মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট- দুর্দশা কাটিয়ে কার্যকর কল্যাণ সংস্থা হয়ে উঠুক

দেশের স্বাধীনতার জন্য যাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন, তাঁদের পরিবারদের কল্যাণের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট এখন যেন এক মূর্তিমান হতাশা। এ ট্রাস্টের দুর্দশার বিশদ চিত্র ফুটে উঠেছে ২০ ডিসেম্বর প্রথম আলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে।
প্রতিষ্ঠার পরপরই মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে সরকার ৩২টি শিল্প-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানা দিয়েছিল। অর্থাত্ ট্রাস্টের সম্পদের পরিমাণ ছিল বিরাট, আর্থিক প্রবৃদ্ধির সুযোগ-সম্ভাবনাও ছিল বিশাল। শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অবদান রেখেছিলেন, তাঁদের সবার জন্য বিভিন্ন মাত্রার আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার মৌলিক অর্থনৈতিক ভিত্তি ট্রাস্টের ছিল। সে অর্থে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টই হতে পারত মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণকারী মূল সংস্থা। বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে যে দাবিদাওয়া সরকারের দরবারে পেশ করা হয়, তার প্রয়োজন হতো না যদি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট তার মালিকানাধীন শিল্প-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সফলভাবে পরিচালনা করে প্রচুর আয় করতে পারত। শুধু তা-ই নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানসন্ততিদের শিক্ষাগত যোগ্যতাভেদে ওই সব প্রতিষ্ঠানে প্রচুরসংখ্যক কর্মসংস্থানও হতে পারত। ১৯৯১ সালে ঢাকার মিরপুরে প্রতিষ্ঠিত ট্রাস্ট আধুনিক হাসপাতালটি হতে পারত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোর জন্য বিশেষ হাসপাতাল, যেখানে স্বল্প খরচে তারা চিকিত্সাসেবা পেতে পারত।
দুঃখের বিষয়, এহেন সম্পদশালী সংস্থাটি এখন ঋণগ্রস্ত; বিভিন্ন ব্যাংকে এর মোট ঋণের পরিমাণ সোয়া শ কোটি টাকারও বেশি। কীভাবে এমন দুর্দশায় পৌঁছাল মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, তারই বিবরণ রয়েছে প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদনে। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন সরকারের, বিশেষত সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদ ও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ট্রাস্টের বিরাট ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা গ্রহণের অল্প সময়ের মধ্যেই এরশাদ সরকার ১৯৮৩ সালে ট্রাস্টের মালিকানাধীন সাতটি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি মালিকদের কাছে বিক্রি করে দেয়; বন্ধ করে দেয় আরও ছয়টি প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৩ সালে বিএনপির সরকার মিরপুরে ট্রাস্ট আধুনিক হাসপাতালটি ইজারা দেয় ইসলামি উম্মাহ করপোরেশন নামের এক প্রতিষ্ঠানকে। ২০০১ সালে ট্রাস্টের মালিকানাধীন লাভজনক প্রতিষ্ঠান ঢাকার গুলিস্তান প্রেক্ষাগৃহটি তত্কালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর যোগসাজশে বিক্রি করে দেওয়া হয় বিএনপির এক নেতার কাছে। তাবানী বেভারেজ নামে ট্রাস্টের সবচেয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠানটি ২০০১ সালেও লাভ করেছিল ২৫ কোটি টাকা। স্বার্থান্বেষী মহলের চেষ্টা ছিল কারসাজি করে বেনামে সেটি কিনে নেওয়ার। তা ঘটেনি বটে, কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস করে, অবশেষে লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বন্ধ করা হয়েছে ২০০৮ সালে।
ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতিপ্রবণতার পাশাপাশি ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, এর অধীনস্থ শিল্প-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীর অভাব ইত্যাদিও ট্রাস্টের সার্বিক দুর্দশার পেছনে কাজ করেছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে মনোযোগী, তাঁদের কল্যাণার্থে নানা উদ্যোগ নিয়েছে এই সরকার। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের দুর্দশা দূর করে একে আবারও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করানোর ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী। এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেছে, যার সভাপতি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। আমরা আশা করব, এই ট্রাস্টি বোর্ড মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে একটি শক্তিশালী, দক্ষ, উপার্জনক্ষম ও কল্যাণকারী সংস্থা হিসেবে দাঁড় করানোর কার্যকর উদ্যোগ নেবে। ট্রাস্টের সম্পদ লুটপাটের ঘটনাগুলো তদন্ত করে আইনানুগ পন্থায় সেগুলো পুনরুদ্ধারের চেষ্টাও করা উচিত।

No comments

Powered by Blogger.