থ্রিজি প্রযুক্তি : সর্বোত্তম সেবা চাই by রাজীন অভী মুস্তাফিজ

এ মুহূর্তে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ও গণমাধ্যমে বহুল একটি আলোচনার বিষয় থ্রিজি। দেশে থ্রিজি প্রযুক্তি এসেছে- এ নিয়ে চারপাশে একটা চাপা উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। থ্রিজি হচ্ছে থার্ড জেনারেশন বা তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইল টেলিযোগাযোগের একটি প্রযুক্তি, যা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের দীর্ঘ ১৫ বছরের গবেষণালব্ধ একটি বিশেষ প্রযুক্তি। এর মাধ্যমে মোবাইল ইন্টারনেট সেবার এক অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছে। এনটিটি ডোকোমো নামের একটি জাপানি টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান সর্বপ্রথম এ প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করেছিল, যেটির প্রথম বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয় জাপানে ১ অক্টোবর ২০০১ সালে। ধীরে ধীরে থ্রিজি প্রযুক্তি অন্যান্য দেশেও বিস্তৃতি লাভ করে। বাংলাদেশে এ প্রযুক্তি সেবা পৌঁছতে প্রায় এক যুগ সময় পেরিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত আমরা বিশ্বের আধুনিক এই মোবাইল ইন্টারনেট প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে পারলাম। যদিও এখন বলা হচ্ছে, ফোর জি বা চতুর্থ প্রজন্মের প্রযুক্তিও অল্প কিছুদিনের ভেতরেই হাতের নাগালে চলে আসবে।
দ্বিতীয় প্রজন্ম থেকে তৃতীয় প্রজন্ম (টুজি থেকে থ্রিজি) প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চালিকাশক্তি কাজ করেছে। প্রথমত, মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা ধীরগতির ইন্টারনেট নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল, তাদের দাবি ছিল আরও বেশি গতির ইন্টারনেট, যার মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে কাজ সম্পন্ন করা যায়। দ্বিতীয়ত, বিশ্বের বড় মোবাইল কোম্পানিগুলো এমন একটি প্রযুক্তির সন্ধানে ছিল, যা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে তুলনামূলক ব্যবসায়িক সুবিধা দেবে, যেখানে অবকাঠামোগত বিনিয়োগের মাত্রা বেশি হওয়ার কারণে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকতে না পেরে অস্তিত্ব হারাবে। উল্লেখ্য, থ্রিজি প্রযুক্তিতে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বেশ বড় অংকের একটি বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়, যেহেতু থ্রিজি প্রযুক্তি একটি বিশেষ তরঙ্গ (ফ্রিকোয়েন্সি) ব্যবহার করে থাকে এবং এই তরঙ্গ ব্যবহারের জন্য সরকারের কাছ থেকে নতুন করে লাইসেন্স নিতে হয় মোটা অংকের ফির বিনিময়ে। তৃতীয়ত, বিশ্বের জনবহুল দুটি দেশ চীন ও ভারতে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির কারণে মোবাইল ইন্টারনেটের প্রসারের অপার সম্ভাবনা।
থ্রিজি প্রযুক্তি জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে কাজ করেছে এর মাধ্যমে ব্যবহৃত ইন্টারনেটের গতি। যেখানে টুজি প্রযুক্তি মূলত ভয়েস কল, টেক্সট মেসেজ, এমএমএস এবং কম গতির ইন্টারনেট সেবা প্রদান করতে সক্ষম, সেখানে থ্রিজি প্রযুক্তি ভয়েস কল, টেক্সট মেসেজ, এমএমএসের পাশাপাশি ভিডিও কল, মোবাইল টিভি সম্প্রচার, দ্রুত ডেটা আদান-প্রদান করতে পারে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবার মাধ্যমে। যদিও এই দুই প্রযুক্তির তুলনা করলে ভয়েস কলে তেমন একটা তারতম্য ঘটে না, কিন্তু ইন্টারনেটের মাধ্যমে যে কোনো আদান-প্রদানের (ডাউনলোড বা আপলোড) ক্ষেত্রে বিশেষ ইতিবাচক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তবে নতুন এ প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য থ্রিজি সহায়ক মোবাইল সেটের প্রয়োজন হয়।
