বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যা: ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করাই কি সমাধান? by তাফসীর বাবু

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে গল্প করছিলেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। আলোচনার বিষয় বুয়েটে সংগঠনভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রসঙ্গ।
বুয়েটের পর এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও কি একইভাবে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত?
এমন প্রশ্নে কিছুটা দ্বিধান্বিত দেখা যায় কয়েকজনকে। একজন সাংবাদিককে প্রকাশ্যে এ বিষয়ে নিজের মত জানাতে ভয় পাচ্ছিলেন তারা।
সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনেই কথা হয় আলী নাসের খান নামে আরেকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তিনি অবশ্য প্রকাশ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বললেন।
কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের যে 'রাজনীতি', সেটা নিষিদ্ধের পক্ষপাতি নন তিনি। কারণ এতে করে 'নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে না' এবং 'মত প্রকাশের অধিকার ক্ষুন্ন হবে'।
একইরকম মনোভাব আরো কয়েকজন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাওয়া গেলো।
একজন নারী শিক্ষার্থী বলছিলেন, "বুয়েটে শিক্ষার্থীরা যেভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে সংগঠনভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করলো, তাদের দাবিগুলো আদায় করলো এটাও তো একটা রাজনীতি। আমরা এই রাজনীতিটাই চাই। এটা বন্ধ হয়ে গেলে তো প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে যাবে।"

দলীয় ছাত্র রাজনীতি'র প্রতি ক্ষোভ কেন?

রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন-ভিত্তিক দলীয় রাজনীতির বিপক্ষে শিক্ষার্থীদের কারো কারো যে একটা অবস্থান দেখা যাচ্ছে তার মূল কারণই হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা মনে করছেন এই রাজনীতি আদতে তাদের কোন কাজে আসে না।
এক্ষেত্রে অবশ্য ঘুরে ফিরে ছাত্রলীগ আর ছাত্রদলের নামই আসছে।
বলা হচ্ছে, গত প্রায় ত্রিশ বছর ধরে দুটি দলই তাদের মূল রাজনৈতিক সংগঠনের এজেন্ডা বাস্তবায়নেই কাজ করেছে।
টিএসসিতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রী বলছিলেন, "এখন যে ছাত্র রাজনীতি আছে সেটা হচ্ছে ছাত্রলীগের লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি। এই লেজুড়বৃত্তি কখনোই ভালো কোন ফল বয়ে আনে না। এটা তো আসলে ক্ষমতাসীনদের তেল দেয়ার রাজনীতি, তাদের স্বার্থসিদ্ধির রাজনীতি। এটা ছাত্রলীগের আমলে হোক আর ছাত্র দলের আমলে হোক। এটা সবসময়ই তাদের মাদার পার্টিকেই সার্ভ করে।"
একদিকে শিক্ষার্থীদের ইস্যু নিয়ে দলগুলোর কথা না বলা অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের উপর নির্যাতন চালানো, দুর্নীতি, হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন কারণে ছাত্র সংগঠনগুলোর উপর আস্থা কমে আসছে শিক্ষার্থীদের।

পরিস্থিতি এরকম হওয়ার দায় কার?

ছাত্রদল বা ছাত্রলীগ কোন সংগঠনই অবশ্য ছাত্র রাজনীতির বর্তমান অবস্থার জন্য দায় নিতে নারাজ।
দুটি সংগঠনই বলছে, দলের ভেতর থেকে যারা বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত হয়েছে, এর দায় অপকর্মকারী ব্যক্তির, দলের নয়।
যারা সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে দল থেকেই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান বলছেন, "দলের ভেতরে কিছু অনুপ্রবেশকারী কিংবা অতিউৎসাহী কেউ কেউ দলের বিভিন্ন অন্যায়ে জড়িত হয়ে পড়ছে। এর দায় তাদের। আমরা এখন সতর্ক আছি, কেউ যেন কোন অপরাধ কিংবা বিশৃংখলার সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ে।"
অন্যদিকে ছাত্রদলের সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন বলছেন, তাদের নতুন কমিটি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তাদের সব কর্মসূচিই আবর্তিত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে ঘিরে।
তবে দলীয় কর্মীদের অপরাধপ্রবণতা আর দলীয় ছত্রছায়ায় আধিপত্য বিস্তারের যে ধারা তার দায় ঐ দলগুলোকেই নিতে হবে বলে মনে করছেন বাম ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সহ সাধারণ সম্পাদক সুমাইয়া সেতু।
"কোন অপরাধ সংঘটিত হলে তারা এখন খুব সহজেই নিজেদের কর্মীদের অস্বীকার করছে। অতীতে ছাত্রদলও একই কাজ করেছে। কিন্তু অস্বীকার করেই কি দায় এড়ানো যায়? তাদের যেসব নেতা-কর্মী নিপীড়ন করছে, খুন করছে, দুর্নীতি করছে সেগুলো তো একদিনে হঠাৎ হয়নি।"
মিজ সেতু বলছেন, "আমি বলবো তাদের দলের মধ্যেই এমন নীতি-কৌশল রয়েছে যার ফলে এ ধরণের নেতা-কর্মী তৈরি হচ্ছে। তারা সবসময়ই বিরুদ্ধ মত ও দলকে কোন স্পেস দেয়নি। ফলে এ ধরণের অবস্থা তৈরি হয়েছে।"।
তার মতে, যেসব দল সন্ত্রাস করছে, অপকর্ম করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। কিন্তু সব রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন নিষিদ্ধ করা হবে আত্মঘাতি।

সমাধান কী?

রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা কোন সমাধান নয়। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ইস্যু, দেশ ও জাতীয় স্বার্থে কথা বলার জন্যই ছাত্র রাজনীতি থাকতে হবে।
তার মূল্যায়ন হচ্ছে, ছাত্র রাজনীতির যে ঐতিহাসিক গতিধারা অর্থাৎ জাতীয় স্বার্থে এন্টি এস্টাবলিশমেন্ট অবস্থান সেটার বিচ্যুতি ঘটেছে।
ছাত্র সংগঠনগুলো মূল দলের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করছে, জাতীয় স্বার্থ নয়।
"এখানে প্রায় ত্রিশ বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে তাদের ক্ষমতা ধরে রাখতে ছাত্র সংগঠনকে ব্যবহার করতে হবে। তারা ক্ষমতা ধরে রাখার হাতিয়ার হিসেবে ছাত্রদের ব্যবহার করছে। ক্যাম্পাসে যে অস্ত্র আসে সেগুলো কোথা থেকে আসে? মূল সংগঠন কিন্তু এগুলো জানে। তাদের সঙ্গে ছাত্রদের যোগসূত্র থেকেই এসব আসে।"
তিনি বলছেন, জাতীয় রাজনীতিতে সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রণ এবং সবার উপর আধিপত্য বিস্তারে জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর যে আকাঙ্খা সেখান থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে ছাত্র সংগঠন।
সুতরাং পরিবর্তনটা সবার আগে সেখান থেকেই হতে হবে।
তবে একইসঙ্গে শিক্ষকদেরও দলীয় রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষাঙ্গনে অপরাধ বন্ধে ভূমিকা নিতে হবে বলে মনে করেন মিসেস নাসরীন।
কারণ তার মতে, শিক্ষকদের একটা অংশ এখন রাজনীতিতে এসে ক্ষমতার অংশীদার হতে চায়।
এ প্রবণতা থেকেই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের অপরাধ আমলে না নেওয়ার প্রবণতা শিক্ষকদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে।
আবরার হত্যার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছিল বুয়েটসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা

No comments

Powered by Blogger.