গুজরাটের মোদি আর দিল্লির মোদি এক নয় by মাহফুজ মিশু

এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। প্রতিবেশী ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফর নিয়ে এমনটা বললে কি খুব বেশি বলা হয়? সত্যিই বাংলাদেশকে জয় করেছেন ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপির এই প্রভাবশালী নেতা। ১৬ মে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার দিন কিংবা তার কিছু আগে-পরে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে দুটি ধারণা প্রচলিত ছিল। প্রথমটি হল- নরেন্দ্র মোদির দল ক্ষমতায় এলে ভাটা পড়বে ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্কে। এমন ধারণার ভিত্তিও ছিল অবশ্য। নির্বাচনী প্রচারণায় ভারতে অবৈধভাবে থাকা বাংলাদেশীদের নিয়ে নরেন্দ্র মোদি আপত্তিকর ও অপমানজনক মন্তব্য করেছিলেন। তিনি সে সময় দিনক্ষণও ঠিক করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ১৬ মে’র পর অবৈধ অভিবাসীদের ব্যাগ গোছাতে হবে। আতংকের আর একটা বড় কারণ ছিল গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদির উস্কানির অভিযোগ। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের কংগ্রেসের ‘বাড়তি খাতির’ আছে- এমন ধারণাও মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। কাজেই কংগ্রেসের এ ভরাডুবির পর আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে চাপে পড়বে এমন আশংকাও ছিল অনেকের। নির্বাচন বর্জন করা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি নেতারা তো বলেই ফেলেছিলেন, বিজেপির বিজয়ে সরকারের পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে। এরকম নানা শংকার মধ্যেই যখন শপথ অনুষ্ঠানে আজীবনের শত্র“ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে হাজির করতে পারলেন নরেন্দ্র মোদি, এলেন শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মাহেন্দ্র রাজাপাকসেও, তখন কিন্তু নেতা কিংবা ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশের সরকারপ্রধান হিসেবে আঞ্চলিক রাজনীতিতে তার দূরদর্শিতা এবং প্রজ্ঞা নিয়ে আর প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকে না। সরকার গঠনেও চমক দেখিয়েছেন মোদি। বিশেষ করে দলে তার বিরোধী বলে পরিচিত অনেকেই মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন। যেমন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের কথাই ধরা যাক। নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হওয়ার অন্যতম বিরোধিতাকারী ছিলেন তিনি। সুষমা অবশ্য বাংলাদেশকে আগে থেকেই ভালো করে চেনেন, জানেন। এর আগে আরও কয়েকবার ঢাকা এসেছেন তিনি। কখনও মন্ত্রী হিসেবে, কখনও লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সুষমা স্বরাজ প্রথম সফরের গন্তব্য যখন নির্ধারণ করলেন বাংলাদেশ, তখনই বোঝা গিয়েছিল ঢাকাকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে বিজেপি সরকার।
সুষমার ঢাকা সফরকে তাই বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ। সুষমার সফর কাগজে-কলমে ছিল তিনদিনের। বাস্তবিক অর্থে তিনি সময় পেয়েছেন দেড় দিনেরও কম। কিন্তু এ পুরোটা সময় সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করেছেন পরিপক্ব এই রাজনীতিবিদ। জানাই ছিল, শুভেচ্ছা সফর এটি। মূলত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পাঠানো দিল্লি সফরের আমন্ত্রণপত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিতে তার এ সফর। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক তো আছেই। এসবের বাইরে খুব বেশি কিছু করার অঙ্গীকার যেমন ছিল না ভারত সরকারের, তেমনি কোনো চুক্তি বা সমঝোতা যে হচ্ছে না, তাও জানা ছিল বাংলাদেশের।
তারপরও প্রত্যাশা ছিল, তিস্তার পানিবণ্টন, স্থলসীমা চুক্তি কিংবা সীমান্ত উত্তেজনার মতো দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে। জানা যাবে, বোঝা যাবে বিজেপি সরকারের মনোভাব। মনে রাখা ভালো, কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকাকালে প্রধানমন্ত্রী ডক্টর মনমোহন সিং এবং নয়াদিল্লির অনেক আশ্বাসের পরও তিস্তার পানিবণ্টন ও স্থলসীমা নিয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। নয়াদিল্লি বারবার জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর আপত্তির কারণে তিস্তা চুক্তি সই করা সম্ভব হয়নি। আর সে সময় লোকসভায় ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় স্থলসীমা চুক্তি নিয়েও জটিলতা মেটেনি। এখন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় বিজেপি। কাজেই কোনো বিল বা প্রস্তাব সংসদে পাস করাতে অন্য কারও ওপর নির্ভরশীল নয় নরেন্দ্র মোদির সরকার। আবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে সম্পর্ক দিনকে দিন ভালো হচ্ছে ক্ষমতাসীন বিজেপির। যেমন ঢাকা আসার আগের দিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ যে মমতা ব্যানার্জীকে ফোন করেছেন, তাকে ‘অপ্রত্যাশিত’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। মমতা জানিয়েছেন, এ সৌজন্যটুকু গেল কংগ্রেস সরকার তার সঙ্গে দেখায়নি। মমতা ব্যানার্জী স্পষ্ট করে বলেছেন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সমস্যা জিইয়ে রাখার পক্ষে নন তিনি। এসব ঘটনা নিশ্চয়ই এই ইঙ্গিত দেয় যে, তিস্তার পানিবণ্টন আর স্থলসীমা চুক্তি নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির টানাপোড়েন কেটে যাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে নিশ্চয়ই ভারতের এই মনোভাব স্পষ্ট করেছেন সুষমা স্বরাজ। