রাজনৈতিক সংকট ও বাস্তবতা by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন

নির্বাচনে জয় শতভাগ নিশ্চিত করতে চাইছে আওয়ামী লীগ। এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা বিএনপি। এজন্য বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার কৌশলে হাঁটছে সরকার। সেক্ষেত্রে বলা যায়, সাময়িকভাবে হলেও চলমান রাজনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে সরকার। বিরোধী দলের কৌশলে বেনিফিশিয়ারি হচ্ছে তারা। সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কৌশলে পরিবর্তন আনা অপরিহার্য বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। হরতাল বাংলাদেশে একসময় প্রতিবাদের একটি শক্তিশালী মাধ্যম ছিল। কিন্তু অতি ব্যবহারের কারণে হরতালের কার্যকারিতা এখন তেমন নেই। দাবি আদায়ের মাধ্যম হিসেবে হরতালকে এখন সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্মসূচি মনে করা সমীচীন হবে না। তাই হরতাল না দিয়ে বিকল্প কর্মসূচির চিন্তা করতে হবে। দাবি আদায়ে কোনো নির্দিষ্ট স্থান ঘেরাও, অবরোধ ও সমাবেশ হরতালের চেয়ে বেশি কার্যকর ও উত্তেজনা সৃষ্টিতে সহায়ক হবে বলে মনে হয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বসে নেই পরাশক্তি ও আঞ্চলিক শক্তি। তারা তাদের ফায়দা হাসিল করতে অত্যন্ত তৎপর বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে ভারত। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তারা একটু বেশিই মাথা ঘামাচ্ছে বলে মনে হয়। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের মনোভাব হওয়া উচিত উদার। কোনো একক দলের পক্ষে অবস্থান নিলে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও উদারতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে সভা হচ্ছে দিল্লিতে। বাংলাদেশের রাজনীতি কেমন হবে, কারা ক্ষমতায় আসবে- ভারতের এসব নিয়ে মাথা ঘামানোকে দেশের মানুষ ভালোভাবে দেখছে না। সুতরাং ভারতের উচিত বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করা এবং সব দলের অংশগ্রহণে একটি পক্ষপাতহীন ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে এ দেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে মনেপ্রাণে কাজ করা। তাতে ভারতের লাভই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক ধারা ব্যাহত হলে ভারতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশি। কারণ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ ব্যয় হয় ভারত থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানির পেছনে। কাজেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘায়িত হলে, এখানে অশান্তি বিরাজমান থাকলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে নিঃসন্দেহে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারত।
আন্তরিকভাবে চাইলে কোনো সমস্যার সমাধান হয়নি- ইতিহাসে এমন নজির নেই। প্রধানমন্ত্রী আন্তরিকভাবে চাইলে মুহূর্তের মধ্যেই সংকটের সমাধান হতে পারে, কারণ তার হাতেই সমাধানের চাবিকাঠি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মানুষের কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারেন না; তিনি দেশে শান্তি চান। তার কথা খুব ভালো লেগেছে। আমরা চাই, আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয়, কোনো প্রাণ ঝরে না যায়।
রাজনৈতিক কারণে এরই মধ্যে কয়েকশ’ মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে গেছে এবং এ হত্যার মিছিল দিন দিন বাড়ছে। যারা নিহত হয়েছে, তারা প্রত্যেকে পরিবারের সম্পদ ছিল; এ সম্পদ হারিয়ে পরিবারগুলো মহাসংকটে পড়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার সময় মানুষ একবার জীবন দিয়েছে। এটি বাতিলের কারণে এখন আবার জীবন দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ যদি বিরোধী দলে যায়, হয়তো দেখা যাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য মানুষকে আবার জীবন দিতে হচ্ছে!
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, দেশকে নিয়ে চলছে বিপজ্জনক খেলা। রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হয়েও হচ্ছে না। পরাশক্তি ও আঞ্চলিক শক্তির তৎপরতা দেখে প্রতীয়মান হয়, কোনো অদৃশ্য শক্তি যেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত করার চেষ্টায় আছে। এমনটি হলে রাজনীতির ভাগ্যে বিপর্যয় ঘটার সমূহ আশংকা আছে। আর রাজনীতিতে বিপর্যয় ঘটলে বিপর্যয় ঘটবে রাজনীতিকদের জীবনে; বিপর্যয় ঘটবে দেশেও। কাজেই রাজনীতিকদের সতর্ক হতে হবে, দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংকট সমাধানে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশ বাঁচলে তবেই রাজনীতি। দেশই যদি বিপর্যয়ে পড়ে তাহলে রাজনীতিকরা কী নিয়ে রাজনীতি করবেন?
কাজেই সময় থাকতে পরস্পরের ভেদাভেদ ভুলে আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে সবাইকে মনোনিবেশ করতে হবে, যাতে সংঘাতের পথ এড়ানো সম্ভব হয়। সুস্থ রাজনীতির ধারা দেশে ফিরে আসে। গণতন্ত্র মেনে রাজনীতি করলে রাজনীতি কোনোভাবেই সহিংসতার পথে ধাবিত হয় না। রাজনীতিতে পরাজয়কে সহজভাবে মেনে নেয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে এবং বিজয়কে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে।
দেশে একটি রাজনৈতিক সংকট চলছে। এর সঙ্গে দেশ ও দেশের মানুষের ভাগ্য জড়িত। রাজনীতিকদের দ্রুত সংকট সমাধানের পথ খুঁজতে হবে এবং সেটি দেশের ক্ষতি না করে। দেশের ক্ষতি হয় ও মানুষের কষ্ট হয়- এমন রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। দেশের ক্ষতি না করে সংকটের সমাধান করলে রাজনীতিকদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.