এবারের নির্বাচন হোক ভিন্ন ইশতেহারে by ড. শরীফ মজুমদার

ঠিক এই লেখাটি কিনা জানি না, তবে এ ধরনের একটি লেখার চিন্তা করেছিলাম ২০০৭ সাল থেকে। ২০০৭ সালে কানাডায় অধ্যয়নকালীন তাদের নির্বাচনমুখী গণতান্ত্রিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে টিভি চ্যানেলগুলোতে যে ডিবেট হতো, সেগুলো খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করার সুযোগ হয়েছিল। পরে পিএইচডি করতে ইংল্যান্ডের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া এবং ইউরোপিয়ান গণতান্ত্রিক ইশতেহার সম্পর্কে জানার ও দেখার সুযোগ হয়েছিল। ডেভিড ক্যামেরন যে নির্বাচনটিতে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন, সে নির্বাচনটি নিজের চোখে দেখার এবং নির্বাচনকালীন সেদেশে অবস্থান করার সুযোগটি নেহাত তুচ্ছ নয়। যা হোক, যে কথাটি প্রথমেই উল্লেখ করব তা হল নটিংহাম বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বা শিক্ষকদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো আলাপচারিতা বা কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করা যায়নি। নির্বাচন যেন একটি স্বাভাবিক ঘটনা, যা তাদের কর্মস্থলের দৈনন্দিন দায়িত্বশীলতার ঊর্ধ্বে কিছু নয়। হয়তো সে কারণেই অক্সফোর্ড শব্দ ভাণ্ডারে ‘শিক্ষক নেতা’ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ পাওয়া যায় না। আবার উল্টোভাবেও হয়তো বা সত্য- এ শব্দটি তাদের কালচারে নেই বলে শিক্ষকদের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্বের ভূমিকায় আসীন হওয়ার কোনো প্রবণতা নেই। আমাদের দেশে সেই কালচার আজও জন্মানি; হয়তো সে কারণেই আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বললে হয় অক্সফোর্ডকে অবমূল্যায়ন করা হয় অথবা যিনি তা বলছেন, তার অক্সফোর্ড সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই বলেই ধরে নেয়া হয়।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ প্রয়োজন এবং আগামী নির্বাচনে যে দলটি তাদের ইশতেহারে বলবে যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই নির্বাচন করবেন এবং দলমত নির্বিশেষে তারা নির্বাচিত উপাচার্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করবেন, তাদেরই আমরা গণতান্ত্রিক বলে ধরে নেব। রাষ্ট্র উপাচার্য নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে একটি কাঠামো প্রদান করতে পারে, যেখানে সরকারের মতাদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীলতার চেয়েও একাডেমিক সদস্যদের কাছে প্রহণযোগ্যতা সম্ভাব্য নির্বাচিতের মানদণ্ড হিসেবে প্রাধান্য পাবে। উন্নত দেশগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নির্বাচনের পদ্ধতি সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্যক ধারণা থাকার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ একমাত্র তাতে করেই কিছু গবেষণার জায়গা তৈরি হবে বা ভঙ্গুর গবেষণার কাঠামোগুলো মজবুত করা সম্ভব হবে। গবেষণা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অর্থ হয় না।
রাজনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপের কারণে আজ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইমেজ প্রায় ধ্বংসের মুখে। আদালত যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে মাদ্রাসার ছাত্র ভর্তির আদেশ দিতে পারেন, তাহলে একজন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া ছাত্র বা ছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ না দিলে আদালত কীভাবে চুপ করে থাকতে পারেন? ছাত্র ভর্তির আদেশ যদি স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপ না হয়, তাহলে একটি সর্বোচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন ছাত্রের অধিকার নিশ্চিত করতে চাওয়াটা কীভাবে স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপের শামিল হবে? স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নিয়োগ পাওয়া দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ শিক্ষকরা শিক্ষকতায় দ্বিতীয় শ্রেণীর মনমানসিকতার ধারাবাহিকতা রেখে যাওয়ার জন্য সব নিয়ম-নীতির ঊর্ধ্বে উঠে যে দলীয়করণে ব্যস্ত, মুক্তিযোদ্ধা সনদ কি তাদের সে অধিকার দেয়? জাতির ভবিষ্যৎ নষ্ট করার জন্যই কি জাতি তাদের প্রতি অনুকম্পা দেখিয়েছিল? অনেক পশ্চিমা দেশে একটি নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার আবেদনের ওপর আইনগত নিষেধাজ্ঞা আছে। জাতি এবারের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে এ বিষয়গুলো নিয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা চায়।
ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই সময়ের আলোকে নতুন করে ভাবতে হবে। ছাত্রদের এহেন রাজনীতি চর্চার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর আর কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রশ্ন এসে যায়, বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে আমরা ইচ্ছে করলেই একটি বিচ্ছিন্ন সংস্কৃতি চালু রাখতে পারি কিনা বা রাখতে চাওয়া উচিত কিনা? ছাত্র রাজনীতির বর্তমান রূপটা ভারত থেকে আমদানি করা, এটা বিলাতি বাবুদের শেখানো কোনো কৌশল নয়। কিন্তু যাদের কাছ থেকে আমদানি করেছি তাদের দিকে তাকালে দেখব, তারা আর এ সংস্কৃতি ধারণ করে না। হয়তো এটিই তাদের শিক্ষার বর্তমান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো এখনই ছাত্র রাজনীতির ইতি টানতে না পারলেও সুশীল সমাজ আশা করবে, এ ব্যাপারে তারা জাতিকে একটি ভবিষ্যৎ সময়সীমা জানিয়ে দেবে এবং সে সময়ের মধ্যে যে কোনো মূল্যে সব রাজনৈতিক দল তাদের ছাত্র সম্পৃক্ত কার্যক্রমের ইতি টানবে। রাজনীতি সচল রাখার জন্য দলগুলো ছাত্র নেতাদের পরিবর্তে বিভিন্ন পেশায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রেখেছেন- এ ধরনের নাগরিকদের বেছে নিতে পারে। এতে রাজনীতিতে যেমন অধিকতর ভদ্রতার সঞ্চালন হবে, তেমনি বিভিন্ন পেশায় একটি প্রচ্ছন্ন সুস্থ প্রতিযোগিতারও সঞ্চালন হবে। জনগণ আশা করবে, এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্যই ছাত্র রাজনীতির ইতি টানার ব্যাপারে সময়োপযোগী অঙ্গীকার করবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো নিয়ে গণতান্ত্রিক ইশতেহারের কথা চিন্তা করার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব কাঠামো নিয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিশ্র“তি এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিফলিত হওয়া একান্তই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষের আবেগকে পুঁজি করে রাজনীতিকে পরিবারতন্ত্রের মধ্যে বেঁধে রেখে ত্যাগী রাজনীতিকদের প্রতি অবজ্ঞা দেখানোর ধৃষ্টতা একটি উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের কোনো দলীয়প্রধান চিন্তাও করতে পারেন না। ব্রিটেনে অবস্থান করায় সে সময়কার লেবার দলের নতুন নেতা নির্বাচনটা মিডিয়ায় দেখার সুযোগ হয়েছিল। তাতে মনে হয়েছে, আমরা বোধহয় গণতন্ত্র নামের বৃক্ষটির গোড়া কর্তন করে অগ্রভাগে পানি সঞ্চালন নিয়ে ব্যস্ত। সুশীল সমাজ আশা করবে, দুই নেত্রী তাদের জীবদ্দশায় পরিবারতন্ত্রের বাইরে গিয়ে সত্যিকারের গণতন্ত্রের