মাহমুদুর রহমানের মন্তব্য প্রতিবেদনঃ ভারতের ভূমি আগ্রাসন

ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং দুই দেশের মধ্যকার অমীমাংসিত বিষয়গুলোর ওপর আমার তিন কিস্তির লেখার প্রথম কিস্তিতে ফারাক্কা বাঁধ পরীক্ষামূলকভাবে চালু সম্পর্কিত ভারতীয় প্রতারণার ঘটনা উল্লেখ করেছিলাম। দ্বিতীয় কিস্তি আরম্ভ করছি বেরুবাড়ী নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রতারণার কাহিনী বর্ণনা করে।
১৯৭৪ সালের ১৬ মে দিল্লিতে শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবিষয়ক যে চুক্তি সম্পাদিত হয়, তার ১নং ধারার (Article 1) ১৪নং উপধারাটি ছিল বেরুবাড়ী সংক্রান্ত।
উপধারাটি নিম্নরূপ:
"India will retain the southern half of South Berubari Union No. 12 and the adjacent enclaves, measuring an area of 2.64 Square miles approximately, and in exchange Bangladesh will retain Dahagram and Angorpota enclaves. India will lease in perpetuity of Bangladesh an area of 178 metres 85 metres near `Tin Bigha' to connect Dahagram with Panbari Mouza (P.S. Patgram) of Bangladesh.
(ভারত দক্ষিণ বেরুবাড়ী ইউনিয়ন নং ১২-এর দক্ষিণার্ধ এবং সংলগ্ন ছিটমহলসমূহ যার আয়তন প্রায় ২.৬৪ বর্গমাইল তার অধিকারে রাখবে এবং বিনিময়ে বাংলাদেশ দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহল তার অধিকারে রাখবে। ভারত চিরস্থায়ী লিজের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে তিনবিঘার কাছে ১৭৮ মিটার ৮৫ মিটার জায়গা প্রদান করবে যাতে দহগ্রাম বাংলাদেশের পানবাড়ী মৌজার [থানা পাটগ্রাম] সঙ্গে সংযুক্ত হয়।)
চুক্তির ৫নং ধারায় (Article 5) চুক্তি কার্যকর ও বাস্তবায়নের নিম্নোক্ত পন্থা বর্ণিত হয়,
"This instrument shall be subject to ratification by the Governments of India and Bangladesh and instruments of ratification shall be exchanged as early as possible. The Agreement shall take effect from the date of the exchange of the Instruments of Ratification."
(এই দলিলটি ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদনসাপেক্ষ এবং অনুমোদনের একটি দলিল উভয় পক্ষের মধ্যে যত দ্রুত সম্ভব বিনিময় করা হবে। অনুমোদন দলিল বিনিময়ের তারিখ থেকে
এই চুক্তি বলবত্ হবে।)
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি ‘সরল’ বিশ্বাসে শেখ মুজিবুর রহমান চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭৪ সালের ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে চুক্তি অনুমোদন করিয়ে নেন। এখানে উল্লেখ্য, শেখ মুজিবুর রহমানের সেই সংসদও বর্তমান সংসদের অনুরূপ প্রায় একদলীয় ছিল। সংবিধান (তৃতীয় সংশোধন) আইন, ১৯৭৪ পাঠকের জ্ঞাতার্থে এখানে আংশিক উদ্ধৃত করছি—
“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও প্রজাতন্ত্রী ভারত সরকারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি কার্যকর করিবার উদ্দেশ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের কতিপয় বিধানের অধিকতর সংশোধনকল্পে প্রণীত আইন।
যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও প্রজাতন্ত্রী ভারত সরকারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি কার্যকর করিবার উদ্দেশ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের কতিপয় বিধানের অধিকতর সংশোধন সমীচীন ও প্রয়োজনীয়;
সেইহেতু এতদ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল :-
১. সংক্ষিপ্ত শিরনামা ও প্রবর্তন।—(১) এই আইন সংবিধান (তৃতীয় সংশোধন) আইন, ১৯৭৪ নামে অভিহিত হইবে।
