আল জাজিরার নিবন্ধ: নির্যাতিত নারীদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে!

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নির্যাতিত নারীদের কি বাংলাদেশে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে? সম্প্রতি চট্টগ্রাম, সাভার ও ঢাকায় যেসব নারী ধর্ষিত হয়েছেন তা ১৯৭১ সালের ধর্ষণ ঘটনাগুলোর দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে গিয়ে আড়াল করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও নারী ধর্ষণের বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে এসব কথা অনলাইন আল জাজিরায় লিখেছেন শেলিনা জাহরা জান মোহাম্মদ। তিনি মুসলিম নারী অধিকার নিয়ে লেখালেখি করেন। এ বিষয়ে তিনি ভাষ্যকারও। যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ মুসলিম নারীর একজন তিনি। লিখেছেন ‘লাভ ইন এ হেডস্কার্ফ’ বই। শুক্রবার আল জাজিরার মতামত কলামে ‘দ্য পলিটিক্স অব ভিকটিমহুড ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি আরও লিখেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা নির্যাতিত হয়েছেন, অবিচারের মুখোমুখি হয়েছেন তাদের সুবিচার পাওয়া এখনও অনেক দূর। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এইসব নির্যাতিত- বিশেষ করে নারী ও সংখ্যালঘুরা এখন কিভাবে রাজনীতিতে ব্যবহার হচ্ছেন। এতে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার অপরাধের ও বর্তমানের অন্যায্য অবস্থার শিকার ব্যক্তিরা ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ হারাচ্ছেন। গত ৫ই ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এরপর থেকেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিরোধী দলের যে ১১ জনের বিচার হচ্ছে তাদের সবার মৃত্যুদণ্ড দাবি করা হচ্ছে শাহবাগের আন্দোলন থেকে। ২৮শে ফেব্রুয়ারি ওই আদালত জামায়াতের আরেক নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন অধিকার-এর ৮ই মার্চের তথ্যমতে, সহিংসতায় কমপক্ষে ১৪৩ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। অন্য সূত্রগুলোর মতে, নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬৫তে। আহতের সংখ্যা ৩৮২৮। হতাহতের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি বেসামরিক মানুষ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সঙ্কটের সময় বিশেষ করে যুদ্ধের সময় নারী ও শিশুরা কোন সংঘাতের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও তাদেরকেই বেশি দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের নারী, শিশু ও সংখ্যালঘুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন। কিন্তু বর্তমানেও তাই। এই লেখায় তিনি শাহবাগের আন্দোলনকে কোনভাবেই মিশরের তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করতে রাজি নন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাহরির স্কয়ারের আন্দোলন ছিল একটি দেশের স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে। ঢাকায় আন্দোলন হলো সরকারের নীতির অধীনেই। বিরোধী দলের যেসব নেতার বিচার হচ্ছে ‘বিতর্কিত’ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সেখানে তাদের মৃত্যুদণ্ড চান তারা। শাহবাগের আন্দোলনে উল্লেখ করার মতো নারীর উপস্থিতি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কোন জনসমাবেশে ব্যাপক সংখ্যক নারীর উপস্থিতি একটি ভাল বিষয়। কিন্তু শাহবাগে এত নারীর উপস্থিতি প্রত্যাশিত ছিল। কারণ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক নারী ধর্ষিত হয়েছেন। সরকার, মিডিয়া ও শাহবাগের আন্দোলনকারীরা দাবি করেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ২ লাখ থেকে ৪ লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছেন। তবে অনেক বিজ্ঞজন দাবি করেন, এ সংখ্যা প্রমাণিত নয়। যখন নারীদের দুর্ভোগের এসব কাহিনী ও তাদের নির্যাতিত হওয়ার কথা এড়িয়ে যাওয়া হয় তখন আমাদের জিজ্ঞেস করতে হয়- ১৯৭১ সালের নির্যাতিতরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে? ১৯৭১ সালের ধর্ষণ ঘটনার পূর্বাপর যাচাই না করেই সরকার ও প্রতিবাদীরা এই সংখ্যাকে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। সরকার ও মিডিয়া ’৭১ সালের ধর্ষণের যে সংখ্যা প্রকাশ করেছে তাকে দৃঢ়তার সঙ্গে তারা প্রকাশ করলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাম্প্রতিক সময়ে নারীদের যে অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে তা স্বেচ্ছায় তারা এড়িয়ে গেছেন। ’৭১ সালের ধর্ষণ ঘটনাগুলোতে ফোকাস দিতে গিয়ে তারা চট্টগ্রাম, সাভার ও ঢাকায় সম্প্রতি যেসব ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তিনি লিখেছেন, আমরা দেখতে পাই সমাবেশস্থলে ঘেরাও দিয়ে বিরোধীদলীয় নারী নেত্রীদের ও ছাত্রীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ অবস্থায় বলা যায়, নারীদের অতিমাত্রায় রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ঢাকা প্রেস ক্লাবে প্রতিবাদ করার সময় ওমেনস রাইটস অর্গানাইজেশন-এর নারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৭ই ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রী বিষয়ক শাখার অফিস ঘেরাও করা হয়। সেখান থেকে আবদুল কাদের মোল্লার স্ত্রী সানোয়ারা জাহান সহ ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদেরকে আদালতে তোলার আগে জনসমক্ষে মাথার স্কার্ফ সরিয়ে নিতে বাধ্য করা হয়। গ্রেপ্তার করা ওইসব নারীর মধ্যে ছিলেন একজন বয়োবৃদ্ধ, একজন অন্তঃসত্ত্বা ও দেশের শীর্ষ স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন ছাত্রী। তাদের জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ অভিযোগ না থাকলেও তাদেরকে জেলে পাঠানো হয়েছে। এর  দু’এক সপ্তাহ পরে ওমেন্স রাইটস অর্গানাইজেশন বাংলাদেশ-এর ১৫ সদস্যাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা আটক ওইসব নারী নেত্রীর মুক্তি দাবি করেছিলেন। পাশাপাশি তারা পুলিশের হাতে ওই নেত্রীরা অশোভন আচরণের শিকার হয়েছেন বলে প্রতিবাদ করছিলেন। গত সপ্তাহে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রবিষয়ক নারী সংগঠনের আরও ১৬ ছাত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই ৯ম শ্রেণীর ছাত্রী। সবেমাত্র তারা জুনিয়র স্কুল পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। সাবোটাজের অভিযোগে মধ্য টিনেজ বয়সের এইসব ছাত্রীকে দায়ী করা হয়েছে। তাদের একজনের বাড়িতে জুনিয়র স্কুল পরীক্ষা শেষ করা উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। তখন পুলিশ ওই বাড়ি ঘেরাও করে। তাদের জীবন ও অধিকার লঙ্ঘন করার এটা একটি পরিষ্কার ঘটনা।

No comments

Powered by Blogger.