ডলারের মূল্য হ্রাস, চাল ও সবজির দাম বৃদ্ধি by ড. আর এম দেবনাথ

বাজারে ডালের দাম কম, চালের দাম বেশি। মোবাইলে মেসেজ দেখলাম, ফখরুদ্দিনের বিরিয়ানির দাম কমছে ২০ শতাংশ। অন্যদিকে বাজারে সবজির দাম বেশি। বর্তমানে দেশে চলছে এক অনিশ্চয়তার খেলা। রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা, অর্থনীতি ও ব্যবসায় অনিশ্চয়তা। রাজনীতি অর্থনীতিকে গ্রাস করছে, অর্থনীতি রাজনীতিকে গ্রাস করছে। এই খেলায় শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত, চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ, মধ্যবিত্ত, নিুমধ্যবিত্ত ও বেকার মানুষ। লাভবান পাইকারি-খুচরা ব্যবসায়ীরা। এই যেমন সর্বশেষ রাজনৈতিক কর্মসূচি- চারদিনের হরতাল, ১০ থেকে ১৩ তারিখ। হরতাল শুরু হওয়ার আগের দিনই চালের দাম বেড়ে গেল কেজিতে প্রায় এক টাকা। এর আগে গত এক মাসে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে পাঁচ-সাত টাকা করে। যে মোটা চাল ৩২-৩৩ টাকায় বিক্রি হতো, তা এখন ৪০ টাকা কেজি। নাজিরশাইলের দাম কেজিতে বেড়েছে পাঁচ টাকা। এটা কি শুধু হরতালের কারণে? না, তা নয়। চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে পবিত্র ঈদের আগ থেকে। হরতাল-ভয়তাল বেশতি সুযোগ। বর্তমান মূল্যবৃদ্ধি শুধু ‘সাপ্লাই চেইন’ বিনষ্ট হওয়ার জন্য নয়, নয় শুধু সরবরাহ ঘাটতির জন্য। এতে যোগ হয়েছে পাইকারি-খুচরা ব্যবসায়ী ও মিলারদের সীমাহীন লোভ।
আমাদের দুঃখ, ব্যবসায়ী ভাইয়েরা গ্রাহকদের কখনও একটু স্বস্তি দেন না। বৃষ্টিতে দেন না, রোদে দেন না, সরবরাহে ঘাটতি হলে দেন না, সরবরাহে উদ্বৃত্ত দেখা দিলে দেন না, সরকার কর কমালেও দেন না। এমনকি ‘দেশপ্রেমিক’ ব্যবসায়ী ভাইয়েরা পবিত্র রোজার মাসে, কোরবানির ঈদেও কাউকে একটু স্বস্তি দেন না। যদি দিতেন, তাহলে তারা চালের দাম বাড়াতেন না। চালের সরবরাহে কি ঘাটতি সত্যি সত্যি? বাদামতলীর চালের ব্যবসায়ীরা মিটফোর্ড-সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচটা দখল করে চালের স্টক করেন অবৈধভাবে। দেখলাম, সেই স্টকে কোনো ঘাটতি নেই। দেশে চালের উৎপাদনও রেকর্ড পরিমাণ। চালে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। সরকারের গুদামেও প্রচুর চাল। আটা আমদানিও যথেষ্ট। আগামী ফসলের আগমনী বার্তাও ভালো। তাহলে এ মুহূর্তে চালের এই দাম বৃদ্ধি কেন? এই বৃদ্ধির পরিমাণটা কি মাত্রাতিরিক্ত নয়? এতে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? অবশ্যই সাধারণ মানুষ। আমাদের মূল্যস্ফীতি যে পদ্ধতিতে হিসাব করা হয়, তাতে চালের ‘ওজন’ যথেষ্ট। চালের দাম বৃদ্ধি মানে মূল্যস্ফীতি বাড়া। মূল্যস্ফীতি বাড়া মানে লোকের সঞ্চয় কমা, সঞ্চয় কমা মানে বাজারে সঞ্চয়ের অভাব হওয়া। এক সমস্যায় ১০ সমস্যার সৃষ্টি। কিন্তু তা সত্ত্বেও চালের দাম বৃদ্ধি ঠেকানো এক অসম্ভব ব্যাপার। দু’দিন পরপর যদি টানা তিন-চারদিনের হরতাল ডাকা হয়, যদি কোনো কারণে অবরোধের ডাক আসে, তাহলে ব্যবসায়ী ভাইয়েরা কেন বসে থাকবেন? পুঁজি তাদের বাড়বেই। অতিরিক্ত মুনাফা তাদের হবেই। ধর্ম-নৈতিকতা তাকে নিরস্ত করতে পারবে না। মজার বিষয়, দেশে যারা ধর্ম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করছেন, তারাও কিন্তু এ বিষয়ে চুপ। তারা মহিলাদের গৃহবন্দি করা নিয়েই ব্যস্ত। মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার বিরুদ্ধে, অতিরিক্ত সুদের ব্যবসার বিরুদ্ধে কিন্তু তারা নিশ্চুপ। মজার দেশ, তাই না!