(২) ৩ ধারা ব্যতীত ইহা অবিলম্বে বলবত্ হইবে এবং ৪ ধারার অধীন বিজ্ঞপ্তিতে বর্ণিত তারিখে ৩ ধারা বলবত্ হইবে।”
মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির ৫ নম্বর ধারায় পরিষ্কার উল্লেখ ছিল যে, উভয় সরকারের অনুমোদনের দলিল বিনিময়ের পরই কেবল চুক্তি বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু, অভাবিতভাবে ভারতের কাছ থেকে সে রকম কোনো অনুমোদন দলিল কিংবা তিনবিঘা করিডোরের চিরস্থায়ী লিজ প্রাপ্তি ব্যতিরেকেই ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতার ভারে নতজানু বাংলাদেশের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বেরুবাড়ী ছিটমহল ভারতকে হস্তান্তর করেন। অপরদিকে ভারত তাদের সংসদে বিষয়টি অনুমোদন না করে ঝুলিয়ে রাখে এবং আদালতে মামলার অজুহাতে তিনবিঘা করিডোর আমাদের না দিয়েই বেরুবাড়ী হস্তগত করে নেয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ তার প্রাপ্য তিনবিঘা করিডোরের চিরস্থায়ী লিজ পায়নি।
ড. মনমোহন সিংয়ের সফরের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৬ বছর দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার অধিবাসীদের নিজ গৃহে পরবাসীর মতো গ্লানিকর জীবনযাপন করতে হয়েছে। বছরের পর বছর তারা ছিটমহল থেকে নিজ দেশে আসার জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতির আশায় বসে থেকেছে। বিএসএফ ইচ্ছে হলে অনুমতি দিয়েছে, অধিকাংশ সময়ই দেয়নি। তারপর কয়েক দশকের অনেক দেন-দরবার শেষে দিনের বারো ঘণ্টা বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পেলেও রাতের বারো ঘণ্টা ছিটমহলবাসীকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ থাকতে হয়েছে। নিদারুণ অসুস্থতার সময়ও তারা জেলা হাসপাতালে চিকিত্সার সুযোগ পায়নি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সুবাদে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতায় বাংলাদেশী নাগরিকদের দীর্ঘ তিন যুগের বন্দিত্বের অবসান হয়েছে। তারা এখন থেকে চব্বিশ ঘণ্টাই মূল ভূখণ্ডে যাওয়া-আসা করতে পারবেন। তবে, কারাগারের দরজা খোলা হলেও আমরা চুক্তি অনুযায়ী করিডোরের চিরস্থায়ী লিজ পেয়েছি কিনা, সেটা এখনও দেশবাসীর অজানাই রয়ে গেছে। যে দরজাটি ভারত চব্বিশ ঘণ্টা খোলা রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেটি আবারও বন্ধ হবে কিনা তাও জানি না।
ছত্রিশ বছর ধরে চুক্তি প্রতিপালন না করার অপরাধে যেখানে ভারতের নিন্দা প্রাপ্য ছিল, সেখানে এ দেশের ভারতবান্ধব মিডিয়া, রাজনীতিবিদ এবং সুশীল (?) গোষ্ঠী সামান্য দরজা খোলা নিয়েই ড. মনমোহন সিং ও শেখ হাসিনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন! চব্বিশ ঘণ্টা ছিটমহলের দরজা খোলা রাখাকেই মহাজোট সরকার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের বিরাট সাফল্য হিসেবে বর্ণনা করে চলেছে। কিন্তু যে কোনো বিবেকসম্পন্ন নাগরিকই বুঝবেন ১৯৭৪ সালের চুক্তি অনুযায়ী বিষয়টি কেবল দরজা খোলা অথবা বন্ধ সংক্রান্ত নয়, বেরুবাড়ী দেয়ার পরিবর্তে অতিশয় ক্ষুদ্র করিডোরটি বাংলাদেশের প্রাপ্য অংশ। ভারত আমাদের এতদিন ‘হাইকোর্ট’ দেখিয়ে একতরফাভাবে চুক্তি ভঙ্গ করেছে এবং তিনবিঘা করিডোর হস্তান্তরের পরিবর্তে সেখানে দরজা লাগিয়ে, পাহারা বসিয়ে ছিটমহলবাসীদের বন্দি জীবনযাপনে বাধ্য করেছে। এখন আবার ওদের প্রচার মাধ্যম মারফত শুনতে পাচ্ছি, ছিটমহলের চারদিকে নাকি কাঁটাতারের বেড়াও নির্মাণ করা হবে। প্রকৃতপক্ষে, মানসিক বন্দিত্ব থেকে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতার বাংলাদেশী নাগরিকদের মুক্তি দিতে ‘মহান’ প্রতিবেশী ভারত এখনও নারাজ।
