শোবিজের একাল-সেকাল by এন আই বুলবুল

আজ যা নতুন কাল তা পুরান। সময়ের সঙ্গে নতুনের আহবানে আমাদের সাড়া দিতে হয়। নতুনকে বরণ করে নিতে হয়। তাই বলে অতীত ভুলে যাওয়ার নয়। আমাদের একাল-সেকালের মধ্যে আছে অনেক পার্থক্য। সেকালের বিষয়গুলোকে মনে রেখেই পথ চলতে হয়। শোবিজের একাল-সেকাল নিয়ে কজন তারকার বয়ানে সাজানো হয়েছে এ আয়োজন।
ফেরদৌসী মজুমদার
যখন আমি নাটকে অভিনয় শুরু করি তখন এত সুযোগ সুবিধা ছিল না। বিশেষ করে সেই সময় মেয়েদের জন্য অভিনয় করা অনেক কঠিন একটা বিষয় ছিল।
আমার বড় ভাই শহীদ মুনির  চৌধুরী আমাকে নিয়ে আসেন এই পথে। পরবর্তীতে আবদুল্লাহ আল মামুন আমাকে গড়ে তুলেছেন। টেলিভিশনে-মঞ্চে তিনি আমাকে নিয়ে আসেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম নাটকে আমি অভিনয় করি। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও আমরা কখনো কাজে অবহেলা করতাম না। একটা নাটকের শুটিং করার আগে বেশ কয়েকবার মহড়া দিতাম। পরিচালকের সঙ্গে চরিত্র নিয়ে বসতাম। পুরো গল্পটা বোঝার চেষ্টা করতাম। সহকর্মীদের সঙ্গে চরিত্র নিয়ে আলোচনা করতাম। কারণ আমরা তখন সবাই নিজেদের একই পরিবারের ভাবতাম। সেই সময়ের নাটকগুলোর কথা এখনো অনেকের মুখে শোনা যায়। আমি দেখেছি নতুন প্রজন্ম সেই সময়ের কোনো নাটক পেলে কতটা আগ্রহ নিয়ে দেখেন। তখন আমাদের ছিল শুধু একটি চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশন। বিটিভিতে সেই সময় অনেক প্রথিতযশা গল্পকার ও নির্মাতা ছিলেন। তাদের নাটকে অভিনয় করা সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল। নাটকের প্রতি দর্শকের আগ্রহ অনেক বেশি। সাপ্তাহিক কিংবা ধারাবাহিক নাটক দেখার জন্য টিভির সামনে দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়ত। পুরানো দিনগুলো চোখের আয়নাতে ভাসে সব সময়। তবে সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। একটি চ্যানেল থেকে একাধিক চ্যানেল হয়েছে। একইসঙ্গে কমেছে নাটকের মান।
খুরশিদ আলম
একটা গানের রেকর্ডিংয়ের জন্য রাত পার করে দিতাম। যতক্ষণ গানটি সবার পছন্দ না হতো সেই সময় পর্যন্ত রেকর্ড হতো। যন্ত্রশিল্পী, কন্ঠশিল্পী ও সংগীত পরিচালক সবার মধ্যে তখন সুন্দর একটি সমন্বয় ছিল। গানটি করার আগে গীতিকার ও সুরকার বসতেন। সংগীতের সোনালী সময়ের যতগুলো গান জনপ্রিয় হয়েছে সবকটির পিছনে আছে এক একটি গল্প। গীতিকার-সুরকার একসঙ্গে না বসলে ভালো গান হয় না। একটি গান রের্কড শেষ করে যাওয়ার পর আবার খবর নিতাম কোথাও ভুল আছে কিনা। এই সমন্বয় এখন নেই বললেই চলে। আমি একটি গানের জন্য নব্বই বারের বেশি টেক দিয়েছি। কারণ তখন সব লাইভ বাজানো হতো। দেখা গেছে আমি ঠিক গেয়েছি। কিন্তু যন্ত্রশিল্পী ভুল করেছেন। তবে আমরা কেউ ধৈর্য হারাতাম না। আমাদের সবার লক্ষ্য থাকতো একটি ভালো গান তৈরি করা। ভালো কিছু সৃষ্টি করার জন্য ভালো মন থাকতে হয়। সবচেয়ে মজার বিষয়টি হলো আমাদের সময়ে গানে অ্যাকুস্টিক যন্ত্রের ব্যবহার থাকতো সব সময়। আর এ কারণে গানের সৌন্দর্য অনেক বেড়ে যেত। এই সময়ে গানে অ্যকুস্টিক ব্যবহার কমে গেছে। বেশির ভাগ গানে লুপ ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে গানের ওজন পাওয়া যায় না। গান এখন হয়ে গেছে মেশিনগান। শেষ কয়েক বছরে দেখেছি একটা অ্যালবামের ১০টি গানের প্রায় সবকটা একই সুরের। এখন আবার ইউটিউবের যুগ। সবাই একটি করে গান প্রকাশ করছে। এখানে আবার নতুন করে যোগ হয়েছে মিউজিক ভিডিও। গান কেমন হবে সেটির দিকে মনোযোগ নেই শিল্পীর। কিন্তু রগরগে একটা মিউজিক ভিডিও লাগবে।
