দিল্লি হনুজ দূর অস্ত

ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। ফলে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি। প্রতিবেশী ও আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের নির্বাচনের ফলাফল আমাদের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল গণতান্ত্রিক দেশটির নির্বাচন গোটা বিশ্বের কাছে আগ্রহের বিষয়। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর বিজয়ীদের অভিনন্দন জানানো একটি প্রতিষ্ঠিত রেওয়াজ। বিশ্বনেতারা সে রেওয়াজ অনুসারে তা করেছেন। করেছেন আমাদের নেতারাও। তবে এ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় আমাদের নেতারা তাঁদের স্বভাবসিদ্ধ বাড়াবাড়ি করে চলছেন। এসব আলোচনায় তাঁদের পরিমিতি বোধের অনুপস্থিতি পীড়াদায়ক। কারও কারও আলোচনা-সমালোচনা থেকে মনে হতে পারে, আমাদের দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা নির্ভর করছে ভারত সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। বক্তব্যগুলো জাতি হিসেবে আমাদের জন্যে অমর্যাদাকর। এটা তাঁরা অনুধাবন না করলেও সচেতন মানুষের চোখ ও কানকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। ভোটের ফলাফল ঘোষণার দিনই আমাদের প্রধান দলগুলোর নেতারা নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানান। এটা সংগত ও স্বাভাবিক কূটনৈতিক শিষ্টাচার। তবে সেদিনই খবরের কাগজের দুটো শিরোনাম কিছুটা বিব্রতকর। সেগুলো হচ্ছে ‘কংগ্রেসের ভরাডুবিতে আ.লীগে অস্বস্তি’ ও ‘বিজেপির বিজয়ে বিএনপিতে উচ্ছ্বাস’। ভারত কে শাসন করবে, তা নির্ধারণ করবে সে দেশের জনগণ। তাই বাইরের কারও পছন্দ-অপছন্দের ধার না ধেরেই তাঁরা বিজেপির হাতেই শাসনভার তুলে দিয়েছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সে সরকারের সঙ্গে সব দেশকে কাজ করতে হবে। এ প্রস্তুতি আমাদের আগে থেকেই থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তা ছিল বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না।
অন্যদিকে, বিজেপির বিজয়ে বিএনপি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবে কেন, তাও দুর্বোধ্য। সে দলটি বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে বলে কি তারা ভেবে বসে আছে? এভাবেই কি চলবে এ দেশের রাজনীতি? এ উচ্ছ্বাস নিয়ে তার পরদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিএনপিকে আহাম্মকের দল বললেন। এর পরদিন আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে টেলিফোনে শুভেচ্ছা ও বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালেন। বিএনপিপ্রধানও যুগপৎ ফোনে নরেন্দ্র মোদিকে জানান অভিনন্দন। অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব মন্তব্য করেন, ‘বিজেপির জয়ে আ.লীগ নার্ভাস’। আবার সংবাদপত্রের শিরোনাম আসে, ‘মোদির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির প্রতিযোগিতায় আ.লীগ ও বিএনপি’। দল দুটোর মধ্যে চলতেই থাকে এ ধরনের মন্তব্য আর পাল্টা মন্তব্য। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য ‘মোদির বিজয়ে পরিবর্তন দেখাটা বিরোধী দলের সুখবিলাস’। ভারত স্বাধীনতাসংগ্রামে আমাদের পরীক্ষিত মিত্র। বিশাল এ দেশটি আমাদের তিন দিক বেষ্ট করে আছে। স্থলসীমান্তের কিছু অপদখলীয় জমি ও ছিটমহল বিনিময়ের সিদ্ধান্ত ছিল ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে। দুর্ভাগ্যবশত কোনো না কোনো বাধায় চুক্তিটি আজও (বেরুবাড়ি ও তিনবিঘা ব্যতীত) বাস্তবায়িত হয়নি। ৫৪টি নদী বয়ে গেছে আমাদের দেশের ভেতর দিয়ে, যেগুলোর উৎস ভারত কিংবা তারও উজানে। গঙ্গা ছাড়া উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন নিয়ে কোনো চুক্তি নেই। তিস্তার চুক্তি হতে গিয়েও ঠেকে গেছে। স্থলসীমান্ত বিনিময়ের জন্য আগের চুক্তিটি বাস্তবায়ন করতে একটি সমঝোতা স্মারক হয়েছে। সেটাও ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পেশ করেই আগের সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছে। বিগত পাঁচ বছরে এর বেশি অগ্রগতি হয়নি।
