ভাবের ঘরে চুরি by সাযযাদ কাদির

কিছু-কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা মেলে না বুদ্ধিতে। অনেক ভেবেচিন্তেও কূলকিনারা করতে পারি না সেগুলোর।  বিশ্বাস হতে চায় না, কিন্তু সত্য।
উনিশ শতকের বাংলায় প্রগতি জাগৃতি সংস্কৃতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব রামমোহন রায় (১৭৭৪-১৮৩৩) নেতৃত্ব দিয়েছেন বীভৎস সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার আন্দোলনে, বলেছেন স্ত্রীশিক্ষা ও স্ত্রী-পুরুষ সমানাধিকারের কথা,  দাঁড়িয়েছেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে। ১৮১৪ সালে স্পেনে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের জয়ের সংবাদে উল্লসিত হয়ে তিনি ভোজসভা দিয়েছেন কলকাতার টাউন হলে, ওই বছরই ইতালির বিপ্লবের পরাজয়ের সংবাদ পেয়ে শয্যা নিয়েছেন হতাশ হয়ে, ১৭৮৯-৯৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা হয়ে খোঁড়া পা নিয়েও ফরাসি জাহাজে ছুটে গিয়েছেন ফরাসি বিপ্লবের পতাকাকে অভিবাদন করতে। আবার তিনিই বৃটিশ পার্লামেন্টের সামনে পরম উৎসাহের সঙ্গে বলেছেন, “ইংরেজ জাতির অভিজাত সম্প্রদায় ভারতে উপনিবেশ বিস্তার করলে তার ফল ভারতীয়দের পক্ষে বিশেষ মঙ্গলজনক হবে।” অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে লিখেছেন, “ভারতবাসীর পরম সৌভাগ্য যে, ভগবৎ কৃপায় তারা ইংরেজদের রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে।” এদেশে বৃটিশ উপনিবেশবাদীদের বসবাস ও পুঁজি বিনিয়োগের ঘোর সমর্থক ছিলেন তিনি।
 