আনোয়ারা
আমাদের সেই সময়ে মেয়েদের চলচ্চিত্রে কাজ করা সহজ ছিল না। যারা কাজ করতো তাদের অনেক কথা শুনতে হতো। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে আমাদের চলচ্চিত্রের বাজার বড় হতে থাকলো। ১৯৯৬১ সাল থেকে চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত আছি। বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি উর্দু ছবিতেও অভিনয় করেছি। তখন যে চলচ্চিত্রগুলো নির্মাণ হতো সেগুলো বিভিন্ন কারণে আলোচনায় থাকতো। নবাব সিরাউদ্দলাসহ এমন অনেক বিশেষ ব্যক্তির জীবনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ হতো। সাহিত্য থেকেও চলচ্চিত্র নির্মাণের একটা প্রথা ছিল। নব্বই দশক থেকে আমাদের চলচ্চিত্র অন্য দিকে মোড় নেয়। এই সময়ে একদিকে চলচ্চিত্রের বাজার বড় হয়। শিল্পীর সংখ্যা বাড়ে। একইসঙ্গে যোগ হয় অস্থিরতা। আমার যতটুকু মনে পড়ে শিল্পীরা আগে নির্মাতাদের কথার বাইরে কিছু করার সাহস পেত না। নির্মাতাদের বলা হয় ক্যাপ্টেন। এছাড়া শিল্পীদের মধ্যে একটি পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। সবাই সবার বিপদে আপদে পাশে থাকার চেষ্টা করত। এখন কাজ শেষে কেউ কারো খবর নেয় না। সত্যি সেই দিনগুলোকে অনেক বেশি মিস করি। নব্বই দশকের প্রায় সব শিল্পীর মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছি। তাদের কাছে আমি মায়ের মতোই ছিলাম। এখন আমাদের চলচ্চিত্রের সেই পরিবেশ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। চলচ্চিত্রের একজন অভিনেত্রী হিসেবে এটি আমার জন্য অনেক কষ্টের। সিনিয়র শিল্পীদের অনেকেই অভিমান করে চলচ্চিত্র থেকে দূরে আছে বলে জানি। সঠিক ভাবে চলচ্চিত্রের হাল ধরার কেউ এখন নেই।
বাপ্পা মজুমদার
একসময় পেশাদার স্টুডিওগুলোতে সুরকার, গীতিকার, যন্ত্রশিল্পী ও কণ্ঠশিল্পী মিলে একসঙ্গে গান তৈরি করতো। এর মাধ্যমে সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে একটা পারিবারিক যোগাযোগ তৈরি হতো। কিন্তু আমাদের এ সময়ের সংগীতে এখন আর সেই পরিবেশ নেই। গীতিকার দেখা পায় না সুরকারের। আবার অনেক সময় শিল্পী জানে না কে গানের গীতিকার-সুরকার। আমাদের এই সময়ে সমন্বয়ের বড় অভাব। এদিকে এখন ঘরে ঘরে হোম স্টুডিও। আর এ কারণে সবাই নিজস্ব জায়গা থেকে সবকিছু ভাবছেন। এতে করে সবার সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেছে। এর পেছনে অবশ্য কারণও আছে। এখন তো অডিও থেকে কোনো আয় নেই। খরচটা নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। হোম স্টুডিও হওয়াতে গানের টিমওয়ার্ক কমেছে। আগে বড় বড় স্টুডিওতে বেশির ভাগই টিমওয়ার্ক করে কাজ হতো। গানের সোনালী যুগ, সেই পরিবেশ আমরা এখন আর পাই না। উম্মুক্ত বাজারে সবাই নিজের মতো চিন্তা করে। একজন শিল্পী আগে গান করার পর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানে দৌড়াদৌড়ি করতো। এখন ইউটিউবের কল্যাণে সেটি করতে হচ্ছে না। দর্শক কে নতুন শিল্পী আর কে পুরান সেটি খোঁজে না। ভালো গান হলেই ইউটিউ সেটি গ্রহণ করে নিচ্ছে। তবে এটি সত্যি, এই সময়ে অনেক গানের কথা ও সুরে প্রাণ নেই। একইসঙ্গে সস্তা কথার গান হচ্ছে বেশি। কিছু কিছু প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এই ধরনের গানের শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতাও করছে। ইউটিউবে ভিউ বাড়ানোর জন্য রগরগে ভিডিও নির্মাণ করছে।