শুধু তো চালের দাম বৃদ্ধি নয়, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শাকসবজির দাম। এখন শীতকাল- নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। নতুন সবজি উঠেছে। কিন্তু সবজির দাম ঊর্ধ্বমুখী। দু’-একটির দাম কম থাকলেও বেশিরভাগের দাম কেজিপ্রতি ৪০ থেকে ৬০ টাকা। কাঁচা মরিচের দামের কথা নাইবা বললাম। এদিকে মসুর ডালের কেজি ১১০ টাকা। মুগের ডাল এক কেজি ১৩০ টাকা। চিনির কেজি ৪০ টাকা। পেঁয়াজ? পেঁয়াজের কেজি দেশীটা ১১০ টাকা। কোন দিকে যাবে মানুষ? বলাই বাহুল্য, আজকের দাম্য বৃদ্ধির একটা বড় কারণ টানা হরতাল। তবে তা একমাত্র কারণ নয়। হরতাল না হলে অবশ্যই মানুষ বেশ কিছুটা স্বস্তি পেত। হরতালের কারণে ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দিতে পারবে না। ঘরে ভাত থাকবে না উচ্চমূল্যের জন্য- এ এক বিশাল অবিচার নয় কি? শুধু ভোক্তার দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, কৃষক যারা সবজি ফলায়, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত। ঢাকার আশপাশ অঞ্চলের সবজিচাষীদের মাথায় হাত। সবজি ঢাকায় আসছে না। কাজেই তারা কোনো দামই পাচ্ছে না। অনেক সবজি বুড়ো হয়ে জমিতেই পচবে। একেই বলে সর্বনাশের সর্বনাশ। এর থেকে আমাদের মুক্তি নেই।
আসা যাক ডলারের মূল্যের দিকে। চালের দাম বাড়ছে, সবজির দাম বাড়ছে। কিন্তু কমছে ডলারের দাম। ২০১২ সালের দিকে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, যখন সবাই মনে করেছিল ডলারের দাম ১০০ টাকায় পৌঁছবে। ব্যবসায়ীরা, শিল্পপতিরা তো হৈ চৈ শুরু করে দিয়েছিলেন। আতংকিত হয়ে আমিও অনেক লিখেছি। সামনে দুর্দিন, ভীষণ দুর্দিনÑ আমিও লিখেছি। এখন যেমন চলছে ভারতে। ভারত বহুদিন তার ‘রুপিকে’ অবমূল্যায়িত (আন্ডারভ্যালুড) করে রাখে। ২০১৩ সাল তাদের রুপির জন্য দুর্দিন। রুপির দামে অধঃপতন ঘটে। দৃশ্যত এতে আমাদের লাভ। বহুদিন পর আমরা ডলারের বিপরীতে রুপি মার খাওয়ায় ‘হুণ্ডিতে’ বেশ ভালো দর পাচ্ছিলাম। ভারত এখন যে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন ডলারকে নিয়ে, আমরা বাংলাদেশে এমন একটা বাজে সময়ের আশংকা করেছিলাম। না, আমাদের আশংকা বাস্তবে রূপ নেয়নি। ডলারের দাম বহুদিন পর টাকার বিপরীতে কমেছে। এখন ডলারের দাম ৭৭-৭৮ টাকা। কার্ব মার্কেটে অবশ্য বেশি। সরকারিভাবে দাম ৮০ টাকার নিচেই। এই মূল্য হ্রাস বা মূল্যের স্থিতিশীলতা সম্ভব হয়েছে অনেক কারণে। প্রথমত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠিন ঋণনীতি অনুসরণ করছে। সরকারি ব্যাংকের প্রচুর উদ্বৃত্ত টাকা থাকলেও তাদের ঋণ দেয়ার ক্ষমতা সীমিত করে দেয়া হয়েছে। ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ঋণপ্রবাহের হিসাব দিতে হয়। ঋণ বরাদ্দের কাজ কঠিন করা হয়েছে। ১০ কোটি টাকার নতুন ঋণ দিতে এখন ইন্টারনাল অডিটের সম্মতি লাগবে। যার কাজ ছিল ঋণ পরবর্তী কাজ, এখন তাকে ঋণ পূর্ববর্তী পর্যায়ে জড়িত করা হয়েছে। ঋণের সিলিং বেঁধে দেয়া হয়েছে। আমদানি নীতি কঠোরতর করা হয়েছে। অনেক আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ফলে সরকারি ব্যাংকের ঋণপ্রবাহ অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবে বৃদ্ধি পাওয়া তো দূরের কথা, হ্রাস