    রামমোহন রায়ের পরই উল্লেখ করতে হয় ওই প্রগতি জাগৃতি সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)-এর নাম। তিনি অসামান্য চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন বিধবা বিবাহ প্রচলন এবং বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ বন্ধ করার আন্দোলনে; ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছেন শিক্ষার প্রসারে; সাংখ্য-বেদান্ত প্রভৃতি ভারতীয় দর্শনকে ভ্রান্ত ঘোষণা করে এগুলির প্রভাব দূর করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার; ঈশ্বর, ধর্ম প্রভৃতি সম্পর্কে দিয়েছেন নির্মোহ অবস্থানের পরিচয়। আবার তিনিই পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষা যেন সীমাবদ্ধ থাকে উচ্চ শ্রেণী (মধ্য শ্রেণী)-র মধ্যে, কোনও উৎসাহ দেখান নি সর্বশ্রেণীর মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে। সংস্কারমুক্ত হওয়া সত্ত্বেও জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে কোনও আন্দোলন পরিচালনা করেন নি বিদ্যাসাগর, যদিও তাঁর তৎপরতার ফলেই সংস্কৃত কলেজে অব্রাহ্মণ ছাত্ররা পেয়েছিল ভর্তি হওয়ার সুযোগ। এছাড়া লোকাচারের দোহাই দিয়ে তিনি বিরোধিতা করেছেন শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার, বাল্যবিবাহ রদের প্রস্তাবিত আইনে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন ধর্মীয় আচার লঙ্ঘন না করার। বিদ্রোহী সিপাহিদের দমনে নিয়োজিত বৃটিশ বাহিনীর থাকার জন্য বিদ্যাসাগর ছেড়ে দিয়েছিলেন তাঁর পরিচালনাধীন সংস্কৃত কলেজ, সামান্যতম সমর্থনও দেখান নি সিপাহি বা নীল বিদ্রোহের প্রতি।
উনিশ শতকের জাগরণ-ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিদ্যাসাগরের পর উল্লেখ করতে হয় সাহিত্যস¤্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪)-এর নাম। বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিকাশে তাঁর অসামান্য অবদান। প্রথম জীবনে তিনি সমর্থন করেছেন সমাজতন্ত্রের ধ্যানধারণাকে, দাবি করেছেন নারী-পুরুষ সমান অধিকারের, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে চিহ্নিত করেছেন বাংলার কৃষক সমাজের দুর্গতির মূল কারণ হিসেবে। আবার তিনিই শেষ পর্যন্ত ‘ঘোর বিশৃঙ্খলা’ ও ‘ইংরেজদের অমঙ্গল’ আশঙ্কা করে ওই বন্দোবস্ত বিলোপের বিরোধিতা করেছেন, ইংরেজদের বলেছেন ‘ভারতের পরমোপকারী’, ‘জ্বলন্ত অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেওয়া’র আশঙ্কায় মীর মশারফ হোসেনের ‘জমীদার দর্পণ’ নাটকের প্রচার বন্ধ করতে বলেছেন, ‘সমাজ সংস্কারাভিপ্রায়ে নাটক প্রণীত হইলে নাটকে নাটকত্ব থাকে না’ - এই অজুহাতে বিরোধিতা করেছেন দীনবন্ধু মিত্রের “নীলদর্পণ” নাটকের। এছাড়া নারী-পুরুষ সমানাধিকার ও বিধবা বিবাহের বিরোধিতা করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র, সমর্থন করেছেন বহুবিবাহ প্রথাকে। সর্বোপরি বৃটিশ-বিরোধী সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের মতো একটি গণঅভ্যুত্থানকে চিত্রিত করেছেন বিকৃতভাবে। এখানে যোগ করি আরও একটু। বাল্যববাহের বিরুদ্ধে বলে ও লিখেও রবীন্দ্রনাথ নিজে বিয়ে করেছেন বালিকাকে, মেয়েদেরও বিয়ে দিয়েছেন বাল্যকালে। ১৮৮৩ সালে ১০ বছরের কম বয়সী ভবতারিণী (মৃণালিনী)-র সঙ্গে বিয়ে হয় কবির। ১৮৮৬ থেকে ১৮৯৪ সালের মধ্যে পাঁচ সন্তানের জন্ম হয় তাঁদের। বড় মেয়ে বেলা’র বিয়ে হয়েছে ১৪ বছর ৮ মাস বয়সে, মেজ মেয়ে রেণুকা’র হয়েছে সাড়ে দশ বছরে, ছোট মেয়ে মীরা’র হয়েছে সাড়ে ১২ বছরে। এ প্রসঙ্গে ‘রবিজীবনী’র চতুর্থ খ-ে প্রশান্তকুমার পালের প্রাসঙ্গিক মন্তব্যটি উদ্ধৃত করা যায়: “... কেবল কবি নয়, বাঙালি সমাজে তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) ভূমিকা ছিল চিন্তানায়কের। তাই ব্যক্তিস্বার্থে তাঁর সামাজিক ভূমিকা বিস্মরণের ইতিবৃত্তটি কিঞ্চিৎ অস্বস্তিকর।”
রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ হয়তো আমাদের নেই, কিন্তু তাঁদের এবং বিশ্বের বহু মহাপ্রাণ কর্মবীর মনীষীদের ভাবধারায় উজ্জীবিত অনেক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব আছেন আমাদের। বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ, সুশীল প্রভৃতি নানা অভিধায় চিহ্নিত করা হয় তাঁদের।  রাষ্ট্র ও রাজনীতি যখন বৈরিতার বিভাজনে বিপর্যস্ত তখন বৃহত্তর স্বার্থে তাঁরা জাতির বিবেক হয়ে দেখা দেবেন - এমনই আশা করে দেশ ও জনগণ। দুঃখের বিষয় আমাদের প্রগতি জাগৃতি সংস্কৃতির ধারক বাহকদের অনেকেরই ব্যবহার আজ মতান্ধ দলদাস বা রাজলেহীদেরও লজ্জা দেয় যেন। আমি মনে করি জেনেশুনেই বিষ পান করছেন তাঁরা, জনগণকেও পান করাচ্ছেন, গণতন্ত্রের ধ্বজা তুলে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখছেন অম্লান বদনে।
আমাদের এই বরণীয়দের এমন স্ববিরোধিতার ব্যাখ্যা কি? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তাঁরা নিজেদের ‘ভাবের ঘরে চুরি’ করেন নিজেরাই। তাইতো রামমোহন হিন্দু ধর্মের কুসংস্কার ও কু-আচারগুলির বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পৈতে ছাড়েন নি, পিতার মৃত্যুতে আলাদা করে শ্রাদ্ধ করেন কলকাতার বাড়িতে, ইংল্যান্ডে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিয়ে যান ব্রাহ্মণ রাঁধুনি, রক্ষিতা  (সে আবার ‘যবনী’) পোষণের সমার্থক হিসেবে সমর্থন করতেন শৈব বিবাহ, তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসভার একটি ছোট ঘরে বেদ ও উপনিষদ পাঠ করতেন ব্রাহ্মণরা, সেখানে কেবল ব্রাহ্মণরাই যেতে পারতেন আর অহিন্দু বা অন্য জাত ও গোষ্ঠীর সঙ্গে আহার করতেন না কখনও।

No comments

Powered by Blogger.