অসম্পূর্ণ শীতল যুদ্ধ ও আজকের বাংলাদেশ by কাজী জেসিন

সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ম যেন আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। বিবিধ টকশোতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুর পাশাপাশি আলোচনার বিষয় এখন ধর্ম তাদের ভাষায়, ‘ধর্মভিত্তিক রাজনীতি’, ‘রাষ্ট্র ও ধর্মের পৃথককরণ’, নারী অধিকার ও ধর্মের পশ্চাৎপদতা ইত্যাদি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোও এর বাইরে নয়। তবে একটি বিষয় প্রকটভাবে লক্ষণীয়, তা হলো, বিভিন্ন পক্ষের প্রতিক্রিয়া জানাবার ধরন। শব্দটা ‘প্রতিক্রিয়া’ বলে লিখলাম বটে কিন্তু বাস্তবে টের পাচ্ছি ব্যাপারটা প্রতিক্রিয়ার সীমা ছাপিয়ে হয়ে গেছে শত্রুতা। যার সঙ্গে আর ডায়লগের কিছু নেই। অন্যের মতকে খারিজ করে দিতে কেউ এক শব্দে কাউকে ‘নাস্তিক’ আবার কেউ ‘ধর্মান্ধ’ আখ্যা দিচ্ছেন। বন্ধু এবং শত্রুর মাঝামাঝি কোন স্থান যেন এখানে নেই। ‘নাস্তিক’ বা ‘ধর্মান্ধ’ বলে একে অপরকে ট্যাগ করছে অথচ শব্দ দুটোর অর্থ সবার কাছে এক নয়। বোঝাবুঝির চেয়ে আগেই শত্রুঘোষণার সিদ্ধান্ত জানানোটাই যেন জরুরি। বাংলাদেশে, বহু পরিবারে যুগ যুগ ধরে, একই ঘরে বাস করে আসছে বেনামাজি ও ধর্মভীরু দুই ভাই বা বাপ-ছেলে। কিন্তু এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি যা কোন বন্ধুত্ব, রক্তের সম্পর্ক, সামাজিক সম্পর্ক কিছুই যেন মানছে না। অন্যের চিন্তাকে খারিজ বলে জানান দিলেই যেন সব সমাধান। কোথাও অবস্থা এমন ঘৃণার জায়গায় চলে গেছে যে, মানুষ নানাভাবে, যার হাতে বুলেট নেই সে যেন বুলেটের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করছে নানাবিধ আপত্তিকর শব্দ, গালাগালি। কোথা থেকে এলো আমাদের ভেতরে এ অসহিষ্ণুতা? এই অসহিষ্ণুতার জন্ম কে দিয়েছে? শাহবাগের জনসমাবেশ কিংবা হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ? এই অসহিষ্ণুতা কি বিএনপি-আওয়ামী লীগের বাকযুদ্ধ ও মতদ্বন্দ্বেরই প্রসারিত রূপ? নাকি এই বিদ্বেষের বীজ আমাদের মাটিতে বোনা হয়েছে আরও আগে, বহুদিন ধরে, যার প্রকাশ আজকের এই অসষ্ণিুতা? সমাজতাত্ত্বিকরা ভাল বলতে পারবেন!
