শব্দের রাজনীতি ও শব্দ বিভ্রাট by রাজীব সরকার

প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক যতীন সরকারের অনবদ্য স্মৃতিকথা ‘পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু-দর্শন’ বইয়ে অসংখ্য তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। একটি ঘটনা পাকিস্তানের জাতির পিতা জিন্নাহর শোকসভাকে কেন্দ্র করে। ময়মনসিংহের সেই শোকসভায় বক্তব্য দিচ্ছিলেন একজন আইনজীবী। তিনি ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। বাংলায় বক্তৃতা দিতে গেলেও তিনি অনেক ইংরেজি ইডিয়মের এমন অনুবাদ করতেন যা শ্রোতাদের মধ্যে বেশ হাস্যরসের সঞ্চার ঘটাত। জিন্নাহর শোকসভায় বক্তৃতা তার জন্য হাস্যরসের বদলে করুণ রস সঞ্চার করল। জিন্নাহ সম্পর্কে দুয়েকটি প্রশংসামূলক বাক্য উচ্চারণের পরই তিনি বলতে লাগলেন, ‘জিন্নাহ ছিলেন একজন ... জিন্নাহ ছিলেন একজন ...। উপযুক্ত বাংলা শব্দটি তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। শব্দ খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘জিন্নাহ ছিলেন একজন দৈত্য।’ আর যায় কোথায়? শ্রোতাদের কে একজন চিৎকার করে উঠল, ‘কী, জিন্নাহকে দৈত্য বলল? এত বড় অপমান? ধর ব্যাটাকে।’
মরহুম ‘জাতির পিতা’র অপমানে বহু শ্রোতাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বক্তাকে ধাওয়া করল। তখন জেলা জজ না আর কে একজন কোনো রকমে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেন এবং এভাবেই তিনি ‘জনতার ক্রোধ’ থেকে সেদিন রক্ষা পান।
ইংরেজি ‘Giant’ শব্দটির বাংলা করে ওই উকিল বক্তা জিন্নাহকে ‘দৈত্য’ আখ্যা দিয়ে সম্মান জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফল হল বিপরীত। এতে সম্মানের বদলে অপমান করা হয়েছে ভেবেই সে-সভার জিন্নাহ ভক্ত শ্রোতারা উত্তেজিত হয়ে উঠে বক্তাকে আক্রমণ করতে গিয়েছিল।
বেচারা আইনজীবী ভদ্রলোক যে ভুলটি করেছিলেন তা বিরল নয়। এ জন্য তাকে খুব একটা দায়ী করা যায় না। শব্দ যদি স্থান কাল ভেদে ভিন্ন অর্থ বহন করে অর্থাৎ বহুগামী আচরণ করে তবে ব্যবহারকারীর আর কী দোষ! তিনি তো নিমিত্ত মাত্র।
শব্দের এ বহুগামিতা বুঝতে না পেরে অনেকেই শব্দের রাজনীতির শিকার হয়। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রোকেয়ার মতো সমাজহিতৈষী মনীষারা সমাজ সংস্কারকরূপে বিখ্যাত। কিন্তু ২০০৭ সালে এ দেশে ১/১১ আগমনের পর সংস্কার শব্দটির অর্থই পাল্টে যায়। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলে যেসব নেতা সংস্কারপন্থী ছিলেন তারা প্রত্যেকেই ‘সংস্কার’-এর খেসারত দিয়েছিলেন। তখন সংস্কারবাদী ও রাজাকার যেন সমার্থক দুটি শব্দে পরিণত হয়েছিল।
রাজাকারের প্রসঙ্গ যেহেতু উঠলই, এর বিবর্তনটুকুও দেখা যাক। ‘রাজাকার’ শব্দের অর্থ স্বেচ্ছাসেবক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ক্লাবে, রাজনৈতিক দলে প্রচুর স্বেচ্ছাসেবক পাওয়া যায়। তাদের ‘রাজাকার’ সম্বোধন করলে তারা খুশি হবেন না নিশ্চয়ই। ১৯৭১ সালে এ শব্দটির অর্থ পাল্টে যায়। একই কথা প্রযোজ্য ‘আলবদর’ ‘আলশামস’ শব্দ দ্বয়ের ক্ষেত্রেও। এ শব্দগুলোও তাদের সতীত্ব হারিয়েছে একই সময়ে বকধার্মিকদের হাতে।
