে বিভিন্ন টুকরো টুকরো ঘটনা। উৎফুল্ল তারুণ্যে বেবী সব রকমের কাজে অগ্রগামী ছিল। লেখালেখি, লিফলেটের বক্তব্য তৈরি, ম্যাগাজিন প্রকাশের কাজ, রচনা প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা—এ ধরনের সব কাজে ওর ছিল প্রচণ্ড উৎসাহ।
সে সময়টা ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখার যুগ। আন্দোলন-সংগ্রামের চড়াই-উতরাই পথে চলছিলাম ছাত্রছাত্রীরা নিজ নিজ সংগঠনের পতাকাতলে। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ ছিলাম সবাই স্বাধীনতার এক দফা দাবির আন্দোলনে। বেবী সেই আন্দোলনে কাজ করত নিজ আনন্দে, নিজ ইচ্ছায়। সংগঠনের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করত না আবার ওর ইচ্ছাবিরুদ্ধ কাজ চাপিয়ে দেওয়াও সম্ভব ছিল না।
মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাই সে ঢাকায় ছিল। নানা রকম কাজে যুক্ত ছিল। প্রথম মহিলা আইনজীবী ও ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচিত সাংসদ মেহেরুন্নেসা খাতুনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে যুদ্ধ-নির্যাতিত মেয়েদের আশ্রয়ের জন্য সম্ভবমতো অল্পস্বল্প কাজ করেছে বেবী। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গরম কাপড়, অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করত। অবরুদ্ধ ঢাকায় যতটুকু সম্ভব ছিল, বেবী ততটুকুই করেছিল। যদিও কখনোই সেই কাজ বাগাড়ম্বর করে প্রচার করেনি।
স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’-এর কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য হয়েছে বেবী। তখন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলাম। মহিলা সমাচার প্রকাশের দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করেছিল সে প্রচার সম্পাদিকা হিসেবে।
বেবীর জীবনসঙ্গী আইনজীবী হাসান আলী ভাই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির রাজনীতি করতেন। তাদের সহজ-সরল সাংসারিক জীবনে দুটি ছেলে যখন হাসিখুশির ফোয়ারা খুলে দিয়েছিল, সেই সময় হঠাৎ হাসান আলী ভাই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে যখন মারা গেলেন, তখন আমাদের হৃদয়ভারাক্রান্ত হয়েছিল। বেবীর আর্ত–চেহারার সেই সব দিনের কথা ভুলতে পারিনি বহুদিন। সাংবাদিকতার পেশায় নিযুক্ত থেকে, মহিলা পরিষদের সাংগঠনিক দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করে, দুই শিশুকে সঠিকভাবে পালন করে বেবী তার জীবনের চলা থামায়নি। সে সময় অনেক কাছে থেকে জেনেছি বেবীর জীবনযন্ত্রণা।
বেবী তার শিশু ছেলে দুটিকে মানুষ করেছে একাধারে বাবা ও মায়ের স্নেহ-মমতা-দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে। কঠিন-কঠোর স্নেহে ছেলেদের সে বলেছে, আজ বাবা নেই, কাল মা থাকবে না, নিজেরা একা চলতে শেখো। স্বনির্ভর হয়েছে অভি আর দীপ্ত। মায়ের বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, পরিচালনায় ওরা দেশ ও আদর্শকে ভালোবাসতে শিখেছে।
বেবীর সঙ্গে আমার নারী আন্দোলনের, মহিলা পরিষদ সংগঠনের সম্পর্ক দীর্ঘ ২২ বছরের। কিন্তু ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা-ভালোবাসার সম্পর্ক অটুট ছিল। তার সুস্থ জীবনের ছুটোছুটি, সাংবাদিকতার কর্মকাণ্ডে ভরপুর সময় পর্যন্ত। অসুস্থতা যখন চরম পর্যায়ে, চেনা-অচেনার জগতে হারিয়ে যাচ্ছিল বেবী, কষ্টে জর্জরিত হয়েছি, সাংসদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার ছিল না। রাজনৈতিক কোনো পদেরও আকাঙ্ক্ষা ছিল না। তবু সে সাংসদ হয়েছিল। আমার সঙ্গে তার মতের অমিল ছিল না। কিন্তু মতান্তর হতো নীরবে। হঠাৎ দেখা, হঠাৎ কথা, হঠাৎ না দেখার দীর্ঘ সময় পার করেছি আমরা। পরস্পর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা অটুট রেখেছিলাম আমরা।
