তিয়েনআনমেনের ঝাপটা by মিনঝিন পি

এখন এটা কল্পনা করা কঠিন, কিন্তু ২৫ বছর আগে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি দেশজুড়ে গণতন্ত্রপন্থীদের আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হতে বসেছিল৷ দেং জিয়াং পিংয়ের ইস্পাতকঠিন মনোবল ও পিপলস লিবারেশন আর্মির ট্যাংকের বদৌলতে সামরিক আইন জারির মাধ্যমে কয়েক শ বেসামরিক মানুষের জীবনের বিনিময়ে সে যাত্রায় কমিউনিস্ট পার্টির সরকার পার পেয়ে যায়৷
আগামী জুনের ৪ তারিখে তিয়েনআনমেন স্কয়ারের আন্দোলনের ২৫ বছর পূর্তি হবে৷ এ প্রেক্ষাপটে দুটি প্রশ্ন সামনে এসে যায়: একটি হচ্ছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি কীভাবে গত ২৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারল আর দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো, আগামী ২৫ বছর কি তারা ক্ষমতায় থাকতে পারবে?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর বেশ সোজাসাপটা; রাজনৈতিকভাবে খাপ খাওয়ানো, সুচতুরভাবে জনমত নিয়ন্ত্রণ ও বার কয়েক ভাগ্যের সহায়তায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় রয়ে যায়৷ এর মাধ্যমে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী শক্তিগুলোকে দমন করতে সক্ষম হয়৷
নিশ্চিতভাবেই গুরুতর কিছু ভুল হয়েছে৷ দেং যেসব উদারীকরণ শুরু করেছিলেন, রক্ষণশীল চীনা নেতারা তার রাশ টেনে ধরেছিলেন৷ ফলে, চীনা অর্থনীতি মন্দাক্রান্ত হয়৷ আর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেও আতঙ্ক সৃষ্টি করে৷
কিন্তু দেং আবারও পার্টিকে রক্ষা করতে সক্ষম হন৷ নিজের সব শক্তি ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে জড়ো করে ৮৭ বছর বয়সী এই নেতা চীনের অর্থনীতিকে বাজারমুখী করে তোলেন৷ এতে যে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটে যায়, তা এক অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধির দিকে ধাবিত হয়৷ ফলে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ওপর মানুষের আস্থা বেড়ে যায়৷