পেয়েছে। বড় বড় ঋণ দেয় সরকারি ব্যাংক। তা বস্তুত বন্ধ। বড় বড় ঋণ হয় প্রকল্প ঋণ। প্রকল্প ঋণ হলেই আমদানির জন্য বড় বড় ‘এলসি’ হয়। ঋণপত্র হলেই ডলারের চাহিদা বাড়ে। প্রকল্প ঋণ নেই তো ডলারের চাহিদাও নেই। অনেক আমদানি নিরুৎসাহিত হওয়ায় সেই খাতেও ডলারের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের আমদানিযোগ্য পণ্যের দাম এখন কম। তেলের দাম কম। তেলের আমদানিতে প্রচুর ডলার লাগে। এসব কারণে ডলারের চাহিদা বাজারে কম। ক’দিন আগে ঈদ গেল। হজ গেল। তখন সাময়িকভাবে অল্পস্বল্প ডলারের চাহিদা বেড়েছিল। ডলারের চাহিদা অবশ্য কার্ব মার্কেটে ভালো। এর রয়েছে ভিন্ন কারণ। যাদের টাকা আছে, রোজগার আছে, বাইরে ছেলেমেয়ে আছে, ব্যবসা আছে- তারা সমানে দেশের বাইরে টাকা পাঠাচ্ছে। নির্বাচন অনিশ্চিত হওয়ায়, কী হয় কী হয় অবস্থায় ধনাঢ্য ব্যক্তিরা টাকা পাচারের কাজ করছে।
এদিকে ডলারের চাহিদা কমলেও ডলারের সরবরাহ মোটামুটি ঠিক আছে। রেমিটেন্সও ভালো, গার্মেটস রফতানিও ভালো। ফলে শনৈঃ শনৈঃ বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এতে অনেকেই উৎফুল্ল। প্রচুর টাকা রিজার্ভে। এ টাকা উন্নয়নের জন্য খরচ করা যায়। করা যায়- কিন্তু এই ডলারের মালিক কৃষকের ‘পোলারা’। ডলার নিতে হলে তাদের কাছ থেকে নগদ টাকায় তা কিনতে হবে। সরকারের টাকা কোথায়? নেই। অতএব ওই চিন্তা বাদ। এছাড়া আগের হিসাব এখন বাতিল। বলা হতো, তিন মাসের আমদানির সমপরিমাণ ডলার রিজার্ভে থাকা দরকার। এখন বলা হচ্ছে, তিন মাস নয়, ছয় মাস। কারণ ঝুঁকি বেড়েছে। আমদানিযোগ্য পণ্যের মূল্য যখন তখন বাড়তে পারে। ‘ডেফার্ড এলসির’ জন্য ডলার রাখতে হবে, ব্যবসায়ীরা ডলারে যে ঋণ করেছে তা পেমেন্টের জন্য ডলার রাখতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। অতএব ‘ডলার রিজার্ভ’ ‘ডলার রিজার্ভ’ বলে হৈ চৈ করার কিছু নেই। বরং উল্টো ফল আছে। ডলারের মূল্য হ্রাস, রিজার্ভ বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে রেমিটেন্সের একটা অংশ আবার হুণ্ডিতে আসছে। হুণ্ডিতে রেমিটেন্স আসে বরাবরই। এখন এর পরিমাণ আবার বাড়ছে। কোনো দেশপ্রেমই ‘হুণ্ডি’ প্রবণতা হ্রাস করতে পারছে না। এটা হচ্ছে ডলারের মূল্য হ্রাসের প্রথম ফল। দ্বিতীয় ফল অবশ্য আন্তর্জাতিক পণ্যের মূল্য হ্রাস। আমরা যেসব পণ্য আমদানি করি, সেগুলোর দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। এসবের দাম অভ্যন্তরীণ বাজারে কমার কথা। কিন্তু তা কমেনি। এর কোনো সুবিধা সাধারণ মানুষ পায়নি। এ লাভটা পকেটস্থ হয়েছে ব্যবসায়ীদের। ডলারের দাম কমায় ভারতীয় পণ্য আমাদের কাছে সস্তা হয়েছে। ফলে ভারতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির কাজ কিছু বিঘিœত হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশের পোশাক ভারতীয়দের কাছে ব্যয়বহুল হয়েছে। তবে উল্টো বিষয়ও আছে। বাংলাদেশ গার্মেন্ট কারখানার জন্য তুলা-সুতা আমদানি করে। এর মূল্য এখন বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের কাছে কম। অতএব এখানে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে।
ড. আর এম দেবনাথ : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম

No comments

Powered by Blogger.