ধীরে হলেও পুঁজিবাজারে চাঙ্গা ভাব by অপূর্ব কুমার

দেরিতে হলেও সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপে দেশের পুুঁজিবাজারে আস্তে আস্তে স্বস্তি ফিরে আসছে। যদিও বাজারে বিনিয়োগ আগের চেয়ে কম তবুও টানা পতন থেকে ফিরছে দেশের অর্থনীতির বিকাশমান এই খাতটি। এতে পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারীদের মাঝে কিছুটা হলেও আস্থা ফিরছে।


অব্যাহত দরপতনের কারণে বিনিয়োগকারীদের সপ্তাহের শেষ দিনে আর রাস্তায় নামতে হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয় সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি), উভয় স্টক এক্সচেঞ্জ এবং বাজার সংশ্লিষ্টদের ইতিবাচক ভূমিকা গত দুই দিনে সূচকের সঙ্গে লেনদেন বেড়েছে। বাজারের এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের মাঝে প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে। তবে বাজার সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ মনে করছেন, বিনিয়োগকারীদের উদ্বুদ্ধ করে বাজারে ধরে রাখতে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়েছে। এই সাপোর্টে কতদিন বাজার স্থিতিশীল থাকে তা দেখার বিষয়। তাদের অভিমত, বাজারে আস্থা ও তারল্য সঙ্কটের কারণে পতন দ্রুত ঘটছে। এটি রোধে জরুরী ভিত্তিতে বাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়াতে হবে। কারণ পুঁজিবাজার আগের অবস্থানে ফেরাতে তারল্য না বাড়ালে কোন পদক্ষেপই কাজে আসবে না।
দেখা গেছে, গত বুধবারের প্রথম প্রহরে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাধারণ সূচক আগের দিনের চেয়ে ১৫০ পয়েন্ট কমে গেলে অর্থ মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসে। তাৎক্ষণিকভাবে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়। এ ছাড়া সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও বাজারে থাকা মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো বাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে বলে। মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোও বাজার স্থিতিশীল করতে শেয়ার কেনা শুরু করে। একই সঙ্গে পূবালী ব্যাংক লিমিটেডও বাজারে বিনিয়োগের জন্য ৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত বোর্ড সভায় অনুমোদন করে। সর্বোপরি আইসিবির মতো কিছু বড় প্রতিষ্ঠানও শেয়ারের ক্রয়াদেশ বাড়াতে থাকে। এতে বাজার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে। এমনকি যে বাজারে সকালে ক্রেতা ছিল না, মাত্র কিছু সময়ের ব্যবধানে সেখানেই শেয়ার বিক্রির আদেশ পর্যন্ত ছিল না। দিনশেষে সূচক আগের দিনের চেয়ে ৮৯ পয়েন্ট বেড়ে যায়। লেনদেনে অংশ নেয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে যেখানে সকালে মাত্র ৬টির দাম বেড়েছিল, সেখানে দিনশেষে ২২৮ কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়ে যায়। একই অবস্থা বৃহস্পতিবারও দেখা গেছে। ডিএসইতে সূচক আগের দিনের চেয়ে ২ শতাংশ হারে ৮৭ পয়েন্ট বেড়েছে। বিক্রেতার অভাবে বাজারে লেনদেন আগের দিনের চেয়ে কিছুটা কমেছে।
এপ্রিল থেকে উদ্যেক্তা পরিচালকদের শেয়ার ধারণ ইস্যুতে স্থিতিশীল পুঁজিবাজার আবারও অস্থির হয়। বাজার পরিস্থিতি আগের মতোই অশান্ত হয়ে ওঠে। সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে পরিচালকদের কেউ কেউ আদালতের শরণাপন্ন হন। আদালতের রায়ে শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হয়ে ৩৫৬ পরিচালক তাঁদের পদ হারান। বেশিরভাগ পরিচালক শেয়ার কিনলেও কিছু পরিচালক নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে বাজারে অস্থিরতা বাড়িয়ে দেন। ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ বিনিয়োগকারী। যদিও অনেক পরিচালক রিট দায়ের করেও শেয়ারের ক্রয়াদেশ দেন। এনসিসি ব্যাংকের পরিচালক নুরুল ইসলাম এসইসির কাছে শেয়ার কেনার সময় বাড়ানোর আবেদন করেন। আবার তিনি শেয়ার কেনারও আদেশ দেন। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল এমপিও ২ সিসির বিরুদ্ধে গত ২২ মে আদালতে রিট করেন। আদালত রিটটি খারিজ করে দেয়। এভাবে বাজারে বিনিয়োগকারী, পদ হারানো পরিচালক, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, স্টক এক্সচেঞ্জ এবং এসইসির মধ্যে টানাপড়েন চলতে থাকে। এসইসির দৃঢ় পদক্ষেপও ক্ষতিগ্রস্তদের সুদ মওকুফ এবং প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) কোটা বরাদ্দেও কোন কাজে আসেনি। সেই সঙ্গে নতুন অর্থবছরের বাজেটে বাজারকে স্থিতিশীল করতে কালো টাকা সাদা করাসহ বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়। তবুও বাজারের দ্রুত পতন ঘটতে থাকে। মাত্র তিন মাসের মধ্যে বাজারে সাধারণ সূচক ১৩৩৮ পয়েন্ট কমে যায়। ১৭ এপ্রিল ডিএসইতে সাধারণ সূচক ছিল ৫৫০৪ পয়েন্ট। সেখানে বৃহস্পতিবার তা দাঁড়ায় ৪১৬৪ পয়েন্টে। ১৭ এপ্রিলে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ১৩ কোটি টাকা। সেখানে বৃহস্পতিবার লেনদেন হয়েছে মাত্র ১৮৫ কোটি। এই সময়ে বাজার মূলধন কমেছে ৪ হাজার কোটি টাকা। যদিও এই সময়ে বেশ কয়েকটি নতুন কোম্পানির শেয়ার বাজারে ঢুকছে। শুধু তাই নয়, পদ হারানো পরিচালকদের নেতিবাচক আচরণ ও তারল্য সঙ্কটের কারণে বাজারে আসা নতুন কোম্পানিগুলোও ইস্যু মূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রাইমারি মার্কেটও।