দেং ও তাঁর উত্তরসূিররা এই ধারা অব্যাহত রাখতে চীনা নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা উপভোগ করার সুযোগ করে দেন, যেটা পরবর্তীকালে ভোগবাদ ও গণবিনোদনের সংস্কৃতির জন্ম দেয়৷ এই ‘রুটি ও সার্কাসের’ নতুন দুনিয়ায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে বিরোধী মত দমন করা সহজ হয়৷ সুকৌশলে চীনা জাতীয়তাবাদের ধুয়া তোলা হয়, অহেতুক বিদেশভীতিও সমাজে সৃষ্টি হয়৷ ফলে তাঁদের কাজ সহজ হয়৷
এমনকি নিপীড়নের মাধ্যমে এই জামানার ক্ষমতা সংহত হলেও এর একটি গা-সহা রূপ দাঁড়িয়ে যায়৷ চীনের নব্য প্রাপ্ত সম্পদ দিয়ে সে দেশের নেতারা বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাধুনিক ‘ইন্টারনেট ফায়ারওয়াল’ গড়ে তুলতে সক্ষম হন৷ আর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাও সবচেয়ে কার্যকর যন্ত্রপাতি দিয়ে ঢেলে সাজানো সম্ভব হয়৷
চীনে একটি ক্ষুদ্র ও সহনশীল বিরোধী সম্প্রদায় আছে৷ এদের মোকাবিলা করতে দেশটি ‘শিরশ্ছেদ’-এর নীতি গ্রহণ করেছে৷ অন্য কথায়, সরকার সব হুমকিই নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে, বিরোধিতাকারী যত বড়ই হোক না কেন, তাকে নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে৷ লিও শিয়াওবা ২০১০ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেও বৈশ্বিক মত উপেক্ষা করে তাঁকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে৷
এই পথ মানববিদ্বেষী হলেও তা কাজে দিয়েছে৷ তবে কিছু গুরুতর ক্ষেত্রে পার্টি ভাগ্যবান না হলে এই সফলতা আসত না৷ নতুনদের জ্ঞাতার্থে বলছি, ১৯৯২ সাল পরবর্তী চীনের সংস্কার কর্মসূচি বিশ্বায়নের বাড়বাড়ন্তের কারণে ফুলেফেঁপে ওঠে৷ এর ফলে চীনের বিপুল পরিমাণ পুঁজির (১৯৯২ সাল থেকে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ হিসেবে এক ট্রিলিয়ন ডলার) অনুপ্রবেশ ঘটে৷ নতুন নতুন প্রযুক্তি ও পশ্চিমা বাজারে বাধাহীন প্রবেশ ঘটে চীনের৷ ফলে, চীন সারা দুনিয়ার ‘ওয়ার্কশপ’-এ পরিণত হয়, ২০০৭ সালের মধ্যে তার রপ্তানি ১০ গুণ বেড়ে যায়৷
আরেকটি ব্যাপার চীনের খুব কাজে দেয়, সেটা হচ্ছে তার জনসংখ্যার তথাকথিত অনুপাত৷ সে সময় শিশু ও বৃদ্ধদের তুলনায় কর্মক্ষম শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যায়৷ এতে চীন বিপুল পরিমাণ স্বল্পমজুরির শ্রমিক পেয়ে যায় আর পেনশন ও স্বাস্থ্যসেবায় খরচও কমে যায়৷ এর সুফল চীনের অর্থনীতি পাচ্ছে৷
যেসব কারণে তিয়েনআনমেন স্কয়ারের ঘটনার পর চীনের ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যার অনেকগুলোরই এখন আর অস্তিত্ব নেই বা সেগুলো বিলীন হওয়ার পথে৷ বাস্তব কারণেই বাজারমুখী সংস্কারের মৃত্যু ঘটেছে৷ সরকারি কর্মকর্তা, তাঁদের পরিবার ও তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যবসায়ীরা সেখানে এক রাজত্ব তৈরি করেছেন৷ চীনকে তাঁরা উপনিবেশ বানিয়ে ফেলেছেন, এমন কোনো সংস্কার তাঁরা হতে দেবেন না, যার ফলে তাঁদের সুযোগ-সুবিধা কমে যেতে পারে৷
উপরন্তু, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এখন আর সমৃদ্ধির কথা বলে ভোট টানতে পারবে না৷ ব্যাপক দুর্নীতি, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, পরিবেশ বিপর্যয় সাধারণ মানুষের (বিশেষত মধ্যবিত্ত, যাঁরা একসময় সংস্কারের স্বপ্ন দেখতেন) কাঁধে দৈত্যের মতো উঠে বসেছে৷ ফলে, তাঁরা ক্রমেই নির্মোহ হয়ে পড়ছেন৷
বুড়ো মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে৷ ফলে, জনসংখ্যার অনুপাতের যে সুবিধা তাঁরা ভোগ করতেন, সেটা আর নেই বললেই চলে৷ চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক, বিশ্ববাজারে ১১ শতাংশই হচ্ছে তাদের অবদান৷ ফলে, আগামী দিনে রপ্তানি বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই৷
ফলে তিয়েনআনমেন পরবর্তীকালে এখন নিপীড়ন ও জাতীয়তাবাদ ছাড়া চীনের হাতে আর কিছু নেই৷ এ দুটিই পার্টির জীবন রক্ষা করতে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের হাতে প্রধান অস্ত্র৷
শি আরও দুটি হাতিয়ার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন৷ একটি হচ্ছে নজিরবিহীন দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণা, আরেকটি হচ্ছে বাজারমুখী সংস্কার পুনরুজ্জীবিত করা৷ এখন পর্যন্ত তাঁর দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণাই অর্থনৈতিক সংস্কারের চেয়ে বেশি সফল৷
ওপরে ওপরে শির কৌশল জুতসই বলে মনে হয়৷ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা ও গভীর অর্থনৈতিক সংস্কারের কর্মসূচির কারণে চীনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অভিজাতদের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব অনিবার্য৷ প্রশ্ন হচ্ছে, জনগণকে সঙ্গে না নিয়ে তিনি কীভাবে বিরোধিতা মোকাবিলা করবেন৷ জনগণ জড়ো হলে এই একদলীয় শাসন হুমকির মুখে পড়বে৷
১৯৮৯ সালের পর যাঁরা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অপমৃত্যু দেখেছিলেন, পার্টি তাঁদের মিথ্যা প্রমাণ করেছে৷ পার্টি টিকে আছে, এমনকি কোনো হুমকি এলে আগেভাগে তা মোকাবিলা করেছে৷ আরও ২৫ বছর ক্ষমতায় থাকার ক্ষেত্রে তার সামনে প্রতিবন্ধকতাগুলোর তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে৷ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা কম৷
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
মিনঝিন পি: ক্লেয়ারমন্ট ম্যাককেনা কলেজের সরকার বিভাগের অধ্যাপক৷ তিনি একই সঙ্গে জার্মান মার্মাল ফান্ড অব দি ইউনাইটেড স্টেটসের অনাবাসী জ্যেষ্ঠ ফেলো৷

No comments

Powered by Blogger.