দুনিয়ার সব সমাজ-সভ্যতার গড়ে, বেড়ে ওঠা একই রকম হতে হবে, একই ছাঁচ বা ফর্মুলায় রাষ্ট্র হয়ে উঠতে হবে এই ভাবনার মধ্যে কোন সারবত্তা  নেই। তবে এর মধ্যে ময়ূরপুচ্ছ গুজে কাকের ময়ূর ভাবার বোকামি আছি।
বৃটিশ  উপনিবেশ শুধু আমাদের মধ্যে বঞ্চনা আর নির্যাতনের স্বাক্ষর রেখে যায়নি, দিয়ে গেছে সাম্প্রদায়িকতার বীজ। ব্রিটিশরাই দেখিয়েছে, মুসলমানরা সাম্প্রদায়িকতায় দুষ্ট। আর এই সাম্প্রদায়িকতার দাগ আরও গাঢ় করেছে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বর্ণহিন্দু বা ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির আধিপত্য। ইতিহাসবিদ হান্টার লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের মুসলমানদের প্রতি গত অর্ধশতাব্দী ধরে যে ঘৃণা ও অবহেলা দেখানো হয়েছে, আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তার গভীর ছাপ রয়ে গেছে। প্রাচ্যের পূর্বতন বিজেতাগনকে আমাদের প্রাচ্য সম্বন্ধীয় পুঁথি-পত্র ও লাইব্রেরিৎগুলো থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে, যেমন হয়েছে, সবরকম কার্যকরী জীবনোপায় থেকে’ (উইলিয়াম হান্টার, দি ইন্ডিয়ান মুসলিমস, অনুবাদ-আবদুল মওদুদ, পৃষ্ঠা-১২৮। জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের সাহিত্যের প্রভাবে ধীরে ধীরে বদলে যায় আমাদের রুচি । ভাষাও কোনভাবে এর ব্যতিক্রম নয়। ‘পানি’ বদলে এখনও আমাদের সাহিত্যে হয়ে যায় ‘জল’।  আধুনিক ভারতীয় সাহিত্য মুসলমানদের প্রতি যে অবহেলা, ঘৃণার প্রকাশ ঘটিয়েছে তা কোনভাবেই ধর্মপ্রাণ- মুসলমানদের চরিত্রকে উজ্জ্বল করে না, বরং ধীরে ধীরে মুসলিমরা তাদের সংস্কৃতিকে বর্জন করতে শুরু করে, ভালোবাসতে শুরু করে সেইসব সাহিত্যিকদের উপন্যাসের নায়ক-নায়িকাদের সংস্কৃতিকে। ধীরে ধীরে আমাদের সংস্কৃতি এমনই এক আজীব সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে যে, মুসলমানরা তাদের নিজেদের সংস্কৃতির অংশ দাড়ি, টুপি, পর্দা দেখলে অস্বস্তিবোধ করতে শুরু করে। পর্দানশীল নারীদের পদে পদে থমকে যেতে হয়। বিখ্যাত আফ্রিকান লেখক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আধিপত্যবাদীদের  নীতির সর্বশেষ বিজয় অর্জিত হয় তখনই যখন অধীনস্থজনেরা আধিপত্যবাদের গুণকীর্তন করে’ (ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড, নগুগী ওয়া থিয়েঙ্গো, পৃষ্ঠা-৩৪। ধর্মের নামে জনগণের ওপর নির্যাতন, শোষণের বিরুদ্ধে প্রগতিশীলরা লড়াই করবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু আজ প্রগতিশীলতার অর্থই যেন দাঁড়িয়েছে নিজের সংস্কৃতিকে ঘৃণা করে, ভিন্ন রঙে নিজেকে সাজানো, আধিপত্যবাদীদের আধুনিকতা নামক প্রজেক্টে হারিয়ে যাওয়া। আমাদের প্রগতিশীলতার রূপ কেমন হবে তা আমরা নির্ধারণ করি না, করে দেয় অন্য কেউ।