গত ২০১০ সালের ভয়াবহ পতনের ক্ষত না শুকাতেই টানা পতনে দেরিতে হলেও সরকার নড়েচড়ে বসে। সংসদ ও সংসদের বাইরে, বিভিন্ন টক শো, সেমিনার ও সমাবেশে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরেন। তবুও সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। যদিও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা কিছুটা পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বিভিন্ন সময়ে পুঁজিবাজার নিয়ে ঢালাও মন্তব্য করলেও তাঁর মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংক, আইসিবি ও এসইসিকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দেয়। এ ছাড়া এসইসি, পুঁজিবাজার এবং পদ হারানো পরিচালকরদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়। বাজার সংশ্লিষ্টদের আরও সতর্ক থাকারও নির্দেশ দেয়া হয়। পরিস্থিতি এমনটাই বদলেছে যে, আদালতে যাওয়া আব্দুল জলিল এমপিও বৃহস্পতিবার নিজ ব্যাংকের ২২ লাখ ৫০ হাজার শেয়ার কেনার ঘোষণা দেন। এতেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সরকার সচেষ্ট এবং হাই কমান্ডও চায় দ্রুত বাজার স্বাভাবিক হোক। আর কোন বিনিয়োগকারী যেন নতুন করে আত্মহত্যা না করে, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণে আওয়ামী লীগ সরকার ব্যর্থÑ এই অপবাদ ঘুচে যাক।
গত কয়েকদিনে বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগ বাড়াতে বলে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আইসিবিকে ৫০০ কোটি ঋণ দেয়া হয়। এ ছাড়া গত ২২ মাসে বাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে কোম্পানির উদ্যেক্তা পরিচালকদের ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ বা সম্মিলিতভাবে মোট পরিশোধিত মূলধনের ৩০ শতাংশ ধারণ করার নির্দেশনা দেয়। এছাড়া এসইসির চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্বস্ত করতে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে আহ্বায়ক করে বিশেষ স্কিম কমিটি গঠন করা হয়। তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনাও ঘোষণা করা হয়। এতেও কাজ হয়নি। পুঁজিবাজার দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। যদিও সমালোচকরা বলে থাকেন, এটি অনুৎপাদনশীল খাত। সরকার ও বেসরকারী খাতের কোম্পানিগুলো পাবলিক মার্কেট থেকে পুঁজি সংগ্রহের এটি বড় একটি খাত। ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে ডিএসই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে ১৬৯ কোটি টাকা আয়কর দিয়েছে। এ ছাড়া চলতি বছরে ডিএসইতে ১২ নতুন কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের মাধ্যমে বাজার থেকে ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। জানা গেছে, এসব কোম্পানির উত্তোলনকৃত প্রায় ৭০ শতাংশ টাকা ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে ব্যয় করেছে। এতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হচ্ছে। কিন্তু ঢালাওভাবে পুঁজিবাজার নিয়ে অনেকেই নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন চট্টগ্রাম স্টক একচেঞ্জের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফখরুদ্দীন আলী আহমেদ। তিনি বলেন, বাজার থেকে টাকা নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ভিত শক্ত করছে। তাই বাজারকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। পুঁজিবাজারকে আরও শক্তিশালী করার মাধ্যমেই দেশের অর্থনীতির ভিত আরও মজবুত করা সম্ভব।
বাজারে স্থিতিশীলতার বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফায়েকুজ্জামান বলেন, বাজারকে প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দিতে আইসিবি কাজ করছে। তবে অন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে এলে পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটবে। তিনি মনে করেন, সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়িত হলে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

No comments

Powered by Blogger.