বিটিআরসির তথ্যানুযায়ী জুন ২০১৩ পর্যন্ত বাংলাদেশে সক্রিয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ কোটি ৫৬ লাখের কিছু বেশি। এর ভেতর সিংহভাগই মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, যার সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৪০ লাখের মতো। যেহেতু দেশের ছয়টির ভেতর পাঁচটি মোবাইল ফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এখন থ্রিজি প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তাই আশা করা যায় নিজেদের বাণিজ্যিক সুবিধা লাভের জন্য হলেও এই প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত সব জায়গায় তাদের থ্রিজি নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করবে এবং উল্লিখিত মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা অল্প কিছুদিনের ভেতরেই এ সেবার আওতায় আসবে। তবে এখনই সব ব্যবহারকারী থ্রিজি ব্যবহারকারীতে রূপান্তরিত হতে পারবে না মূলত দুটি কারণে। প্রথমটি হচ্ছে, একসঙ্গেই সব জায়গায় থ্রিজি সেবা চালু হচ্ছে না- বিভাগীয় শহরগুলো থেকে ধীরে ধীরে অন্যান্য অঞ্চলে এর বিস্তৃতি ঘটবে এবং যা কিছুটা সময়সাপেক্ষ। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, থ্রিজি সেবা পেতে হলে মোবাইল হ্যান্ডসেটটিতে অবশ্যই থ্রিজি ব্যবহারের সুবিধা থাকতে হবে। সাধারণত সব স্মার্টফোনেই থ্রিজি সেবা পাওয়ার সুবিধা থাকে। তবে আশার কথা হচ্ছে, এ মুহূর্তে বাজারে স্বল্পমূল্যের অত্যাধুনিক স্মার্টফোন পাওয়া যাচ্ছে, যা এই প্রতিবন্ধকতা খুব সহজেই দূর করবে। এবার থ্রিজি প্রযুক্তি নিয়ে কিছু আশার কথা বলি। আমাদের দেশের মোবাইল ফোন প্রতিষ্ঠানগুলো দেশজুড়েই তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছে অনেক আগে। যেসব এলাকায় এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছেনি এমন অনেক জায়গায়ই অনেক প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক থাকার কারণে মোবাইল ফোন গণযোগাযোগে একটি ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। আর সেসব এলাকায় সৌরবিদ্যুৎ বিকল্প বিদ্যুৎ হিসেবে নিরবচ্ছিন্ন মোবাইল যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে সহায়তা করছে। এসব স্বল্পোন্নত এলাকায় দ্রুতগতির এই থ্রিজি সেবা সহজ করে দিতে পারে স্বাস্থ্য যোগাযোগ, কৃষি যোগাযোগ কিংবা শিক্ষার অগ্রযাত্রাসমূহ। এ কারণে আশা করা যাচ্ছে, প্রত্যন্ত এসব অঞ্চলে থ্রিজি সেবা বিবেচিত হতে পারে যোগাযোগ খাতের এক যুগান্তকারী মাইলফলক হিসেবে। গণমাধ্যম, বিশেষত বাংলাদেশের স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর জন্য মোবাইল টেলিভিশন সম্প্রচার এক অভিনব সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। কারণ এই মোবাইল টেলিভিশনের কল্যাণে এখন প্রায় দেশজুড়েই এসব স্যাটেলাইট চ্যানেল দেখতে পাওয়া যাবে। তাই বাংলাদেশ টেলিভিশনের টেরিস্ট্রিয়াল সুবিধার সঙ্গে লড়াই করার জন্য কিছুটা ইতিবাচক দিক এখান থেকে খুঁজে নিতে পারে বাংলাদেশী স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলো। ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের এ যুগে এদেশের উপযোগী করে বিভিন্ন স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশন সৃষ্টি করতে পারে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নতুন কর্মসংস্থানের পাশাপাশি স্বনির্ভরতা।