এবার দেখা যাক ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে ভারত ও বাংলাদেশের অন্যান্য ছিটমহলবাসীর দুঃখ-কষ্ট নিরসনে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। চুক্তির এক নম্বর ধারার ১২ নম্বর উপধারাটি নিম্নরূপ,
"The Indian enclaves in Bangladesh and the Bangladesh enclaves in India should be exchanged expeditiously, excepting the enclaves mentioned in paragraph 14 without claim to compensation for the additional area going to Bangladesh."
(১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত ছিটমহল ব্যতীত বাংলাদেশের ভেতরে অবস্থিত ভারতীয় সকল ছিটমহল এবং ভারতের অভ্যন্তরের বাংলাদেশের ছিটমহলসমূহ দ্রুততার সঙ্গে বিনিময় করা হবে এবং বাংলাদেশের অতিরিক্ত ভূমি প্রাপ্তির বিনিময়ে কোনো ক্ষতিপূরণ প্রদত্ত হবে না।)
উদ্ধৃত উপধারায় যে ১৪ অনুচ্ছেদের কথা বলা হয়েছে সেটি দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা সম্পর্কিত, যার আলোচনা এর মধ্যেই করেছি।
মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভারতের তত্কালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং (Swaran Singh) ১৯৭৪ সালের ২২ জুলাই লোকসভায় নিম্নোক্ত বিবৃতি প্রদান করেন—
"The whole of Berubari will remain with India while the Bangladesh enclaves of Dahagram and Angarpota will remain with that country. All other enclaves of the two countries will be exchanged. We will also lease to Bangladesh an area to connect the enclaves of Dahagram and Angarpota with Bangladesh while ensuring that our nationals retain the facility of passage across this area.
As demarcation takes place, territories in the adverse possession of one or the other country will come to light. These will be exchanged; and we have agreed that the people in areas which are transferred will be given the right of staying on where they are as national of the State to which the areas are transferred."
(সম্পূর্ণ বেরুবাড়ী ভারতের অধিকারে থাকবে এবং বাংলাদেশের দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহল তাদের অংশ হবে। অন্য সকল ছিটমহল দুই দেশের মধ্যে বিনিময় করা হবে। আমাদের নাগরিকদের যাতায়াতের অধিকার সংরক্ষিত রেখে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতার সঙ্গে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড সংযোগের জন্য একটি জায়গা লিজ দেয়া হবে। সীমান্ত চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়াকালে দুই দেশের মধ্যে প্রতিকূল অবস্থায় পতিত ভূখণ্ড ক্রমান্বয়ে নজরে আসবে। এই জায়গাগুলো বিনিময় করা হবে এবং আমরা সম্মত হয়েছি যে, জনগণ যার যার জায়গায় অবস্থান করেই ছিটমহল বিনিময় পরবর্তী রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার অধিকার ভোগ করবে।)
একই বছরের ২৬ জুলাই ভারতীয় রাজ্যসভায় প্রশ্নোত্তরকালে তত্কালীন স্টেট মিনিস্টার সুরেন্দ্র পাল সিং (Surendra Pal Singh) রাজ্যসভার সদস্যদের অবহিত করেন যে, ১৯৫৮ সালে সম্পাদিত ভারত ও পাকিস্তানের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরু ও ফিরোজ খান নূন (নেহরু-নূন চুক্তি) এর মধ্যকার সম্পাদিত চুক্তির আলোকেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তিনি রাজ্যসভাকে আরও জানান যে, ছিটমহল বিনিময় সমাপ্ত হলে ভারত এবং বাংলাদেশ যথাক্রমে ৭ ও ৭.২১ বর্গমাইল ভূমিপ্রাপ্ত হবে। (The area thus be retained by India is estimated at approximately 7.0 square miles and the area retained by Bangladesh at 7.21 square miles.)
ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের পর আমরা দেখতে পাচ্ছি, ছিটমহল বিনিময়ের বিষয়টি আগের মতোই হিমাগারে রেখে কেবল তথাকথিত অপদখলীয় জমি হস্তান্তর হচ্ছে। এর ফলে একতরফাভাবে ভারত লাভবান হচ্ছে। এর মধ্যেই আসাম আমাদের ভূখণ্ড থেকে ১২৩৯ একর জমি পেয়েছে যার বিনিময়ে আমরা পেয়েছি মাত্র ৩৫৭ একর জমি। একইভাবে মেঘালয় রাজ্যকে ২৪০ একর জমি ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে আমরা মাত্র ৪১ একর পেয়েছি। আসাম এবং মেঘালয় থেকে আমাদের যত্সামান্য জমি প্রাপ্তি নিয়েও সংশয় রয়েছে। ওই দুই রাজ্যে বিজেপি’র নেতৃত্বে অন্যান্য বিরোধীদল স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ে বাংলাদেশকে জমি প্রদানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছে। তিনবিঘা করিডোর নিয়ে ভারত আমাদের সঙ্গে যে প্রতারণা করেছিল, অপদখলীয় জমির বিনিময় নিয়েও একই প্রকার প্রতারণার আশঙ্কা অবস্থাদৃষ্টে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর কাছ থেকেও এখন পর্যন্ত জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে কোনো দৃঢ় ও পরিষ্কার অবস্থান দেশবাসী দেখতে পায়নি। বৃহত্তর সিলেটের সীমান্ত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণ তাদের সাধ্যমত বিক্ষোভ-সমাবেশ করলেও রাজধানীতে তার কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। ক্ষমতার রাজনীতিতে অভ্যস্ত শাসকশ্রেণী বাংলাদেশের অসহায় নাগরিকদের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে ভারতকে সন্তুষ্ট রেখেই তাদের রাজনীতি করতে অধিকতর আগ্রহী বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। অপদখলীয় জমি বিনিময়ে বাংলাদেশের জনগণ বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে প্রভূত লাভবান হচ্ছেন। আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা এর মধ্যেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাদের সুগভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনাকে এখন ওইসব রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদানেরও প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়েছে। সম্ভবত, আগামী মাস থেকেই আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সেসব ডিগ্রি আহরণ অভিযান শুরু হবে।
নরওয়ের নোবেল কমিটি শেখ হাসিনার মর্যাদা না বুঝলেও ভারত কিন্তু যথাযথ প্রতিদান দিতে কসুর করছে না। অপদখলীয় জমি বিনিময়ের ব্যাপারে শেখ হাসিনা সরকার অতিউত্সাহী হলেও ছিটমহলবাসীদের দীর্ঘ ৬৪ বছরের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কোনো মাথাব্যথা নেই। আর কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্রের ছিটমহলের অসহায়, দরিদ্র মানুষগুলো এখন অহিংস আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছেন। তারা অনশন করছেন, নিষ্প্রদীপ মহড়া করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে ভারত ও বাংলাদেশের উদাসীন শাসকদের দৃষ্টি আকর্ষণের যথাসম্ভব চেষ্টা চালাচ্ছেন।
শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের কাছ থেকে বার বার প্রতারিত হওয়া সত্ত্বেও তারই কন্যা ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা নেবেন না বলে ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছেন। তিনি এবং তার সুপার উপদেষ্টারা ভারত প্রেমে এতটাই বেহুঁশ যে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির কোনো রকম স্বার্থ তারা বিবেচনাতেই আনছেন না। দুই ‘সুপার’ উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ও ড. মসিউর রহমান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি তো প্রেমের পরীক্ষায় আরব্য উপন্যাসের বিখ্যাত মজনুকেও হার মানিয়েছেন। এমন দিওয়ানা শ্রেণীর হাতে রাষ্ট্র কিংবা জনগণের স্বার্থ কোনোটিই নিরাপদ নয়। ভারত শুধু যে সম্পাদিত চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা অবলম্বন করে বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখছে তাই নয়, আমাদের দেশের চারদিক ঘিরে কাঁটাতার নির্মাণের সময়ও তারা আন্তর্জাতিক আইনকে উপেক্ষা করছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী দুই দেশের মধ্যকার ১৫০ মিটার এলাকায় কোনো স্থায়ী স্থাপনা (Structure) নির্মাণ সম্পূর্ণ অবৈধ হলেও ভারত সেটি মানছে না। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় হলো : বিরোধপূর্ণ মুহুরি নদী এলাকায় বাংলাদেশ সরকার ভারতকে মাঝ নদী বরাবর ‘জিরো’ পয়েন্টে বেড়া নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বর্তমান একতরফা অবস্থা এতটাই দৃষ্টিকটু ঠেকছে যে, সরকারপন্থী মিডিয়া পর্যন্ত মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছে।
বাংলাদেশের ইসলামীপন্থীদের আওয়ামী বলয়ে আকৃষ্ট করার মিশনে নিয়োজিত ‘দৈনিক ইনকিলাব’ পত্রিকায় ১৮ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রকাশিত ‘লিড স্টোরি’র শিরোনাম, ‘বাংলাদেশের জমি চলে যাচ্ছে ভারতের অংশে।’ সংবাদটির ‘ইন্ট্রো’ পাঠকদের জ্ঞাতার্থে উদ্ধৃত করছি, ‘সীমান্ত নদী ভাঙনে বাংলাদেশের জমি ভারতের অংশে চলে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নদীমুখে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করে দ্রুততর করা হচ্ছে ভাঙন প্রক্রিয়া। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির অপব্যাখ্যা দিয়ে ভারত এসব জমির নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। আর এসব জমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে বিভিন্ন স্থাপনা, দেয়া হচ্ছে কাঁটাতারের বেড়া।’ ২০০৮ সালের নির্বাচনে অর্থ প্রদানসহ নানা কিসিমের ভারতীয় সহায়তার ঋণ চুকাতে উদগ্রীব সরকারের বিগত তিন বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের স্বার্থ পুরোপুরি উপেক্ষিত থেকেছে। কাজেই এদের আমলে সম্পাদিত কোনো চুক্তিই এ দেশের দেশপ্রেমিক নাগরিকের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
দক্ষিণ তালপট্টিতে ভারতীয় আগ্রাসনের বিষয় অবতারণা করে ড. মনমোহন সিংয়ের সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের প্রেক্ষিতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উপর রচিত মন্তব্য প্রতিবেদনের দ্বিতীয় কিস্তি শেষ করব। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার প্রশাসনিক এলাকার মধ্যে বঙ্গোপসাগরে দক্ষিণ তালপট্টি নামে যে ভূখণ্ডটি ক্রমেই জেগে উঠছে, সেটি র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী বাংলাদেশের অংশ হলেও সামরিক শক্তির জোরে ভারত সেই ভূখণ্ডকে অপদখলে রেখেছে। র্যাডক্লিফ রোয়েদাদে ‘থলওয়েগ ডকট্রিন’ (Thalweg Doctrine) এর মিড-চ্যানেল ফ্লো (mid channel flow)’র নীতিমালার ভিত্তিতে নদী দ্বারা বিভক্ত সীমানায় ভূমির ওপর সার্বভৌমত্ব নির্ধারণের বিষয়টি সাব্যস্ত করা হয়েছে। হাড়িয়াভাঙ্গা (Hariabhanga) নদীতে সেই নীতি প্রয়োগ করলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী দক্ষিণ তালপট্টি নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের ভূখণ্ড। মরহুম জিয়াউর রহমানের শাসনামলেই সর্বপ্রথম বাংলাদেশ দক্ষিণ তালপট্টির ওপর তার সার্বভৌমত্ব দাবি করে। কিন্তু ক্ষমতাশালী ভারতীয় নৌবাহিনী আমাদের কোনো নৌযানকেই ওই এলাকায় যেতে দিচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গ সরকার দক্ষিণ তালপট্টিকে ‘নিউ মুর দ্বীপ’ (ঘব িগড়ড়ত্ব ওংষধহফ) এবং পূর্বাশা নামে অভিহিত করে ভূখণ্ডটিকে তাদের বলে দাবি করছে। ১৯৮১ সালে ভারত সেখানে তাদের পতাকা ওড়ায় এবং একটি অস্থায়ী বিএসএফ ক্যাম্পও প্রতিষ্ঠা করে।
একবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বিশ্ব উষ্ণায়নের (Global warming) প্রতিক্রিয়ায় দক্ষিণ তালপট্টি সম্পূর্ণভাবে বঙ্গোপসাগরের পানির নিচে চলে গেলেও এই অগভীর স্থানে ২৫ থেকে ৩০ বর্গ মাইল বিশিষ্ট ভূমি জেগে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণের সময় তত্কালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের নগ্ন পক্ষপাতিত্বের কারণে সিরিল র্যাডক্লিফ (Cyril Radcliff) সেই সময়কার ব্রিটিশশাসিত ভারত উপমহাদেশের যে সীমানা বিভাজন করেন, তাতে পাকিস্তান পরিষ্কারভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথচ সেই র্যাডক্লিফের অনুসৃত পদ্ধতি অনুযায়ী দক্ষিণ তালপট্টি আয়তনে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র বাংলাদেশের অংশ হলেও বিপুলাকায় ভারত আজ সেটি মানতে সম্মত নয়। ১৯৪৭ সাল থেকেই বাংলাদেশের ভূমিসহ অন্যান্য সম্পদের ওপর ভারতের আগ্রাসী তত্পরতার কখনই অবসান ঘটেনি। একই চিত্র আমরা বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রেও দেখতে পাচ্ছি। খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশেও আমাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় বৃহত্ প্রতিবেশী ভারত বন্ধুসুলভ সহমর্মিতা ও সহযোগিতা প্রদর্শনের পরিবর্তে তাদের আধিপত্যবাদী চেহারাটাকেই স্বাধীনতাত্তোর চল্লিশ বছর ধরে দেখিয়ে এসেছে।
নিজস্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থে ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার বিনিময়ে ভারতকে পুরো দেশটি ইজারা দেয়ার যে বন্দোবস্ত বাংলাদেশের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে, তাকে পরাজিত করেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনা’র প্রমাণ দিতে হবে। জনগণকে উপলব্ধি করতে হবে অতিমাত্রায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফেরিওয়ালারাই বর্তমান সময়ের স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সাম্প্রতিক বক্তব্যের মধ্যেও বৃহত্ ভারতে বাংলাদেশের লীন হয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন ঘটেছে। পাকিস্তানপন্থী রাজাকারদের ১৯৭১-এ পরাজিত করার বিরোচিত ইতিহাস থেকেই বর্তমানের ভারতপন্থী রাজাকারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রেরণা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে দ্বিতীয় কিস্তি সমাপ্ত করছি।

No comments

Powered by Blogger.