‘সতীত্ব’ কথাটি আমাদের খুব পছন্দের, বিশেষ করে বাঙালি পুরুষের। নিজের স্ত্রীর কাছে এ বস্তুটি তার চাই-ই। সমাজের চোখেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এর পরুষবাচক শব্দ ‘সৎ’-এর অর্থ কিন্তু ভিন্ন। যে অর্থে নারী ‘সতী’ সেই অর্থে পুরুষ ‘সৎ’ না হলেও তাকে সৎলোক বলা যায়। আবার যে অর্থে পুরুষ ‘সৎ’ সেই অর্থে নারী ‘সতী’ হলেও তাকে অসতী বলা যায়। শব্দের এ লৈঙ্গিক রাজনীতির কারণে সংবাদপত্রে মুখরোচক সংবাদ পরিবেশিত হয়- জনৈক পুরুষ নারীঘটিত কেলেংকারিতে জড়িয়ে পড়েছেন। কখনও শুনি না কোনো নারী পুরুষঘটিত কেলেংকারিতে জড়িয়ে পড়েছেন।
শব্দও তাই নারী-পুরুষ চেনে। লিঙ্গ ভেদে শব্দের অর্থ পাল্টে যায়। ধরা যাক সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের কথা। বিনোদন প্রতিবেদক লিখলেন অক্ষয় কুমারের ‘সাহসী’ শট দেখে দর্শক দারুণ বাহ্বা দিয়েছে। এরপর লিখলেন কারিনা কাপুরের ‘সাহসী’ শট দেখে দর্শক আরও বেশি হাততালি দিয়েছে। পার্থক্য বোঝা গেল? স্ট্যান্টম্যান ছাড়াই কোনো ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্যে নায়ক অভিনয় করেছেন। তাই তিনি সাহসী। নায়িকাও সাহসী। তবে স্ট্যান্টম্যান ছাড়ার কারণে নয়, পোশাক ছাড়ার কারণে। নায়িকা যত বেশি বিবসনা হতে পারেন তিনি তত বেশি সাহসী।
তাই শব্দের চালচিত্র আপাতদৃষ্টিতে সরল মনে হলেও এর কোপানলে পড়লে মানুষ বিব্রত হতে বাধ্য। এক ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত অঞ্চলে ত্রাণ বিতরণ করতে গেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। মানুষের দুর্গতির কথা শুনে তিনি বললেন, ‘আমি আপনাদের বাঁশ দেব।’ এ কথা শুনে জনগণ তাকে ধাওয়া করল। বিক্ষুব্ধ জনতাকে কে বোঝাবে যে ভেঙে যাওয়া ঘরবাড়ি নির্মাণের উপকরণ হিসেবে সেই নেতা বাঁশ দেয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন।
শব্দের রাজনীতি বিভ্রান্ত করে দেয় কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরও। ইংরেজি পরীক্ষায় জানতে চাওয়া হয়েছে ‘বৃষ্টি পড়ছে’ বাক্যটির অনুবাদ। এক শিক্ষার্থী লিখল-Brishty is reading. সে ভুল লিখল না শুদ্ধ সেই মীমাংসা কীভাবে হবে?
ইংরেজির প্রসঙ্গ যেহেতু উঠলই তাই এ ভাষার রাজনীতিও বোঝা প্রয়োজন। স্ত্রীর বিরতিহীন গালাগাল থেকে বাঁচার জন্য এক স্বামী কিছুদিন ধরে অজ্ঞাতবাস করছেন। একদিন স্বামী ফোন করে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘Darling, what are you doing?’ স্ত্রীর জবাব, ‘I am dying.’ স্বামী শুনে উৎফুল্ল হলেও বেদনার্ত চিত্তে বললেন, ‘Oh! how I will leave without you?’ স্ত্রী বললেন, ‘Idiot. I am dying my hair.’ বেচারা স্বামী খুব হতাশ হলেন ইংরেজি ভাষার এ দ্বিচারিতা দেখে।
তবে শুধু শব্দকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। অতি ব্যবহারে আমরা অনেক সময় শব্দের তাৎপর্য ও গ্রহণযোগ্যতা দুটিই নষ্ট করে ফেলি। ‘ফুলের মতো পবিত্র’ কথাটি উপমা হিসেবে অসাধারণ। কিন্তু যে কোনো নির্বাচনের আগে ‘অমুক ভাইয়ের চরিত্র, ফুলের মতো পবিত্র’ কথাটির ব্যবহার এত বেশি হয় যে ফুল বা পবিত্র কোনোটির পবিত্রতা আর বজায় থাকে না।
এবার চরিত্রের গভীরে একটু প্রবেশ করা যাক। ‘চরিত্র অমূল্য সম্পদ’- এ কথাটি না শুনে আমরা কেউ স্কুলের গণ্ডি পার হইনি। বিভিন্ন সদগুণের সমাহারকে আমরা চরিত্র বলি। যার মাঝে এ গুণাবলি অনুপস্থিত তিনি চরিত্রহীন। কিন্তু এভাবে চরিত্রের বিচার আমরা করি না। কোনো ব্যক্তি খুন, ডাকাতি, দুর্নীতি, প্রতারণা, নারী নির্যাতন করেও ‘চরিত্রবান’ থাকতে পারেন। শুধু একটি কারণে তিনি ‘চরিত্রহীন’ হয়ে যান। যদি একাধিক নারীর সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকে বা তিনি যদি পরকীয়া প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়েন তবে অন্যসব গুণ থাকলেও তিনি ‘চরিত্রহীন’। আর যদি এক নারীর প্রতি বিশ্বস্ত থেকে অন্যসব দোষকে তিনি ধারণ করেন এরপরও তিনি ‘চরিত্রবান’ থেকে যান আমাদের সমাজে। চরিত্র সম্পর্কে আমাদের এ অদ্ভুত মানসিকতা দেখে প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, ‘বাঙালির চরিত্র শরীরের কয়েক ইঞ্চি জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ।’
চরিত্র শব্দটির আরেক অর্থ ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য। যেমন বস্তুর প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য বোঝাতে চরিত্র কথাটি ব্যবহৃত হয়। এ ক্ষেত্রেও বিপদের অন্ত নেই। ইংরেজি ‘জবষরমরড়হ’ শব্দটির বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে ধর্ম যেমন- ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান। অথচ বাংলা ‘ধর্ম’ শব্দটির অর্থ আরও বিস্মৃত। সেই বিস্মৃতি বুঝতে না পেরে এক ছাত্র পুরো শ্রেণীকক্ষে হাসির রোল বইয়ে দিয়েছিল। শিক্ষক জানতে চেয়েছিলেন ‘আগুনের ধর্ম পোড়ানো’ বাক্যটির ইংরেজী কি। ওই ছাত্রটি তৎক্ষণাৎ জবাব দিয়েছিল-Burning is the religion of fire.
শব্দের অর্থ বুঝতে আমরা ভুল করলেও আগুন সেই ভুল করে না। তার কাজ সে করবেই। কবিগুরু বলেছিলেন, ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো।’ তার কথা আমরা রেখেছি। আগুন জ্বালিয়েছে, জ্বালছি, ভবিষ্যতেও জ্বালব- তবে ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে নয়। আগুন জ্বালিয়েছি পোশাক শিল্পের কারখানায়, গরিব বস্তিতে, সংখ্যালঘুর উপাসনালয়ে ও বাসস্থানে।
রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা সর্বত্রগামী হলেও ক্রীড়াক্ষেত্রে তার কোনো আগ্রহের কথা আমরা কখনও শুনিনি। শব্দের রাজনীতি তার সেই অপূর্ণতা ঘুচিয়ে দিয়েছে। এক চাকরির ইন্টারভিউয়ে এক প্রার্থী বলেছিল, রবীন্দ্রনাথ ফুটবল খেলতে ভালোবাসেন। তাই বলেছেন, ‘মোরে বল দাও, দাও প্রাণে শক্তি।’ কারণ গায়ে শক্তি না থাকলে শুধু ফুটবল থাকলে কাজ হবে না। তাই ফুটবলের পাশাপাশি তিনি শক্তিও প্রার্থনা করেছেন। শব্দের রাজনীতি বোঝার জন্য ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ও ব্যবহারিক অর্থের পার্থক্য জানা জরুরি। এক পণ্ডিত তা না জেনে কী বিপদে পড়েছিলেন তা উল্লেখ করে এ প্রসঙ্গে ইতি টানছি।
সেই পণ্ডিত বিশেষ প্রয়োজনে রাতের বেলা একটি ঝোপের দিকে যাচ্ছিলেন। গ্রামের লোকজন তাকে ওখানে যেতে নিষেধ করল, কারণ সেখানে প্রায়ই বাঘে আক্রমণ করে। পণ্ডিত বললেন, “বাঘ আবার কী? মানে ব্যাঘ্র তো? ব্র্যাঘ্র শব্দ তৈরি হয়েছে ‘বি’ উপসর্গ আর ‘আ’ উপসর্গের পর ‘ঘ্রা’ ধাতুর সঙ্গে ‘অ’ প্রত্যয় যোগ করে। (বি-আ-ঘ্রা+অ)। ‘ঘ্রা’ ধাতুর অর্থ ‘ঘ্রাণ নেয়া’। তাই ‘ব্যাঘ্র’ মানে ‘যে বিশেষ করে ঘ্রাণ নেয়’। ওই ব্যাঘ্র আমাকে কী করবে?”
এ সাহসে ভর করে পণ্ডিত ঝোপের ভেতর ঢুকলেন। হঠাৎ এক ব্যাঘ্র এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। চিৎকার করে পণ্ডিত বললেন, ‘ওহে ব্যাঘ্র, এ তুমি কি করছ? তোমার তো কেবল ঘ্রাণ নেয়ার কথা, ভক্ষণ করছ কেন আমাকে? তুমি তো পাণিনির ব্যাকরণের নিয়ম লঙ্ঘন করছ?’
ব্যাঘ্র পাণিনির নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পণ্ডিতের শুধু ঘ্রাণ নয়, প্রাণ নিয়ে ছাড়ল।

No comments

Powered by Blogger.