বার্ধক্যে বিষাদ

চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতির পথ ধরে বাড়ছে মানুষের আয়ুষ্কাল। সারা বিশ্বেই বাড়ছে প্রবীণদের সংখ্যা। ফলে প্রবীণদের স্বাস্থ্যগত দিকটিও আলাদাভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। গুরুত্ব পাচ্ছে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিও। সেদিকে লক্ষ রেখেই এবারের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের মূল ভাবনা ‘বয়োবৃদ্ধদের মানসিক স্বাস্থ্য’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ ১০ অক্টোবর বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এটা মোটেও অবাক হওয়ার বিষয় নয় যে বার্ধক্যেও মানুষ বিষাদগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু নানা কারণে বিষয়টি আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। ফলে ভুক্তভোগীর দুর্ভোগ আরও বেড়ে যায়। যাঁদের বয়স ৬০ বা তার ওপরে, তাঁরাই প্রধানত বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যার শিকার হন। বিশেষ করে শারীরিক সমস্যা যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হূদেরাগ, বাত-জাতীয় বিভিন্ন রকমের ব্যথা, স্ট্রোক, ডিমেনসিয়া বা স্মৃতিবৈকল্য ইত্যাদি। আবার এঁদের প্রায় ১৫ শতাংশ এসব শারীরিক সমস্যার সঙ্গে ডিপ্রেশন বা বিষাদ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। বয়সকালে অন্যান্য শারীরিক সমস্যার কারণে ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায় না এবং প্রবীণেরাও অনেক সময় এসব উপসর্গের কথা আত্মীয়স্বজনকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন না।
এ কারণে এই রোগের চিকিৎসাও পিছিয়ে যায় বা অবহেলিত হয়। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, বয়স্কদের শতকরা প্রায় ১৫ জন নানা ধরনের বিষণ্নতায় ভোগেন। আর শতকরা চারজন গুরুতর বা জটিল রকমের বিষণ্নতার শিকার। আমাদের দেশে বিষণ্নতায় ভোগে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। বয়োবৃদ্ধদের মধ্যে এই হার প্রায় তিন গুণ। ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতার প্রধান উপসর্গগুলোর মধ্যে মন-মেজাজ ভালো না থাকা, কোনো বিষয়ে আগ্রহ-উদ্যোগ কমে যাওয়া এবং একধরনের অবসাদ চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে সব সময়। এ ছাড়া মনোযোগের অভাব, মনের ভেতর একধরনের অস্থিরতা, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, নিজেকে সব কাজের জন্য অযোগ্য মনে করা, অকারণে বা সামান্য কারণে কান্না, নিজেকে অপরাধী মনে করা, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চরম হতাশা ইত্যাদি। এ ছাড়া ক্ষুধা, ঘুম ও যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যাওয়া। আত্মহত্যার চিন্তা বা পরিকল্পনাও একটি বড় উপসর্গ। বয়স্কদের বিষণ্নতার কারণগুলো নানা রকমের: সামাজিক, মানসিক ও জৈবিক। সামাজিক কারণগুলোর মধ্যে আছে সামাজিকভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, একাকিত্ব, শোক, দারিদ্র্য, শারীরিক অক্ষমতা ইত্যাদি। মানসিক কারণগুলোর মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব,
অন্যের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার অক্ষমতা, শারীরিক অসুস্থতা। জৈবিক কারণগুলোর মধ্যে স্নায়ুকোষের ক্ষয় ও স্নায়ুকোষে জৈব রাসায়নিক পদার্থের অভাব, বংশগত ঝুঁকি ইত্যাদি। বৃদ্ধ বয়সে শারীরিক অসুখ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে বিষণ্নতার কারণ হতে পারে। নারীদের ক্ষেত্রে রজঃনিবৃত্তি ও ক্যানসার এবং মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত কিছু সমস্যা সরাসরি বিষণ্নতার কারণ হতে পারে। আবার বৃদ্ধ বয়সে নানা রকম শারীরিক অসুস্থতার জন্য প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের ওষুধ খেতে হয়, যা সব সময় সুফল বয়ে আনে না; বরং একসঙ্গে কয়েক রকম ওষুধ সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়ও বিষণ্নতা বেড়ে যেতে পারে। গত তিন দশকে মনোরোগের চিকিৎসায় যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বিষণ্নতা রোগের চিকিৎসাও এখন অনেক সহজলভ্য ও ফলদায়ক। তবে বার্ধক্যে বিষণ্নতার সুচিকিৎসার জন্য শুধু ওষুধই নয়, তার সঙ্গে সাইকোথেরাপিও অত্যন্ত জরুরি। বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে যেকোনো ওষুধ প্রয়োগের সময় কতগুলো বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়। যেমন ওষুধের কার্যকারিতা, সহনীয়তা, নিরাপত্তা বা নির্বিঘ্নতা ও একাধিক ওষুধের সম্ভাব্য মিথস্ক্রিয়া। বয়সকালে দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো যেমন যকৃত, বৃক্ক, হূৎপিণ্ড, ফুসফুস, মস্তিষ্ক ইত্যাদির কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে সেবন করা ওষুধের বিপাক ও শরীর থেকে নিষ্ক্রমণ ও ধীরগতিতে হয় কিংবা অনেক সময় স্বাভাবিক থাকে না। ফলে সেবন করা ওষুধের বিপাক ঠিকমতো হয় না, যা অনেক সময় গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা বিষক্রিয়া হিসেবে দেখা দেয়। সুতরাং ওষুধ প্রয়োগের সময় স্বল্পতম কার্যকরী মাত্রায় ওষুধ শুরু করাই বাঞ্ছনীয়।
বর্তমানে বিষণ্নতা রোধকারী বা অ্যান্টিডিপ্রেশেন্ট ওষুধের মধ্যে ট্রাইসাইক্লিক অ্যান্টিডিপ্রেশেন্ট-জাতীয় ওষুধ অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সহজলভ্য। কিন্তু এসব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ার কারণে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও কার্যকরী এসএসআরআই-জাতীয় অ্যান্টিডিপ্রেশেন্ট বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। ওষুধের সঙ্গে সঙ্গে মনোসামাজিক চিকিৎসা, বিশেষ করে মানসিক সমর্থন, রোগ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা প্রদান এবং রোগের পরিণতি সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান অত্যন্ত ফলদায়ক। কননিটিভ থেরাপি ও কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি বিষণ্নতা রোগের চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত কার্যকরী মনোরোগ চিকিৎসা। যেসব ক্ষেত্রে এক বা দেড় মাস ওষুধ সেবনের পরও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয় না, সেসব ক্ষেত্রে ওষুধের সঙ্গে বৈদ্যুতিক চিকিৎসা বা ইসিটি ভালো কাজ করে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও বার্ধক্যে মানুষকে অনেক কিছু হারাতে হয়। স্বামী স্ত্রীকে হারান, স্ত্রী স্বামীকে। সব বয়সী আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের মৃত্যুসংবাদ কানে আসে। সন্তানেরা দূরে চলে যায়। শূন্য গৃহে একাকিত্ব যেন আরও নিষ্ঠুর হয়ে গ্রাস করতে থাকে। এসবের পরও যা সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয় বা বিষাদগ্রস্ত করে তোলে তা হচ্ছে সংসারে ক্রমেই মূল্যহীন হয়ে পড়া, সংসারে নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে সরে গিয়ে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া ইত্যাদি বিষয়। তাই বার্ধক্যে বিষাদ ঠেকিয়ে রাখতে প্রয়োজন প্রবীণদের আত্মমর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা।
অধ্যাপক মো. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী: পরিচালক ও অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

No comments

Powered by Blogger.