একটা সমাজে যখন ভিন্ন মতাদর্শের গোষ্ঠীকে খারিজ করে দেয়া হয় তখন বিচ্ছিন্নতাবাদের সৃষ্টি হয়। একথা আমদের সবাইকে মনে রাখা দরকার যে মতাদর্শিক বিরোধ যত তীব্রই হোক পরস্পরের নির্মূল করার বাসনাতে একমাত্র সমাধান, এই ভাবনা উভয়পক্ষের জন্য বিনাসী ও মারাত্মক।  সম্প্রতি হেফাজতে ইসলাম তাদেও ১৩ দফা বাস্তবায়নের দাবি জানানোর পর নানা মহল থেকে আমরা এর বিরোধিতা করতে দেখি। হেফাজতে ইসলামের দেয়া ১৩ দফা দাবির সবক’টি আমি নিজেও সমর্থন করি না। তাদের কয়েকটি দাবি আমার কাছেও যথার্থ মনে হয়নি। উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে মেয়েদের সমান অধিকারের কথা উঠেছে। মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী সম্পদ বণ্টন হলে কিংবা উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে মেয়েদের সমান অধিকারের আইন করা হলে   নারীদের কিছু যাবে আসবে না। আধুনিক রাষ্ট্রে আইন করে কোন বাবাকে কোন সম্পত্তি বণ্টনে বাধ্য করা যাবে না। আজও বাংলাদেশে অনেক নারী তাদের পিতৃসম্পদ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়ে থাকে। সুতরাং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মনোজগতের পরিবর্তনের সামাজিক আন্দোলন না হলে কোনো আইনই সম্পদে নারীর অধিকার নিশ্চিত করবে না। ১৩ দফার এক জায়গায় হেফাজতে ইসলাম নারীদের শালীনতার সঙ্গে চলার দাবি রেখেছে। যে দেশে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও  শালীনতার সঙ্গে চলা সত্ত্বেও নারীরা ধর্ষিত  হয়ে থাকে, যে দেশে নারী  নির্যাতনকারীরা ক্ষমতার দাপটে প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে ঘুরে বেড়ায় সেই দেশে অপরাধের গোড়ার বিষয়, রোগের মূল কারণ নিয়ে কথা না বলে, নারীদের শালীনতার সাথে চলার দাবি তাই আমার মনে কোনো আবেদন সৃষ্টি করেনি। তবে দুটি ভিন্ন কারণে এ দাবিটি উল্লেখযোগ্য।
প্রথমত, হেফাজতে ইসলাম ব্যাখ্যা করেছে: শ্লীলতা বলতে তারা বুঝিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মতো বেশভুষা বজায় রেখে চলতে। অর্থাৎ তারা নারীদের বোরখা পরার কথা বলেননি, শালীনতার সাথে চলতে বলেছেন। দ্বিতীয়ত, প্রায় সব মিডিয়ায়, নানা টকশো’তে হেফাজতে ইসলামের দাবি মানা হলে নারীদের বোরখা পরতে হবে এমন বক্তব্য আমরা শুনেছি। এখানেও দুটো বিষয় লক্ষণীয়। একটি হলো ইসলাম সম্পর্কে মানুষের ভীতি ও ভীতি বাড়ানোর প্রক্রিয়া। দ্বিতীয়টি হলো, তাদের ভাষা বুঝতে আমাদের ব্যর্থতা, ভিন্নভাবে বললে হেফাজতে ইসলামের ব্যর্থতা তাদের ভাষা আমাদের বোঝাতে অর্থাৎ একটি সংযোগহীনতা, বিচ্ছিন্নতা। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আমাদের দেশে এমন বিশাল একটি জনসমষ্টি রয়েছে যাদের ভাষা বা মন আমরা পড়তে পারি না বা পড়তে চাই না। যা কিছ আমরা অপছন্দ করি তা  বুঝতে বা শুনতে না চাইলেই সমাজে সে চিন্তার অবসান ঘটে না বরং চিন্তা দিয়েই চিন্তাকে মোকাবিলা করা জরুরি। মনে রাখা দরকার, একটি নারী নির্যাতনের ঘটনার প্রেক্ষিতে আমাদের প্রধানমন্ত্রীও আমাদের শালীনতার সাথে চলতে বলেছিলেন। তখন আমরা কেউ এই বিষয়ে বিতর্ক করিনি।