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ আয়োজিত বক্তৃতায় সুষমা স্পষ্ট করে তিনটি ইস্যুর কথা বলেছেন। তিস্তার পানিবণ্টন, স্থলসীমা চুক্তি সই আর নিরাপদ সীমান্ত। এসব বিষয়ে সমাধান চায় তার সরকার। যদিও কবে নাগাদ এসব চুক্তি হতে পারে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা মেলেনি। অবশ্য একই অনুষ্ঠানে নিজ দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার উদাহরণ টেনে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণে তার দেশের সহযোগিতার মনোভাবও স্পস্ট করেছেন সুষমা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে যে সম্মান আর আন্তরিকতা পেয়েছেন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তা তাকে মনে রাখতে হবে অনেকদিন। নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনাকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে যে পত্রটি লিখেছেন, সেটি দুই পাতার। কাজেই এটিকে নেহায়েত ‘কূটনৈতিক চিঠি’ ভাবার সুযোগ নেই। সেই চিঠিতে শেখ হাসিনা সরকারের প্রশংসার পাশাপাশি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন মোদি। খুব শিগগিরই হয়তো শীর্ষ দুই নেতার বৈঠক হতে পারে। যৌক্তিকভাবে আশা করা যেতে পারে, অচিরেই দৃশ্যমান হবে ভারত সরকারের ইতিবাচক মনোভাব, সই হবে আলোচিত দুই চুক্তি। বিএনপিবিহীন পাঁচ জানুয়ারি নির্বাচনের পর গঠিত সরকার নিয়ে পশ্চিমাদের মনোভাব জানা। এ সরকারকে অবৈধ আখ্যা দেয়া বিএনপিও সেই নির্বাচন নিয়ে সোচ্চার বিদেশীদের দরবারে। দ্রুত নতুন ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন চায় দলটি। নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও সে রকম অবস্থানই নিয়েছিল। যদিও পরে আর এ নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায়নি পশ্চিমারা। এরকম বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান ও চীন সফর এবং কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফর রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। শুরুতে খানিকটা অনিশ্চয়তা থাকলেও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রায় আধাঘণ্টার বৈঠক হয় সুষমা স্বরাজের। হোটেল লবিতে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা নিয়ে খানিকটা বিতর্ক হলেও ভারতের মনোভাব ভালোভাবেই জেনেছেন বেগম জিয়া। দেশে বর্তমানে গণতন্ত্র নেই- এরকম মনোভাব ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে বিএনপি। আর বিশেষ কোনো দল বা ব্যক্তি নয়, ভারত বাংলাদেশকে গুরুত্ব দেয় বলে বিএনপিকে জানিয়েছেন সুষমা স্বরাজ। এর বাইরে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের সঙ্গে জাতীয় সংসদ ভবনে গিয়ে দেখা করেছেন তিনি। বিরোধীদলীয় নেতাও স্পষ্ট করেছেন, পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচন কিংবা বর্তমান সরকার প্রসঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে। এসব কথার সত্যতা মেলে বিমানবন্দরে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবর উদ্দিনের ব্রিফিংয়ে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকে, তাহলে ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্ক অটুট থাকবে কি-না- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক আগের মতোই অব্যাহত থাকবে। অভ্যন্তরীণ কোনো ঝামেলা থাকলে সেটি সমাধানের দায়িত্ব এ দেশের মানুষের।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এ সফরের অর্জন কী? পালাটানা থেকে আরও ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ, ঢাকা-গৌহাটি বাস সার্ভিস, চারটি নতুন সীমান্ত হাট, শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবন নির্মাণ কিংবা ১৩ বছরের নিচের ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সী বাংলাদেশীদের জন্য পাঁচ বছর মেয়াদি মাল্টিপল ভিসা, যৌথ নদী কমিশন ও পরামর্শক গ্র“পের বৈঠক নিয়মিত করার ব্যাপারে ঐকমত্য ছাড়াও আরও অর্জন কিন্তু আছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি- দু’দলের নেতারাই বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে, এ দেশের মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায় নরেন্দ্র মোদির সরকারও। একই সঙ্গে তার সরকারের মনোভাবও বোঝা গেছে বলে দাবি তাদের। প্রশ্ন উঠেছিল, নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিদেশনীতি কি ভারতীয় আমলারা ঠিক করবে নাকি রাজনীতিকরা? বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, বিশাল আর বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসা বিজেপি সরকারের পররাষ্ট্র নীতির নির্ধারক রাজনীতিকরাই। তাই যদি হয়, তবে সেটি নিঃসন্দেহে ভালো বাংলাদেশের জন্যও। কারণ গঙ্গার পানি চুক্তি, ঢাকা-কলকাতা বাস সার্ভিস চালুর মতো দ্বিপক্ষীয় ইস্যুর নিরসন কিন্তু বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়েই হয়েছে। আর একটা কথা মনে রাখা দরকার। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আর রাইসিনা হিলের বাসিন্দা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে এক করে দেখলে হবে না। মাথায় রাখতে হবে, নরেন্দ্র মোদি কেবল ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েই থাকতে চান না, কৌশলগত কারণেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী আর ক্ষমতাধর রাজনীতিক হওয়ার দৌড়েও প্রথম হতে চান। এত কিছু পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে অসন্তুষ্ট করার ঝুঁকি নিশ্চয়ই নিতে চাইবেন না নরেন্দ্র মোদি। আর তারই শুভ সূচনা করে গেলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। সামনের পাঁচটি বছর তাই নতুন মাত্রা পাবে ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্ক- এমন প্রত্যাশা করা যেতেই পারে।
মাহফুজ মিশু : সংবাদকর্মী
mishubdf@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.