বীজ বপন করে যাবেন। যাতে তাদের অবর্তমানে জনগণ তাদের রাজনৈতিক আদর্শকে ধারণ করে, তাদের পরিবারের আদর্শকে নয়। দলীয়প্রধান নির্বাচনটি একটি জাতীয় নির্বাচনের মতোই স্বচ্ছ হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এটি একটি প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের মূলভিত্তি। ৪০ বছর চর্চার পর গণতন্ত্রের এ ভিত্তির প্রতি সবার আন্তরিক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। হয়তো এখানেই নিহিত রয়েছে বহুবিধ জাতীয় সমস্যার সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সমাধান।
মুখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বললাম, আর নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে দুর্নীতিবাজ লোকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিলাম- এ ধরনের দ্বিমুখী নীতি থেকে দলীয়প্রধানদের বেরিয়ে আসতে হবে। ২০১৩ সালের বাংলাদেশের জনগণ দলীয় দুর্নীতিবাজদের এভাবে পুরস্কৃত করা রাজনৈতিক দলকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করবে- সেটাই হোক এবারের নির্বাচনে জনগণের ইশতেহার। শুধু তাই নয়, সরকারে থাকাকালীন দুর্নীতি করে যারা অবৈধ অর্থ বানিয়েছে, যাদের দুর্নীতির কারণে দেশের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প ভস্তে গেছে, তাদের সম্পর্কে দলীয়প্রধানের অবস্থান পরিষ্কার না করলে সে দলকেও জনগণ আগামী নির্বাচনে প্রত্যাখ্যান করবে- সেটাই হোক এবারের নির্বাচনের প্রতিপাদ্য। জনগণের একটি বড় অংশ কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি অন্ধ নয় এবং জনগণের সেই অংশটিই এবারের নির্বাচনের ফলাফল তৈরি করবে। বিশ্বের সব প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশে এই ভাসমান ভোটাররাই সরকার নির্বাচন করে এবং এই ভাসমান ভোটারদের পছন্দ অনুযায়ীই রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করতে হয়। প্রতিটি নির্বাচনেই এই ভাসমান ভোটারদের পছন্দ-অপছন্দের কথা বিবেচনায় রেখে বহু পুরনো মূল্যবোধের বাইরে এসে রাজনৈতিক দলগুলোকে সময়োপযোগী নির্বাচনী ইশতেহারের কথা ভাবতে হয়। মনোনয়ন প্রার্থীদের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ এবং সেই ঋণ কতটা পরিশোধ করা হয়েছে, কী কাজে ব্যবহার করা হয়েছে, তা দেশের কাজে আদৌ ব্যবহার করা হয়েছে কি-না, নাকি দেশের বাইরে পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে বাড়ি-গাড়ি কেনার কাজে ব্যবহার হয়েছে, সে ব্যাপারগুলো এবার জনগণ তথা ভাসমান ভোটাররা খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে এবং সে ধরনের ব্যক্তিবিশেষের হাতে মনোনয়নের টিকিট তুলে দিলে সেই টিকিটধারীদের ‘না’ বলতে এবারের ভাসমান শিক্ষিত তরুণ সমাজ একটুও দ্বিধা করবে না।
রাজনৈতিক দলের নেতারা ক্ষমতায় খাকাকালীন রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কী পরিমাণ অর্থ নিয়েছেন, সে অর্থ কোন খাতে ব্যবহার করেছেন তার একটি হিসাব প্রতি প্রার্থীকেই জনগণের সামনে প্রকাশ করতে হবে। ব্রিটেনের মতো দেশে এ রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ আত্মসাৎ করায় বহু এমপির সদস্যপদ হারানোর মতো ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। আমাদের দেশে এখনও সে ধরনের কোনো ঘটনা না ঘটাটা শুধু অভ্যন্তরীণ স্বচ্ছতার অভাবের কথাই মনে করিয়ে দেয়। জাতি এবারের নির্বাচনে ও নির্বাচনী ইশতেহারে এ বিষয়গুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর স্পষ্ট প্রতিশ্র“তি শুনতে চায়।
ড. শরীফ মজুমদার : সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.