বাণিজ্য ঘাটতি বাংলাদেশের প্রতিকূলে দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রতিকারের কার্যকর উদ্যোগ নেই। সীমান্তে বিএসএফের বাংলাদেশি নাগরিক হত্যাও থামছে না। উল্লেখ করতে হয়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ভারতে চলে যাওয়া শরণার্থীরা ফেরত আসে। জনসংহতি সমিতির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি দীর্ঘদিন চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আপাত অবসান ঘটিয়েছে। এসব বিষয়ে ভারতের তাৎপর্যপূর্ণ সহযোগিতা ছিল। আবার ২০০৯ সালের সূচনায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার জন্য হুমকিস্বরূপ থাকা কতিপয় সশস্ত্র সংগঠনকে নিষ্ক্রিয় করতে কার্যকর সহযোগিতা করে। নৌপথে ট্রানজিটব্যবস্থার সম্প্রসারণ হয়। স্থলপথেও তা সীমিত আকারে চলে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে নদীতে বাঁধ দিয়েও। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের জন্য স্থল ও রেলপথ ব্যবহারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রাথমিক কাজ চলমান রয়েছে। এগুলো সবই উভয় দেশের সঙ্গে সম্প্রীতিসুলভ সম্পর্ক জোরদারের জন্য আবশ্যক। বস্তুত উদীয়মান পরাশক্তি ভারত, বাংলাদেশের জন্য বাস্তবতা। ঠিক তেমনি এ বিশাল দেশটির সাতটি রাজ্যের মধ্যে অবস্থানকারী বাংলাদেশও ভারতের জন্য একই ভাবে প্রাসঙ্গিক। খোলামন আর দেওয়া-নেওয়ার মনোভাব নিয়ে কাজ করলে দুই দেশই বিরাজমান ভৌগোলিক অবস্থায় লাভবান হতে পারে। সবাই চায় সে পথে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক। দিল্লির ক্ষমতা বদল নিয়ে দুটো প্রধান দলের পক্ষ থেকে বক্তব্য আর পাল্টা বক্তব্য কিন্তু আমাদের জাতীয় মর্যাদার পরিপন্থী। এটা তাঁরা জানেন কিন্তু মানেন বলে মনে হয় না। দীর্ঘকাল ধরেই এ প্রবণতা চলে আসছে। এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল ভারতের নতুন সরকারের নেকনজরে আসতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রেও তারা সমমর্যাদায় কথা বলতে গিয়ে কিছুটা হোঁচট খাবে।
পেছনের ভাবমূর্তি যা-ই থাকুক, নরেন্দ্র মোদি আজ ভারতের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। আর আমাদের প্রধান দলগুলো মিলেমিশে নির্বাচন নামক প্রতিষ্ঠানটিকেই বিপন্ন করে ফেলেছে। ফুটবল, ক্রিকেটের মতো নির্বাচনেও আমরা এখন মূলত দর্শকের জাতি। বিশাল ভারতের ৮২ কোটি ভোটারের মহাযজ্ঞ দেখলাম দেড় মাস ধরে। প্রতিনিয়ত পড়লাম বিভিন্ন খবর ও মতামত। অন্যদিকে নিজ দেশের সে নির্বাচনব্যবস্থাটিই আজ পঙ্গু আর হতশ্রী। অথচ প্রধান দলগুলো চাইলে এ অবস্থার অবসান সম্ভব। সবার অংশগ্রহণে নির্বাচিত সরকার শুধু ভারত নয়, অন্য সব দেশের সঙ্গেই কথা বলতে পারবে অনেক বেশি মর্যাদার সঙ্গে। ভারতের সদ্য ক্ষমতা থেকে যাঁরা বিদায় নিলেন, তাঁরা অনেক কিছু করার আশ্বাস দিলেও তেমন কিছুই কিন্তু করেননি। সবে ক্ষমতায় আসা বিজেপির নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বাংলাদেশবিষয়ক কিছু বক্তব্য নতুন প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে। তদুপরি নরেন্দ্র মোদি গুজরাট সরকার পরিচালনাকালে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নৈতিক দায়ভারও তাঁর পিছু ছাড়ছে না। তবে আমরা বিশ্বাস করতে চাই যে নির্বাচন-পরবর্তীকালে বিজেপি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে। উল্লেখ্য, আগেও ভারতে বাজপেয়ির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ছিল। তখন সে সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান দুটি দলের নেতৃত্বে গঠিত সরকারগুলো কাজ করেছে। সে সময় ভিন্নতর কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল, এমনটি দেখা যায়নি। মনে করা হয়, এখনো তাই হবে। নরেন্দ্র মোদি বাস্তবতার নিরিখে পরিচালনা করবেন ভারত সরকার। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রতিবেশী দেশের সরকারপ্রধানদের আমন্ত্রণ এই দেশগুলোর প্রতি তাঁর অধিক গুরুত্ব দেওয়ার ইঙ্গিতবহ বলেও মনে করা যায়। তবে সীমাবদ্ধতা থাকবে তাঁরও। বাংলাদেশের প্রয়োজনের প্রতি ইতিবাচক সাড়া দিতে তাঁরও আবশ্যক হবে সীমান্তবর্তী রাজ্য সরকারগুলোর সমর্থন। এর জন্য আমাদের প্রয়োজন বিরামহীন কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আর ধৈর্য ও সংযম। ভারতে সরকার পরিবর্তনের পরপরই নতুন চমক ঘটবে কিংবা তাদের সহায়তায় বাংলাদেশের ক্ষমতাকাঠামোয় পরিবর্তন আসবে, এমনটা যাঁরা ভাবেন বা বলেন, তাঁদের বিষয়ে মন্তব্য না করাই শ্রেয়। তাঁদের কিন্তু দিল্লির ক্ষমতাকাঠামো সম্পর্কে জানার কথা। সেখানে একটি পদ্ধতি কার্যকর রয়েছে। রাতারাতি তাতে পরিবর্তন আসে না। তবে সে পদ্ধতির যোজন যোজন দূরত্ব মুহূর্তেই পাড়ি দেওয়ার ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। কিন্তু এরপর? চিঠি, টেলিফোন আর তড়িঘড়ি প্রতিনিধি পাঠিয়ে দ্রুত কোনো প্রতিকার কেউ পাবেন, তেমন সুযোগ আপাতত দৃশ্যমান হচ্ছে না। আকাশপথে দিল্লির দূরত্ব মাত্র দুই ঘণ্টার। তবে যাযাবরের দৃষ্টিপাত বইটিতে সুফি সাধক হজরত নিজাম উদ্দিন (রহঃ)-এর সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে একটি উক্তি এখানে উল্লেখ করতে হয়। তা হলো, ‘দিল্লি দূর অস্ত’। ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত’। দিল্লি অনেক দূর। দিল্লি এখনো অনেক দূর।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.