ছবি দেখে আঁৎকে ওঠেন ব্লেক

অবরোধের আগের সন্ধ্যায় ঢাকায় এসেছিলেন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও’ ব্লেক। বিদায় নিলেন হরতালের দিন সকালে। মাঝখানে পুরো দিনটা কাটিয়েছেন সিলেটে। ব্লেক আগেও তিনবার এসেছেন, এটি তার চতুর্থ সফর।
ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ঢাকা সফরের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। এবার অদ্ভুত এক ঢাকা দেখেছেন তিনি। সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন এখানকার রাজনীতির চরম দু’টি কর্মসূচি। পক্ষে-বিপক্ষে সমর্থকদের তৎপরতা কতটা জোরালো হতে পারে, রাজপথে প্রকাশ্যে কে কত তাণ্ডব চালাতে পারে, কেবল সন্দেহের বশে একজন নিরীহ পথচারীর ওপর কিভাবে হামলা চালানো হয়, মিডিয়ার বদৌলতে সবই দেখেছেন তিনি।
হতভাগা বিশ্বজিৎ দাসের ওপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মীদের আক্রমণ ও কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যার দৃশ্যটি বেশি নাড়া দিয়েছে মার্কিন এ অতিথিকে। তার ভাষায়, ‘আপনাদের অনেক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় এক যুবককে পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলার ছবি দেখে আমি আঁতকে উঠেছি। এটি অত্যন্ত নৃশংস ঘটনা। আমি এ বীভৎসতার নিন্দা জানাই। আশা করি দেশের আইনে অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা হবে।’ কেবল পথচারী বিশ্বজিৎ-ই নয়, অবরোধের দিন সরকারি দলের নেতাকর্মীদের নৃশংস নির্যাতনে বিরোধী দলের আরও তিনজন নিহত হয়েছেন। ব্লেক তাদের করুণ পরিণতির বিষয়টিও সামনে আনেন। বলেন, ‘সামপ্রতিক সহিংস ঘটনায় তিন জনের মৃত্যুতে আমি উদ্বেগ প্রকাশ করছি। আমি সংবাদ মাধ্যমে তাদের পরিণতি দেখেছি।’ উল্লেখ্য, অবরোধের দিনে জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো-ও ঢাকায় ছিলেন। দেশের রাজনীতি ও আসন্ন নির্বাচনের পরিবেশ পর্যবেক্ষণে এসেছিলেন তিনি। অবরোধ চলাকালে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করেছেন। অবরোধকারীদের ঠেকাতে দেশব্যাপী চলা তাণ্ডবলীলা তিনিও প্রত্যক্ষ করেছেন। নৃশংস এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েই ঢাকা ছাড়েন জাতিসংঘের ওই প্রভাবশালী কর্মকর্তা।
ওদিকে রাজনৈতিক বিরোধ নিরসন ও আসন্ন নির্বাচন প্রশ্নে মতপার্থক্য দূর করতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র মধ্যে সংলাপ আয়োজনের তাগিদ দিয়েছেন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও’ব্ল্লেক। বলেছেন, আলোচনার বিকল্প কিছু নেই। দুই দলকে বসেই আগামী নির্বাচনের ফর্মুলা বের করতে হবে। তারা যে সিদ্ধান্তে পৌঁছবেন আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় তা মেনে নেবে। চারদিনের সফর শেষে গতকাল সকালে ভুটানের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ার আগে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মত দেন। রাজধানীর একটি হোটেলে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত এ কর্মকর্তা বিএনপিকে জাতীয় সংসদে ফেরার আহ্বান জানিয়ে বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোন আইন সংশোধনের প্রয়োজন হলে তা-ও সেখানে আলোচনা হতে পারে। এ ধরনের আলোচনায় সহায়তা দিতে ওয়াশিংটন প্রস্তুত রয়েছে বলেও জানান তিনি। দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতায় কোন অরাজনৈতিক শক্তি উৎসাহিত পারে, যদি এমন কিছু ঘটে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকবে কিনা- এমন প্রশ্ন ছিল ব্লেকের প্রতি। জবাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আস্থা ও সমর্থন রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, হাইপথিটিক্যাল কোয়েশ্চেনের জবাব দিতে চাই না। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমার আহ্বান থাকবে- শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজে নেয়ার। সমস্যার সমাধান কিভাবে হবে, তা এখানকার রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই ঠিক করতে হবে। তাদের যে কোন সংলাপ-উদ্যোগে আমাদের দৃঢ় সমর্থন থাকবে। হরতালের সকালে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে ব্লেক বলেন, এ ধরনের কর্মসূচির বিকল্প খোঁজার সময় এসেছে। আমি মনে করি, উভয় দলেরই হরতাল এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। এটি দেশের ভাবমূর্তির ওপর যেমন প্রভাব ফেলে, তেমনি নতুন বিনিয়োগ আনার চেষ্টাকে ব্যাহত করে। বিনিয়োগকারীরা স্থিতিশীলতা, নিশ্চয়তা ও কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ চান। হরতালকে ‘বড় ধরনের সমস্যা’ উল্লেখ করে ব্লেক বলেন, গরিব মানুষ, যারা দিন আনে দিন খায়- তাদের জন্য এ ধরনের কর্মসূচি চরম ক্ষতিকর। বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে বৈঠক ও দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গ্রেপ্তার সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে ব্লেক বলেন, তার গ্রেপ্তার করা নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া জানানো আমার জন্য যৌক্তিক নয়। আমি বলবো, এটা বাংলাদেশের বিচার বিভাগের বিবেচনার বিষয়। প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো হবে বলেও আমরা প্রত্যাশা করবো। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম (টিকফা) চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে ঢাকা এগিয়ে আসবে আশা করে মার্কিন এ কূটনীতিক বলেন, এই চুক্তি সই হলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ার পাশাপাশি যে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা নিরসনে আলোচনার পথ প্রশস্ত হবে। এটি বাংলাদেশের জন্যই বেশি লাভজনক হবে। আশুলিয়ায় পোশাক কারখানায় সামপ্রতিক অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানি নিয়ে উদ্বেগ ও কারখানাগুলোর শ্রম পরিবেশ উন্নয়নের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, তাজরিন ফ্যাশনস-এর মর্মান্তিক ঘটনা বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের জন্য মাইলফলক হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে এমন ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে ব্লেক বলেন, ১১০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে একটি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১৪৬ জন শ্রমিক নিহত হয়েছিল। মর্মান্তিক ওই ঘটনার পর শ্রমিকদের রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছিল। একটি ঘটনা শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তায় আমূল পরিবর্তন এনেছিল। আশা করি তাজরিন গার্মেন্টের ঘটনাও বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় মাইলফলক হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক বিচারকের স্কাইপ সংলাপ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে ব্লেক বলেন, এ বিচার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা জরুরি। দেশের আইনে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ বিচার প্রক্রিয়া চালিয়ে নিতে ট্রাইব্যুনালকে সহযোগিতার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে লিখিত বক্তৃতায় ব্লেক অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে মার্কিন সরকারের আগের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। বলেন, যথাসময়ে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অত্যন্ত যোগ্য একজন ব্যক্তিকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ব্যাপারে আমাদের জোরালো সমর্থন অব্যাহত রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ওই পদে যোগ্য লোক নিয়োগ হলে প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক, বিশেষ করে নারীদের স্বার্থ রক্ষা এবং প্রতিষ্ঠানটির কার্যকারিতা নিশ্চিত হবে বলে আশা করেন তিনি। সাউথ এশিয়ান উইমেন এন্টারপ্রিনারশিপ সিম্পোজিয়ামে অংশ নিতে গত ৮ই ডিসেম্বর ঢাকা সফরে আসেন রবার্ট ও’ব্লেক। চার দিনের এ সফরে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সরকার, বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

No comments

Powered by Blogger.