পাকিস্তানের চোখ ধাঁধানো কূটনৈতিক অভ্যুত্থান by এম বিলাল লাখানি

ট্রাম্প-ইমরান খানের সম্মেলন কাভার করার জন্য ওয়াশিংটনে ল্যান্ড করার পর যখন উবারে করে যাচ্ছিলাম, তখন উবারের ইথিওপিয়ান ড্রাইভার বললেন, “জণগণ ভালো নেতাদের পছন্দ করে না, তারা চায় আগ্রাসী নেতা”। দুজন পরস্পরবিরোধী নেতার সমালোচক ও সমর্থকদের মধ্যে অভিন্ন মিল খুঁজে পাওয়াটা দুর্লভ কিন্তু কার্যত সবাই একমত যে দুজনেই তারা আগ্রাসী। ভারত, আফগানিস্তান এবং আমেরিকান ক্ষমতা কাঠামোর অনেকের আপত্তি সত্বেও যে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো, তার কারণ হলো নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের ব্যাপারে দুই নেতার আগ্রাসী নীতি: ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করতে চান এবং ইমরান পাকিস্তানের কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা দূর করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন যুগের সূচনা করতে চান, যেটার জন্য প্রয়োজন বিদেশী বিনিয়োগ।

পাকিস্তান কিভাবে এই কূটনৈতিক অভ্যুত্থান ঘটালো, সেটার পেছনের ঘটনা জানতে আমি কথা বলি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী প্রবাস বিষয়ক বিশেষ সহকারী জুলফি বুখারি, এবং উইলসন সেন্টারের এশিয়া প্রোগ্রামের ডেপুটি ডিরেক্টর মাইকেল কুগেলম্যান।

বর্তমান সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, পাকিস্তানের সাথে সাক্ষাতের জন্য তখন প্রস্তুত ছিল না আমেরিকা, গঠনমূলক বিনিময়ের কথা দূরে থাক। বিশ্বের জন্য একটা মাথাব্যাথা হিসেবে আমাদের দমিয়ে রাখা হয়েছিল। এই সময়টাতে ২০১৮ সালে ইউএনজিএ বৈঠকের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে আমেরিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানান শাহ মেহমুদ কোরেশি। এই সফরকালেই ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ লিন্ডসে গ্রাহাম ইমরান খানের সাথে বৈঠক করেন এবং তালেবানদের সাথে আলোচনার গুরুত্বের ব্যাপারে তার অবস্থান দেখে প্রভাবিত হন। তিনি জানতেন এটা ট্রাম্পের কাছে মিউজিকের মতো কাজ করবে, যিনি তার সেনাদেরকে ঘরে ফিরিয়ে নিতে চান, কারণ নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি এই যুদ্ধের ইতি টানার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

রাজনৈতিকভাবে আগ্রাসী মানসিকতার এই দু্‌ই নেতা ট্রাম্প ও ইমরান খান উভয়েই ব্যক্তিগতভাবে সামরিক সঙ্ঘাতের ব্যাপারে অনীহা রয়েছে। তালেবানদের সাথে আলোচনার বিষয়টি যখন জনপ্রিয় হয়নি, তখনই এই আলোচনার পক্ষে কথা বলে তালেবান খান আখ্যা পেয়েছিলেন ইমরান খান। অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ার সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সখ্যতা এবং ইরান মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করার পর পাল্টা আঘাত হানার নির্দেশ দিয়েও সেখান থেকে ফিরে আসার সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়েও তার মানসিকতা ফুটে উঠেছে। তাদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও এই সম্মেলন সফল হওয়ার পেছনে যে কারণটি ভূমিকা রেখেছে, সেটা হলো সামরিক সঙ্ঘাতের ব্যাপারে আদর্শগতভাবে উভয়ের বিরোধী অবস্থান।

হোয়াইট হাউজে যখন দুই নেতার বৈঠক চলছিল, তখন মাইকেল কুগেলম্যান কফি খেতে খেতে আমাকে বললেন, “ট্রাম্পের সাথে বৈঠক হওয়াটাই পাকিস্তানের জন্য একটা সাফল্য”। তবে বৈঠকের বাইরেও পাকিস্তান তিনটি বড় বিজয় পেয়েছে। প্রথমত, ট্রাম্প কাশ্মীর ইস্যুতে মধ্যস্থতাকারী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিজয় হলো, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, আমরা আফগান শান্তি আলোচনার ব্যাপারে নতুন করে কোন প্রতিশ্রুতি দেইনি। পাকিস্তান শুধু শান্তি প্রক্রিয়ার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহের আন্তরিকতার বিষয়টি আবারও উল্লেখ করেছে। পাকিস্তানের জন্য এটা একটা চোখ ধাঁধানো কূটনৈতিক ক্যু। বহু অর্জন হয়েছে, যেখানে বিনিময়ে দিতে হয়েছে সামান্য, যেটা নয়াদিল্লী ও কাবুলে মর্মবেদনার জন্ম দিয়েছে।

তৃতীয়ত, খানের বিশাল সমাবেশ যেটার মাধ্যমে তার বৈধতা নিয়ে প্রাথমিকভাবে যে কথা বলা হয়েছিল, সেটা নাকচ হয়ে গেছে এবং মাইক পম্পেও এমনকি তার এই বিপুল অভ্যর্থনা নিয়ে মন্তব্য করেছেন। পরদিন আমরা যখন হোয়াইট হাউজে গেছি, আগের দিনের সমাবেশটা তখন ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।

এরপর যা ঘটলো। ২০২০ সালের নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর আগেই সেনা প্রত্যাহার শুরু করতে চান ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভারত ও আফগানিস্তানকে বাদ দিয়ে এ জন্য তিনি পাকিস্তানের উপর ভরসা করতে চান। ইমরান খান যদি এই সব কিছুতে সফল হতে পারেন, তাহলে তাকে স্মরণ করা হবে আফগানিস্তানে শান্তি আনয়নকারী দূত হিসেবে, তাকে স্মরণ করা হবে সেই নেতা হিসেবে, যিনি ভারতকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করেছেন এবং অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছেন। ইতিহাসের দীর্ঘ গতিপথকে পাকিস্তানের অনুকূলে ঘুরিয়ে দিতে চেষ্টা করছেন ইমরান খান। ১২ মাসের মধ্যেই আমরা জানতে পারবো, তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করবেন, নাকি নিজেই ইতিহাস হয়ে যাবেন।

No comments

Powered by Blogger.