সংকট উত্তরণে কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি দিন by ইমতিয়াজ মোহাম্মদ তালুকদার

দেশে গণতন্ত্রের সূচনালগ্ন থেকেই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে কমবেশি সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে টানাপোড়েন লক্ষ্য করা যায়। যখন যারা ক্ষমতায় থাকে, তারা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নিজ দলের স্বার্থে নেয়ার খেলায় মেতে ওঠে। এ কারণে বর্তমানেও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এক সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দেশ জাতি রসাতলে যাক, সেদিকে কোনো দলের ভ্রুক্ষেপ নেই। জনগণ এর যাঁতাকলে পড়ে পিষ্ট হতে চলেছে। তবু স্বার্থের কারণে যে যার অবস্থানে অটল। দুই দলের সংলাপ নিয়ে বিশিষ্টজন, সুশীল সমাজ, সাধারণ মানুষ- প্রায় সবাই একই কথা বলছেন। আমার মতে, সংলাপ হতে হবে বর্তমান সংসদের প্রতিনিধিত্বকারী দলের প্রতিনিধির মাধ্যমে। শুধু জননেত্রী ও দেশনেত্রী নয়। নির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে গোলটেবিল আলোচনা হতে হবে। বিষয়বস্তু ছাড়া আলোচনা ঝগড়াঝাটির মধ্যেই শেষ হবে, কোনো ফলাফল পাওয়া যাবে না। দেশ ও জনগণের স্বার্থে যা যা করার, তাই করতে হবে। আমরা প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে অহেতুক পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটাঘাঁটি করতে দেখেছি, যেমন জিয়া ঘোষক না মুজিব ঘোষক। ডিম আগে না মুরগি আগে- এসব তর্ক কোনোদিনও শেষ হবে না। আমাদের সুশৃংখলভাবে সামনে এগিয়ে যেতে যা যা করার দরকার, তাই করতে হবে। ধরে নেয়া যাক, সব দলই দেশপ্রেমিক, দেশের মঙ্গলের জন্য সবাই কাজ করতে চায়, সেজন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দরকার। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হল সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। অভিজ্ঞতা বলে, ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলে সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। এটা প্রমাণিত। তাই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির প্রচলন করা হয় এবং প্রয়োগ করা হয়। এ পদ্ধতির সরকার-ব্যবস্থায় নির্বাচন নিয়ে সামান্য বিতর্ক থাকলেও গ্রহণযোগ্যতা মোটামুটি ভালো। এটাও প্রমাণিত। সূক্ষ্ম কারচুপি, স্থূল কারচুপি, পুকুর চুরি, মিডিয়া ক্যু, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পাতানো নির্বাচন- এ পদ্ধতির নির্বাচনকে ঘিরেও এসব অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে সেসব ধোপে টেকেনি। তাই গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির সঙ্গে অন্য দেশের তুলনা করলে চলবে না। ইদানীং পাকিস্তানেও এর সফল প্রয়োগ দেখা গেছে।
বর্তমানে সাংবিধানিকভাবে এ পদ্ধতিটি জটিলতার আবর্তে পড়ে গেছে। তবে সব জটিলতার অবসান হতে পারে সব দলের আন্তরিকতার ওপর। বর্তমান সংকট উত্তরণের জন্য সংলাপের একটি তাগিদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ কারণে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার চিন্তা-চেতনা থেকে কিছু আলোকপাত করতে চাই।
১. বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি দেশের অভিভাবক। আমার ধারণা, যিনি এ পদ অলংকৃত করেন, তিনি যে দলেরই হোন না কেন, চিন্তা-চেতনা এবং মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে তিনি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেন। আমি মনে করি, নির্বাচনকালীন তিনি রাষ্ট্রের সিইও বা প্রধান নির্বাহী হিসেবে যাবতীয় নির্দেশনা প্রদান করবেন। সংসদের মেয়াদান্তে সংসদ ভেঙে দেবেন এবং এ কারণে সব দলের মনোনীত প্রার্থীরা লেভেল প্লেইং ফিল্ডে চলে আসবেন। রাষ্ট্রপতির অধীনে একটি ছোট আকারের উপদেষ্টা পরিষদ/কেবিনেট থাকবে এবং তারা কেবল রাষ্ট্রের রুটিন কার্য পরিচালনা করবেন। তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। যোগ্যতাসম্পন্ন যে কোনো নাগরিককে নিয়োগ দিতে পারবেন। মেয়াদকাল ২-৩ মাসের বেশি নয়।
২. বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিষয়ে বলার কিছু নেই। শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তারা যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। দেশে যত প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ এসেছে, তার সবই সুনামের সঙ্গে তারা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছেন। এর সর্বশেষ উদাহরণ রানা প্লাজা দুর্ঘটনার উদ্ধার কাজ পরিচালনা। আমার ধারণা, বর্তমানে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যে কর্মকাণ্ড চলছে, তাও এক ধরনের দুর্যোগ। এ দুর্যোগ মোকাবেলায় সেনাবাহিনী এগিয়ে আসতে পারে, সহযোগিতা করতে পারে। তাদের সহযোগিতায় আমরা একটি নির্ভুল জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের তদারকির ভার সম্পূর্ণভাবে সেনাবাহিনীর ওপর অর্পণ করা যায়। তাদের কাজ হবে, নির্বাচন চলাকালীন যেসব ঝামেলার সৃষ্টি হয়, তা সুষ্ঠুভাবে মোকাবেলা করা; যেমন- সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ, গণনা, ফলাফল প্রকাশ, ভোটারদের যাতায়াত নির্বিঘœ করা, শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখা, জাল ভোট বন্ধ করা, ভোট কেন্দ্র দখল, বাক্স ছিনতাইসহ সব ধরনের অবাঞ্ছিত কার্যকলাপ মোকাবেলা করা। অন্যান্য আইন-শৃংখলা বাহিনীও এসব কাজে সহযোগিতা করবে। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর সেনাবাহিনী কর্মস্থলে ফিরে যাবে।
৩. নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে এবং তাদের সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে। নির্বাচন পরিচালনায় তাদের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভূমিকা প্রশংসিত হোক এ প্রত্যাশা দেশবাসীসহ আন্তর্জাতিক মহলেরও। যেসব প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, তাদের সবাইকে লেভেল প্লেইং ফিল্ডে আসতে হবে, কোনোভাবেই ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন নয়। প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী ব্যয় যাতে অতিক্রম না করেন, তা মনিটর করতে হবে কমিশনকে। যেসব প্রার্থী মনোনয়ন পাবেন, তাদের অবশ্যই যোগ্য হতে হবে। সংসদ, আইন প্রণয়ন ইত্যাদি বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে। জনগণের নার্ভ বুঝতে হবে। মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্ত, বক্তব্য এবং সব তথ্য গণমাধ্যমে প্রচার করতে হবে। আমার ধারণা, বর্তমানে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হচ্ছে তা মার্কাকেন্দ্রিক প্রার্থীকেন্দ্রিক নয়। অনেক ভোটার প্রার্থীকে চেনে না, কিন্তু মার্কাকে ঠিকই চেনে। এর ফলে উপযুক্ত প্রার্থীরা অনেক সময় নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন না। তাই আমার প্রস্তাব, নির্বাচনী প্রতীক বিতরণ নিরপেক্ষভাবে লটারির মাধ্যমে করা অর্থাৎ চিরাচরিত প্রতীকগুলো বাদ দেয়া। আমার মনে হয়, এ পদ্ধতিতে ভোটাররা প্রার্থীর যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারবে। দলগুলোও তখন উপযুক্ত প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবে।
সবশেষে দেশের সম্মানিত ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের প্রতি আমার আবেদন, আর হিংসা-বিদ্বেষ নয়, অতীতের তিক্ততা ভুলে গিয়ে অমিয় সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশের দিকে তাকান। আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই। ১৬ কোটি মানুষ আপনাদের চেনে। আপনারাই পারেন দেশে শান্তির নহর বইয়ে দিতে। আপনারা দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন, চাওয়া-পাওয়ার অবশিষ্ট আর নেই বললেই চলে। সুতরাং সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যারাই ক্ষমতায় যাবেন, তারা সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে নতুন প্রত্যয়ে দেশ পরিচালনা করবেন। তাহলেই দেশের উন্নতি নিশ্চিত হবে।
ইমতিয়াজ মোহাম্মদ তালুকদার : প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.