এবার বলি কিছু আশংকার কথা। থ্রিজি সেবার সাফল্যের অনেকটাই নির্ভর করছে এটির ব্যবহার মূল্যের ওপর। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। ধরা যাক, যে কোনো গ্রাহক আরেকজন গ্রাহকের সঙ্গে ভিডিও কল করবে অর্থাৎ একই সঙ্গে কথাও বলবে এবং দেখতেও পাবে। এখন এই ভিডিও কলটি গ্রাহকের জন্য দ্বিমুখী তথ্য আদান-প্রদানের খরচ (আপলোড ও ডাউনলোড) বহন করবে অর্থাৎ তার ছবি আপলোড হয়ে অপর গ্রাহকের কাছে যাবে, আর অপর গ্রাহকের ছবি ডাউনলোড হয়ে তার কাছে আসবে। কিংবা মোবাইল টিভি দেখার জন্য ব্যয় হবে বেশ খানিকটা ইন্টারনেট ডেটা। ইন্টারনেট সেবার এই ব্যয়ভার যদি সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনা না যায়, তাহলে হয়তো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ থ্রিজির অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। অন্যদিকে দেশে যে পরিমাণ গতি গ্রাহকদের দেয়া হবে, সেই পরিমাণ গতি যদি থ্রিজি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান তাদের দিক থেকে নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে ডেটা প্রেরণের সময় একটি শুভঙ্করের ফাঁকি সৃষ্টি হবে। উল্লেখ করা যেতে পারে, উপমহাদেশের দেশগুলোর ভেতর এখনও বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যয় তুলনামূলকভাবে বেশি।
রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিটক সর্বপ্রথম বাংলাদেশে থ্রিজি সেবা চালু করলেও তা সেভাবে জনপ্রিয় করতে পারেনি। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে প্রাথমিকভাবে ব্যবহারের উচ্চমূল্য, দুর্বল নেটওয়ার্ক এবং গ্রাহকদের সঠিক তথ্যের মাধ্যমে আগ্রহী করে তুলতে না পারাই প্রধান হিসেবে বিবেচিত হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে আশা করি, বাংলাদেশের মোবাইল ফোন প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিজ্ঞাপনে শুধু থ্রিজি প্রযুক্তি বাংলাদেশে এসেছে এভাবে গ্রাহকদের আগ্রহী করার পরিবর্তে বরং এই থ্রিজি সেবার ব্যবহারিক দিকগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে, প্রয়োজনে ডেটা গ্রহণ ও প্রেরণের একটা স্বচ্ছ ধারণা দিয়ে ব্যবহার ব্যয়ের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। মনে রাখতে হবে, বিশ্বায়নের এই যুগে সব গ্রাহকই ‘ভ্যালু ফর মানি’ অর্থাৎ যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবে ততটুকু সেবা পাওয়ার পরও আরেকটু কিছু বেশি চায়। সেক্ষেত্রে নতুন এ প্রযুক্তি সম্পর্কে গ্রাহকদের অবহিত করাটাই হওয়া উচিত সর্বপ্রথম কাজ। থ্রিজি প্রযুক্তি কী এবং এর মাধ্যমে একজন গ্রাহক কীভাবে উপকৃত হবে সেটাই যদি সে স্বচ্ছভাবে না জানে, তাহলে সেই প্রযুক্তির প্রতি উদাসীন থাকাটা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমার প্রায়ই মনে হয়, মানুষই শুধু প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে না, প্রযুক্তিও আমাদের ব্যবহার করে। তাই নতুন এই থ্রিজি প্রযুক্তি সম্পর্কে মানুষকে সঠিকভাবে অবহিত করতে পারলে উন্নয়নশীল এ দেশের যোগাযোগ খাতে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।
রাজীন অভী মুস্তাফিজ : ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষক

No comments

Powered by Blogger.