রাশিয়া ও জর্জিয়া- গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের রুপালি শিয়াল by নিনা খ্রুশ্চভা

ক্ষমতায় থাকাকালে এদুয়ার্দ শেভারদনাদজে ‘রুপালি শিয়াল’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই ব্যক্তি ছিলেন একাধারে সোভিয়েত জর্জিয়ার নেতা, ক্রেমলিনের পলিটব্যুরোর সদস্য ও গর্বাচভের সংস্কারপন্থী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তারপর তিনি ছিলেন সোভিয়েত-উত্তর জামানায় জর্জিয়ার পশ্চিমপন্থী প্রেসিডেন্ট। তখন আবার তিনি গর্বাচভের বিরোধী হয়ে ওঠেন। তিনি নিজেকে নায়ক মনে করতেন, যিনি জর্জিয়াকে রাশিয়ার বজ্রকঠিন গেরো থেকে বের করে আনেন। একই সঙ্গে তিনি সে দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক। আহা, একই অঙ্গে কত রূপ।

>>এদুয়ার্দ শেভারদনাদজে, জর্জিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট
জীবনের শেষ দিকে এই শেভারদনাদজে জর্জিয়াতেই অচ্ছুত হয়ে পড়েন, পশ্চিম ও রাশিয়াতেও তাঁর একই হাল হয়। তাঁকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের একজন কারিগর হিসেবেই রাশিয়ায় গণ্য করা হতো। ২০০৩ সালে রোজ বিপ্লবে তাঁর একসময়ের রাজনৈতিক অনুগ্রহভাজন মিখেইল সাকাশভিলি তাঁকে উৎখাত করার পর লোকে তাঁকে প্রায় ভুলতেই বসেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক শক্তিকে তাঁর ছলনায় ভুলিয়ে ও নিজের অতীতকে কাজে লাগিয়ে তিনি তাদের কাছ থেকে নানা রকম সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হন।

সাকাশভিলি কঠোর মার্কিনপন্থী মানুষ। তিনি অর্থনৈতিক খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনেন, পুলিশের দুর্নীতির বিরুদ্ধেও মাঠে নামেন। যদিও তাঁর বিরুদ্ধেও ঘুষ গ্রহণ ও স্বৈরাচারী আচরণের অভিযোগ আছে। তিনি বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে শেভারদনাদজেকে উৎখাত করে ক্ষমতায় আসেন। তারপর তিনি কিছু পুরোনো সোভিয়েত আমলের কৌশল গ্রহণ করেন: প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভয় দেখানো ও তাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো এবং বিরোধিতাকারীদের জোরপূর্বক ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া। অর্থাৎ, বিরোধীদের দৌড়ের ওপর রাখা।

 জর্জিয়রা বরাবর একটি প্রশ্নই করে আসছে, শেভারদনাদজে কি সত্যিই উৎখাত হয়েছিলেন? ২০০৩ সালের দিকে তিনি এতটাই অজনপ্রিয় হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি আসলে তখন এমন কাউকে খুঁজছিলেন, যার কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিনি অন্তত নিরাপদে বিদায় নিতে পারেন। মানে নিজের অর্থসম্পদ রক্ষা করতে পারেন। নিশ্চিতভাবেই সাকাশভিলি জর্জিয়ার ন্যায়বিচারের প্রতীক হয়ে ওঠেন—তিনি শেভারদনাদজে পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করেন। তিনি প্রেসিডেন্ট থাকাকালে শেভারদনাদজের ১৫ মিলিয়ন ডলার পুনরুদ্ধার করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করেন। কিন্তু সাকাশভিলির সরকার শেভারদনাদজে ও তাঁর পরিবারের কোনো সদস্যের গায়ে একটি টোকাও দেননি।

বোঝা যায়, শেভারদনাদজের রাজনৈতিক প্রভাব নেহাত কম ছিল না। তিনি সারা জীবনই দ্বৈত নীতি অনুসরণ করেছেন। কখনো কখনো তিনি পদত্যাগের হুমকি দিয়েছেন, সেটা করেছেন নিজের ক্ষমতা বজায় রাখার স্বার্থে। অথবা হত্যার পরিকল্পনা করে শত্রু বধের হুংকার দিয়েছেন, শুধু নিজের জীবন রক্ষার স্বার্থে। ১৯৭০-এর দশকে ক্রেমলিনের প্রতি তাঁর শর্তহীন আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য তিনি ব্রেজনেভকে তেল দিতেন।

