সাক্ষরতা দিবসে প্রত্যাশা by ড. মীর মন্জুর মাহ্মুদ

এবার আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে- একুশ শতকের জন্য সাক্ষরতা। ইউনেস্কো ও জাতিসংঘের উন্নত ও উন্নয়নশীল সব সদস্য রাষ্ট্র ১৯৬৫ সাল থেকে এ দিবসটি পালন করে আসছে। প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের নিরক্ষর মানুষের মধ্যে অক্ষরজ্ঞান ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যেই এ দিবসের ঘোষণা দেয়া হয়। বাংলাদেশেও দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালনের চেষ্টা করা হয়ে থাকে। দিনটিকে ঘিরে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়ে থাকে। নিঃসন্দেহে এ দিবসটি বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাক্ষরতা নিরূপণ জরিপের (২০১১) তথ্যানুসারে দেশে সাক্ষরতার হার ৫৩.৭ শতাংশ। শহরাঞ্চলে ৬৫.৬ শতাংশ ও গ্রামাঞ্চলে ৫০.৫ শতাংশ। বর্তমান সরকার ঘোষিত রূপকল্প-২০২১ এবং জাতীয়ভাবে শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনের প্রত্যাশিত সময়কাল ছিল ২০১৪। এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে খুব বেশি দিন আগে নয়। তারপরও লক্ষ্যমাত্রা ও বাস্তবায়ন চিত্রে এই ফারাক নিয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাবা দরকার। আবার সরবরাহকৃত রিপোর্টে উল্লেখ করা সাক্ষরতার হারের সঙ্গে অন্যান্য সূত্রের পার্থক্য দেখা যায়। সরকারের মৌলিক সাক্ষরতা ও অব্যাহত শিক্ষা নামক কার্যক্রমকে আরও কার্যকর করার পরিকল্পনা নেয়া জরুরি। এক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলের প্রতি বিশেষ নজর দিলে তুলনামূলকভাবে কম সময়ে আরও বেশি সফলতা আসতে পারে। বিষয়টি দেশের সামগ্রিক ও সুষম উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
সাক্ষরতা বলতে অক্ষর পরিচয় বা অক্ষরজ্ঞানকে বোঝায়। সার্বিক বিবেচনায় এখানে সাক্ষরতার একটি বিশেষ মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে সেক্ষেত্রে কয়েকটি অবস্থানও আমরা লক্ষ্য করি। ১৯০১ সালের লোক গণনার অফিসিয়াল ডকুমেন্ট-এ সাক্ষরতার মান ধরা হয়েছিল, নিজের নাম লিখতে যে কয়টি অক্ষর প্রয়োজন সেগুলো চিনতে এবং লিখতে পারা, চল্লিশ দশকে এসে প্রয়োজনীয় পড়ালেখার দক্ষতাকে সাক্ষরতা বলা হতো, ষাট দশকে পড়ালেখার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় হিসাব-নিকাশের যোগ্যতা অর্জন করা, আশির দশকে এসে অতিরিক্ত যোগ হয় সচেতনতা ও দৃশ্যমান বিষয় পাঠের দক্ষতা অর্জন করা, আর বর্তমানে অতীতের সবকিছুর সঙ্গে যোগ করা হয়েছে যোগাযোগ, ক্ষমতায়ন, জীবননির্বাহ, প্রতিরক্ষা এবং সাংগঠনিক দক্ষতাকে। এখানে নৈতিকতাকে কোন মানদণ্ডে আনা হয়নি, হয়তো বা এটি ব্যক্তিগত হিসেবেই রাখা হয়েছে। কিন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, একটি দেশের সুনাগরিক গঠনে সাক্ষরতা অর্জন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, পাশাপাশি এ মানুষগুলোকে মূল্যবোধসম্পন্ন হওয়াটাও অপরিহার্য। এক্ষেত্রে ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেই সবচেয়ে বেশি সফলতা আসবে বিশ্বাস করি। উন্নত নৈতিক মানসম্পন্ন মানুষ ছাড়া দুর্নীতিমুক্ত, আইনের শাসননির্ভর সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বর্তমান সময়ে আমরা তা ভীষণভাবে প্রত্যক্ষ করছি। এটিও মূল্যায়ন করা জরুরি যে, সাক্ষরতার নির্ধারিত মানদণ্ডে ৫৩.৭ শতাংশ মানুষ কতখানি সাক্ষরজ্ঞান লাভ করেছে। সে জন্য পরিসংখ্যানগত লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটি বাস্তবসম্মত ও সময়োচিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা জরুরি। তাহলে সাক্ষরতার হারের দিক থেকে বিশ্বে আমাদের ১৬৫তম অবস্থানের উন্নয়ন ঘটবে। একটি দুর্নীতিমুক্ত, সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে তা সহায়ক হবে। জাতি হিসেবে আমরা আরও গর্বিত হওয়ার সুযোগ পাব। আমাদের দেশের সাক্ষরতার লক্ষ্য বাস্তবায়নে আনুষ্ঠানিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রম অব্যাহত আছে। এক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা রাখতে পারে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম। কারণ এখানে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহের মধ্যে সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে নির্ধারণ করা হয়েছে। ঝরে পড়ার হার কমানো গেলে এ সেক্টরের মাধ্যমেও বড় সহায়তা আসতে পারে। এক পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে দেশের ৯৮ শতাংশ শিশুকে স্কুলে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। এগুলো সবই সম্ভাবনার কথা। দেশের মানুষকে এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার ওপর নির্ভর করছে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনের সময় ও মানের।
এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়ের মধ্যে সাক্ষরতা অর্জনের একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে, বিজ্ঞানের চরম জয়যাত্রা এবং বিশ্বায়নের যুগের মতো করে সাক্ষরতা অর্জন করতে হবে। তাই অতীতের চেয়ে এবারের লক্ষ্য নির্ধারণে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। আমাদেরও দিবসটি পালনের প্রাক্কালে সেভাবেই চিন্তা করা উচিত। সে জন্য একটি বাস্তবানুগ প্রত্যাশাও থাকতে হবে। আর তা হতে পারে জাতীয় জীবনে স্বনির্ভরতা অর্জন করা। সহজ কথায় স্বনির্ভরতা বলতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখাকে বোঝায়। কোনো দেশ বা জাতি যখন তাদের জীবনমান রক্ষায় নিজের প্রয়োজন মেটাতে নিজেই সক্ষম হয় তখন তাদের স্বনির্ভর বলা হয়। একটি স্বাধীন জাতির জন্য একটি প্রথম ও প্রধান প্রত্যাশিত লক্ষ্য থাকে। বলতে গেলে স্বাধীনতার স্বপ্নের বীজ এখানে নিহিত।
ড. মীর মন্জুর মাহ্মুদ : গবেষক, প্রবন্ধকার

No comments

Powered by Blogger.