সাংগঠনিক নানা পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বেবী তার সাংবাদিকতার সূত্রে জানা নানা তথ্য দিয়ে আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। কোথায় নির্যাতনের শিকার হয়েছে নারী, কোথায় ফতোয়ার শিকার হয়েছে নারী, যেতে হবে সংগঠন থেকে, মামলা করতে হবে, আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে মেয়েটির—এমনই সব তাড়নায় বেবী আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। সুফিয়া খালাম্মা থেকে শুরু করে সংগঠনের নেতাদের কাছে গিয়ে গিয়ে প্রচারমাধ্যমের গুরুত্ব জানিয়েছে।
সিলেট জেলার কমলগঞ্জের নূরজাহান যখন ফতোয়ার ও ফতোয়াবাজদের পাথর নিক্ষেপে নির্যাতনের শিকার হয়েছে, আত্মহনন করতে বাধ্য করা হয়েছে নূরজাহানকে—বেবী তখন ছুটে এসে জানিয়েছে আমাকে, খালেদা মাহবুবকে নিয়ে ঘটনার কেন্দ্রে গিয়ে থানায় মামলা দেওয়া, স্থানীয় মৌলভীবাজার শাখাকে আন্দোলনে নামানোর সব সাংগঠনিক কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল।
একইভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি গ্রামের একটি শিশু-কিশোরী মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে বাবার বাড়িতে সন্তানবতী হয়ে মর্মান্তিকভাবে পীড়িত হচ্ছিল। স্থানীয় সাংবাদিক খবরটি জাতীয় দৈনিকে দেওয়ার পর বেবী ছুটে এসেছে—ঘটনাস্থলে যেতে হবে, এর প্রতিবাদে রুখে দাঁড়াতে হবে। বেবীর নেতৃত্বে অকুস্থলে গিয়েছিলাম। মেয়েটিকে মহিলা পরিষদের রোকেয়া সদনে সাদরে আশ্রয় দেওয়া হলো। ফুটফুটে কন্যাসন্তান নিয়ে ধর্ষণকারীর বিরুদ্ধে মামলা মোকাবিলা করে সেই মেয়েটি এখন সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মহিলা পরিষদে। তার মেয়েটি উচ্চশিক্ষা নিয়ে স্বনির্ভর হয়েছে। সেসবই ১৯৯০-৯২-এর ঘটনা।
বেবীর সঙ্গে সাংগঠনিকভাবে মহিলা পরিষদের অঙ্গনে সেই আমার শেষ কর্মকাণ্ড। কিন্তু শেষেরও শুরু আছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের বর্তমান স্থায়ী বাসভবনটির জমিটুকু বেবীর উদ্যোগ-উদ্দীপনায় সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছিল খুব সম্ভবত ১৯৮৮–এর দিকে। বেবী তখন ওই বাসভবনের একটি ভাড়াবাড়িতে থাকত। বাড়ির মালিক খালাম্মারা তিন বোন। পৈতৃক বাড়ির অংশীদার এক বোন তার অংশের বাড়িটি বিক্রি করবেন খবর জেনে বেবী আমাকে জানাল, সুফিয়া খালাম্মাকে জানাল যে মহিলা পরিষদের স্থায়ী ঠিকানা প্রয়োজন, নিজস্ব ভবন দরকার। আমরা যেন বাড়িটি কিনে রাখি। সুফিয়া খালাম্মার নির্দেশ পেয়ে বেবী ও আমি সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে কপর্দকহীনভাবে বাড়ির মালিকের কাছে ছোটাছুটি শুরু করেছিলাম। সমাজকল্যাণমূলক কাজে উদ্বুদ্ধ বাড়ির মালিক খালাম্মা বেশ কম মূল্যেই একতলা একটি পুরোনো দালান-জমি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করলেন। আবদুল মোহাইমেন (সাবেক এমপি ও পাইওনিয়ার প্রেসের স্বত্বাধিকারী) ধার দিলেন, ব্যাংক লোন নিয়ে সেই ধার শোধ হলো, মানবাধিকার আন্দোলনের নেত্রী হামিদা হোসেনের প্রাণান্ত চেষ্টায় সংগৃহীত অর্থানুকূল্যে ব্যাংকের ধার শোধ হলো। বাড়িটি বহুতল করার জন্য মহিলা পরিষদের কর্মী, শুভানুধ্যায়ী সবার সাহায্যে অর্থ সংগ্রহ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলো। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এখন নিজ স্থায়ী সুফিয়া কামাল ভবনে বহু প্রজেক্টের কাজ চালাচ্ছে।
বেবীর স্বপ্ন, বেবীর প্রচেষ্টা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ইতিহাসে যেন লিপিবদ্ধ থাকে। সুফিয়া কামাল ভবনের কোনো একটি পরিকল্পনায় বেবী মওদুদের অবদান যেন স্বীকৃতি পায়, সেটাই আমার একান্ত নিবেদন। বেবী আছে, বেবী থাকবে এসব কর্মকাণ্ডের ইতিহাসে উৎকীর্ণ হয়ে।
মালেকা বেগম: অধ্যাপক, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি। প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

No comments

Powered by Blogger.