১৯৯৯ সালে নিউইয়র্কে বার্লিন দেয়াল পতনের দশম বার্ষিকীর উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে আমি নিজ কানে শুনেছি, শেভারদনাদজে বলছেন, বিশ শতকে জর্জিয়ায় দুজন ঐতিহাসিক চরিত্রের জন্ম হয়েছে: একজন লৌহ পর্দা টাঙিয়েছিলেন (জোসেফ স্তালিন), আরেকজন সেটা নামিয়েছেন—মানে তিনি নিজে।

হ্যাঁ, শেভারদনাদজের রাজনৈতিক দক্ষতার সঙ্গে আরেকজন মহান ককেশীয় সোভিয়েত রাজনীতিকের মিল আছে, তিনি হচ্ছেন আর্মেনিয়ার আনাসতাস মিকোইয়ান। এই ব্যক্তি স্তালিনের বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন, স্তালিনের আস্থাভাজন ছিলেন তিনি। আর পরে খ্রুশ্চভের আস্থাভাজন স্তালিনবিরোধী এবং উপপ্রধানমন্ত্রী। মিকোইয়ান সম্বন্ধে একটি কৌতুক প্রচলিত আছে। তিনি নাকি একদিন বৃষ্টির মধ্যে ক্রেমলিন থেকে বেরোনোর সময় তাঁর এক সহকর্মীর ছাতা ভাগাভাগি করতে অনিচ্ছা জানান। তিনি বলেন,  ‘না, ঠিক আছে, আমি বৃষ্টির ফোঁটাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে হেঁটে যাব।’

একইভাবে, শেভারদনাদজে ১৯৮০-এর দশকে জর্জিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন সোভিয়েত আমলের বিরোধিতা করে। তার পরেই তিনি গর্বাচভের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি পশ্চিমা নেতাদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন। একই সঙ্গে তিনি পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনও নিজ চোখে দেখেন। তারপর তিনি ১৯৯০ সালে পদত্যাগ করেন। কারণ, রাশিয়া নাকি গর্বাচভের অধীনে আবারও স্বৈরতন্ত্রের খপ্পরে পড়েছে। গণতন্ত্রের অভিভাবক হিসেবে দাঁড়ানোর কারণে তিনি স্বাধীন জর্জিয়ার প্রেসিডেন্ট হন, এমন সময় যখন দেশটি গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছিল। তিনি ১১ বছর সে পদে ছিলেন।

শেভারদনাদজে কি কখনো সৎ ছিলেন? তিনি কি একজন গণতন্ত্রী না স্বৈরশাসক? বাস্তবতা হচ্ছে, তিনি উভয়ই ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গর্বাচভের আমলের কমিউনিজম সংস্কারের দিন ঘনিয়ে আসে। বরিস ইয়েলৎসিন ও শেভারদনাদজের মতো মানুষেরা ব্রেজনেভের আমলের কট্টরপন্থীদের চেয়ে আলাদা। এই ব্রেজনেভপন্থীরাই অচেতনভাবে সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা করেন, গণতন্ত্রে উত্তরণের যাত্রাও এর মাধ্যমে শুরু হয়।

আজ প্রতিদিনই ভ্লাদিমির পুতিনের দুর্নীতিগ্রস্ত ও কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের রূপ খোলতাই হচ্ছে, ফলে গণতন্ত্রে উত্তরণ হতে এখনো ঢের বাকি। তারপরও কিছু ভালো খবর আছে। গত বছর বৈধ ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে জর্জিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন গিওর্গি মারগভেলাশভিলি। এ বছরের গ্রীষ্মের শুরুতে দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এটা পশ্চিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের লক্ষণ। শেভারদনাদজে তাঁর দশকব্যাপী শাসনের সময় বেশ কিছু ধূর্ত ও সাহসী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন, রাজনৈতিক মারপ্যাচে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন—সে কারণেই এত সব সম্ভব হয়েছে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

নিনা খ্রুশ্চভা: নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড পলিসি ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো।

No comments

Powered by Blogger.