আমরা নাস্তিক-আস্তিক্যবাদ বিষয়ে অসহিষ্ণুতার বীজের সন্ধান করছি, আর তা করতে হলে বাংলাদেশের মার্কসবাদ প্রসঙ্গ এসেই পড়ে। আমাদের মার্কসবাদীরা নাস্তিক্যবাদকে উৎসাহ দেয়। কালমার্কসের সেই উদ্ধৃতি আমরা বারবার মাকর্সবাদীদের কাছে শুনতে পাই, ‘ধর্ম হচ্ছে জনগণের জন্য আফিম’। আফিম যে যুগে আফিম হয়েছিল সে যুগের ডাক্তারিশাস্ত্রে আফিমের অর্থ ইতিবাচক, বেদনানাশক অর্থে। তখন কাটাছেড়া অপারেশনে এনাসস্থেসিয়া হিসাবে আফিমের বাইরে বিজ্ঞান বিকশিত হয়নি। তাই সে যুগের সার্জারি ডাক্তারিশাস্ত্রে আফিমের অর্থ খুবই ইতিবাচক বেদনানাশক। পরে আফিমভিত্তিক বেদনানাশকের দিন শেষ হওয়ার পর আফিম আগেও যেমন নেশার বস্তু হিসাবে সামাজিক পরিচয় ছিল কেবল সে অর্থটাই থাকল। ফলে ‘ধর্ম হচ্ছে জনগণের জন্য আফিম’ একথার অর্থ এটা নয় যে, ধর্ম মানুষকে নেশায় ডুবিয়ে বাস্তববোধসম্পন্নহীন বুঁদ করে রাখে। বরং এ কথার অর্থ হচ্ছে, দুনিয়া, সমাজজুড়ে অনাচার বেইনসাফিতে সেই নিষ্পেষণ বা সাফারিংয়ের কষ্ট থেকে উপশম, রাষ্ট্র শ্রেণী শোষণের অবিচারের ব্যথা মুক্তি হিসাবে ধর্ম ইতিবাচক কাজ করে থাকে। দুনিয়ায় বিচার না পেয়ে আল্লাহর কাছে বিচার চেয়ে ফরিয়াদ। আল্লাহ বিচার করবেন, একটা ইটারনাল ল তাকে ইনসাফ দিবে। এই শেষ ভরসা বিশ্বাসটুকু না থাকলে অবিচারের দুনিয়ায় মানুষের হতাশা মুক্তির একটাই উপায় থাকে সম্ভবত আত্মহত্যা। এসবের পাশাপাশি মার্কস তো ধর্মকে পর্যালোচনার কথাও বলেছেন। মার্কস ধর্মকে আগাগোড়া বাতিল করে না দিয়ে পর্যালোচনার কথা বলেছেন। তিনি এই কথার মধ্য দিয়ে বলেছেন, ধর্মের পর্যলোচনার কাজটি না করলে যুগে যুগে ধর্মন্ধরা ধর্মকে পুঁজি করেই বেঁচে থাকবে। যারা ধর্ম-কর্ম করেন না, কিংবা যারা আধা নাস্তিক বা নাস্তিক্যবোধে উজ্জীবিত তারাও বিপদে পড়লে, অসহায় অবস্থায় আল্লাহকে ডাকেন। যে যত বেশি অসহায় সে তত বেশি আল্লাহকে স্মরণ করেন। মূলত আমাদের মাদরাসা কেন্দ্রিক হুজুরেরা, আধপেটে খেয়ে বড় হওয়া মাদরাসার ছাত্ররা দরিদ্রতা, অসহায়ত্ব থেকে মুক্তি পেতে এখনও গরিব অসহায় মানুষকে নৈতিক সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন। তাই যখন কেউ তার শেষ সম্বল ধর্ম বা  প্রিয়নবীকে কটাক্ষ করে কথা বলেন তখন সে আর চুপ থাকতে পারে না। মাকর্স এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘একটি সত্তা নিজেকে স্বাধীন গণ্য করতে পারে যদি সে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে পারে... অনিবার্যভাবেই আমার জীবন নিজের বাইরে নিজের ভিত্তি খুঁজে বেড়ায়, যদি আপন জীবন তার নিজেরই সৃষ্টি না হয়’ (কধৎষ গধৎী. ঊধৎষু ডৎরঃরহমং, ঢ়ধমব-৩৫৬)।
নিজের জীবন নিজে গড়ার শর্ত তৈরির মধ্য দিয়েই ধর্মকে মোকাবিলার কথা বলেছেন মার্কস। আমাদের মাকর্সবাদীরা দুঃখজনকভাবে অবহেলিত মানুষকে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়ানোর শর্ত তৈরি করার যুদ্ধ ঘোষণা না করে, যুদ্ধ করছেন ধর্মের বিরুদ্ধে। 
