ধান-পাটের আবাদ কমছে

দেশের প্রধান কৃষিপণ্য ধানের আবাদ কমতে শুরু করেছে। গত দুই বছরে সোয়া লাখ হেক্টর কম জমিতে ধানের চাষ হচ্ছে। প্রধান অর্থকরী ফসল পাটের অবস্থা আরও খারাপ। ২০১০-১১ অর্থবছরের তুলনায় চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরে পাট চাষের এলাকা পৌনে দুই লাখ হেক্টর কমেছে। একই সঙ্গে উৎপাদন কমেছে সাড়ে আট লাখ বেল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রাথমিক হিসাবে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। অন্যদিকে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক চলতি বোরো মৌসুমের উৎপাদন এলাকা হিসেবে একটি জরিপ করেছে। এতে দেখা গেছে, এ বছর লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৭ শতাংশ কম জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে। এই বোরো চাষিরা বিকল্প ফসল আলু, গম, ভুট্টা ও সরিষার দিকে ঝুঁকছেন। অনেক কৃষক শীতকালীন সবজির চাষ বাড়িয়ে দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষক ধান-পাট চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। কারণ, ২০০৯-১০ অর্থবছরের পর থেকে দৃশ্যত কৃষক ফসল বিক্রি করে লাভ তো দূরে থাক, উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না। সরকারি ধান-চাল সংগ্রহের ভুল নীতি ও পাটের আন্তর্জাতিক বাজার মন্দা হওয়ায় কৃষকের দুর্দশা বেড়েছে। ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই বছর ধরেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, কৃষক ধান ও পাটের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচ পর্যন্ত তুলতে পারছেন না। তাঁরা বাধ্য হয়ে অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকছেন। তাঁর মতে, ভুট্টা, গম, আলু ও সূর্যমুখীর মতো অর্থকরী ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি ইতিবাচক। তবে কোনোভাবেই ধানের উৎপাদন কমিয়ে অন্য ফসলের উৎপাদন বাড়ানো ঠিক নয়। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কৃষকের এই লোকসানের কথা নানাভাবে অস্বীকার করলেও গত জানুয়ারিতে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রতি মণ ধান বিক্রি করে কৃষক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনছেন। কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও তা আর হয়নি। খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে অগ্রিম সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ, সংগ্রহের পরিমাণ বাড়ানো ও কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু কোনোটি এবারও বাস্তবায়িত হয়নি। চলতি বোরো মৌসুমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে ৪৭ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এই হিসাবে চাষ হয়েছে ৪৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে। গতকাল পর্যন্ত ৭০ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। চলতি বোরো মৌসুমে সরকার ১০ লাখ টন চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। গত ২ মে থেকে চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত সরকারি গুদামে চাল সংগ্রহের পরিমাণ ছিল মাত্র দুই হাজার ৭৫ টন। এ মৌসুমের জন্য সরকার প্রতি মণ বোরো ধানের দর নির্ধারণ করেছে প্রায় ৭০০ টাকা। কিন্তু উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন বাজারে চালকল মালিকেরা কৃষকের কাছ থেকে প্রতি মণ ধান কিনছেন ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা দরে। ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন কৃষক। ধান-পাটের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত কৃষকের অনেকেই অন্য অর্থকরী ফসলের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। যেমন, দুই বছর ধরে ক্রমাগত গমের উৎপাদন বেড়েই চলেছে। ২০১০-১১ এর তুলনায় চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরে গমের উৎপাদন এলাকা ৬৯ হাজার হেক্টর বেড়েছে। একই সময়ে ভুট্টার উৎপাদন এলাকা বেড়েছে ৮৫ হাজার হেক্টর। সবজি ও পেঁয়াজের উৎপাদন এলাকাও যথাক্রমে ৪৭ হাজার ও আট হাজার হেক্টর বেড়েছে। উৎপাদন কমলে বিপদ বাড়বে: বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে সাত লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত ছিল। বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সাম্প্রতিক পূর্বাভাস বলছে, বিশ্বজুড়ে আবার খাদ্যমন্দার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বিশ্ববাজারে বেশি দাম দিয়ে চাল কিনতে গেলে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলো বড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়বে বলে সংস্থা দুটি সাবধান করে দিয়েছে।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চাল কেনা ঠিক হবে না। ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে ধানের উৎপাদন কম হওয়ায় বিশ্ববাজার থেকে চাল কিনতে গিয়ে প্রায় ১০০ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়েছিল। এতে বাংলাদেশকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত নিয়ে সংকটে পড়তে হয়।
খাদ্যমন্দার পদধ্বনি: গত মার্চে বিশ্বব্যাংক থেকে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ফুড ওয়াচ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে প্রধান খাদ্যপণ্যগুলোর দাম বাড়তির দিকে। চালের দাম গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া বিশ্বের ধনী ও দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে চালের উৎপাদন কমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্ক গত বছরের তুলনায় বেশি করে চাল কিনে রাখছে। এতে চালের আন্তর্জাতিক বাজারে দাম নিয়মিতভাবে বাড়ছে।
বিশ্বের খাদ্য পরিস্থিতির ওপর এফএওর চলতি মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মাসের তুলনায় এ মাসে বিশ্বের খাদ্যপণ্যের দাম দুই পয়েন্ট বেড়েছে। এ ছাড়া ধান-গমসহ বিশ্বের প্রধান প্রধান ফসল উৎপাদনকারী দেশগুলোতে খাদ্যের মজুত কমতির দিকে। অন্যদিকে বৈরী আবহাওয়ার কারণেও প্রধান ফসলগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছে বিশ্বব্যাংক ও এফএও। তারা স্বল্পোন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোকে অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিশ্ববাজারে সবচেয়ে বেশি চাল রপ্তানি করে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। এই দুই দেশের মধ্যে থাইল্যান্ডে চালের দাম এক মাস ধরে প্রতি টন ৫২৫ ডলারে স্থিতিশীল আছে। এই দামে চাল আমদানি করলে প্রতি কেজি চালের দাম দাঁড়াবে ৪৬ টাকা। আর ভিয়েতনামের চালের দাম প্রতি টনে দুই ডলার বেড়ে ৩৭২ ডলার হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.