ঔপনিবেশিকতা, ভারতীয় আধুনিক সাহিত্য নিসৃত ইসলাম বিদ্বেষ, ঠা-া লড়াইয়ে বাংলাদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের ব্লকে থাকা, আমেরিকার সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় নেয়া ফরেন পলিসি, ‘মাকর্সবাদীদের’ নাস্তিক্যকে উৎসাহিত করা, পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষায় ন্যস্ত আধুনিকতা সব মিলে আজ এমনই এক অবস্থার সৃষ্টি করেছে যখন মানুষ ধর্মীয় ভাষা শুনলে, দাড়ি-টুপি পরিহিত মোল্যা দেখলেই ভয় পায়, তাদের সন্দেহ করে, নানাভাবে আক্রমণ করে। অন্যদিকে শার্ট-প্যান্ট পড়া কোনো নারী দেখলেই ধর্মভীরু মুসলিমরা তাদের নাস্তিক বলে আখ্যা দেয়। এই নাস্তিক মোকাবিলা করতে পারলেই তারা বিশ্বাস করতে চায় তাদের বেহেশত (প্রতীকী অর্থে যা ইনসাফের আদর্শ জায়গা) নিশ্চিত হয়ে যায়। এক অনাকাক্সিক্ষত অসহিষ্ণুতার অভিজ্ঞতা দেশের মানুষকে প্রতিনিয়ত পরস্পর থেকে পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করছে। সরকারও এ অসহিষ্ণুতার বাইরে নয়, যার পরিণামে আমরা দেখি ৬ই মার্চ মধ্যরাতে, অপারেশন ফ্লাশ আউটের মতো ভয়াবহ ঘটনা। বর্তমান এই অসহিষ্ণু সময়ের  কারণ খুঁজতে গিয়ে, একপক্ষ দোষারোপ করছে শাহবাগের জনজমায়েতকে, আরেকপক্ষ হেফাজতে ইসলামকে। মূলত এই অসহিষ্ণুতার  শর্ত তৈরি হয়েছে আরও আগে। শাহবাগের জনজমায়েত কিংবা হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ শুধু উপসর্গ মাত্র। নিজেদের স্বরূপ-ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে তাই দৃষ্টি আর  চিন্তার জগৎ খোলা রাখা জরুরি। তা না হলে আক্রমণ শুধু প্রতি-আক্রমণেরই জন্ম দেবে। হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের ব্যবহার কখনও কাম্য নয়। তবে কোনো মতকে শক্তি দিয়ে দাবিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে এর সমাধান যে আসবে না তা ইতিহাসই আমাদের বলে দেয়। আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটে তা বোঝা, চিন্তাকে চিন্তা দিয়ে বোঝাপড়া করা আজ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ভালোবেসে অন্ধ হওয়া মানুষ প্রেমিকের রূপ কবে চিনেছে, কোন কালে?
হোসে সারা মাগোর একটি বিখ্যাত উপন্যাসের কথা মনে পড়ে যায়। যেখানে একটি দেশে হঠাৎ প্রতিটি মানুষ অন্ধ হতে থাকে। অন্ধত্বে ছেয়ে যায় সারাদেশ। শুরু হয় অন্ধদের প্রেম, হানাহানি। একটি সময় হঠাৎ তারা সবাই ফিরে পেতে থাকে তাদের দৃষ্টি। সদ্য দৃষ্টি ফিরে পেয়ে চক্ষু ডাক্তার তার স্ত্রীকে অবাক হয়ে বলেন, ‘আমরা কেন অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম’? উত্তরে স্ত্রী বললেন, ‘আমার ধারণা আমরা অন্ধ হয়ে যাইনি। আমি মনে করি আমরা অন্ধ। অন্ধ কিন্তু দেখতে পাই। অন্ধ জনতা দেখতে সক্ষম-কিন্তু দেখে না।’
সুজলা সুফলা বাংলাদেশের সর্বরূপ, সব হাসি, সব কান্না আমরা কি আর কখনও দেখতে পাবো না?

No comments

Powered by Blogger.