পপি
যে সময়ে আমার অভিষেক হয় তখন সুন্দর একটি বাজার ছিল চলচ্চিত্রের। এফডিসিতে প্রতিদিন সিনিয়র-জুনিয়র শিল্পীদের শুটিং থাকতো। আমি নিজেকে ভাগ্যবতি মনে করি, সেই সময় নায়করাজ রাজ্জাক, জসিম, শাবানা ম্যাডাম থেকে শুরু করে অনেক গুণী শিল্পীর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু একটা সময় আমাদের চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা ভর করে। আস্তে আস্তে চলচ্চিত্রের বাজার মন্দার দিকে ধাবিত হয়। একইসঙ্গে শুরু হয় সিনেমা হল বন্ধের পক্রিয়া। এখন তো আমাদের সিনেমা হল সীমিত। এদিকে আবার ডিজিটাল যুগ এলো। সব মিলিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রের অবস্থা এখন আর আগের মতো নেই। গুণী ও সিনিয়র শিল্পীরা তো চলচ্চিত্র থেকে দুরে আছে বলা যায়। বর্তমানে চলচ্চিত্র নির্মাণের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। কিছু কিছু চলচ্চিত্র মহরতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। গেল কয়েক বছরে নতুন অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিষেক হয়েছে চলচ্চিত্রে। তাদের মধ্যে অল্প সংখ্যক ছাড়া অন্যরা দর্শকের মনে দাগ কাটতে পারেনি। আমি মনে করি এই সময়ে চলচ্চিত্রের যে পরিবেশ এটি আমাদের কারো কাম্য নয়। চলচ্চিত্রের বাজার আবারও চাঙ্গা করার জন্য আমাদের সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। চলচ্চিত্রের স্বার্থে সবাইকে একই ছাতার নিছে আসা প্রয়োজন। বিশ্ব এখন প্রত্যেক মানুষের হাতের মুঠোয়। সেখানে আমাদের পিছিয়ে থাকলে চলবে না। পাশের দেশের শিল্পীরা একটা সময় আমাদের চলচ্চিত্রে কাজ করে নিজেকে ধন্য মনে করত। কিন্তু এখন তার বিপরীত হচ্ছে। আমরা একটু চেষ্টা করলে আমাদের সব কিছুর পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারি।
মেহজাবিন
আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন বিটিভির নাটক দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকতাম। অনেক সময় নাটক দেখার জন্য আগে-ভাগে রাতের পড়া শেষ করতাম। এখনো বিটিভির অনেক নাটকের কথা মনে পড়ে। কিন্তু এমন একটা সময়ে এসে আমরা কাজ করছি যখন আগের মতো সেই রকম পরিবেশ নেই। যাদের দেখে অনুপ্রাণিত হতাম কাজ করার জন্য তাদেরকেও আমরা পাই না। গেল কয়েক বছর ভালো নাটকের সংখ্যাও কমে গেছে। এই সময়ে তো দর্শক টিভিতে নাটক দেখে না বলা চলে। যে সকল নাটক জনপ্রিয় হচ্ছে সেগুলো ফেসবুক ও ইউটিউবের কল্যাণে। সত্যি বলতে, এই সময়ে আমাদের নাট্যাঙ্গনে অনেক অসংগতি আছে। আগে একটা নাটকের শুটিংয়ের কয়েক দিন আগে শিল্পীদের কাছে স্ক্রিপ্ট চলে যেত। আর এখন স্পটে স্ক্রিপ্ট দেওয়া হয়। এছাড়া আমরা যাদের আদর্শ ভাবি তাদের সেই সময়ে একটি নাটকে অনেক তারকার সমাগম থাকতো। তারকা শিল্পীদের পাশাপাশি প্রথিতযশা নির্মাতা ও স্ক্রিপ্ট রাইটার থাকতেন। ফলে দর্শক নাটকে বৈচিত্র পেত। এই সময়ে নাটকে যেটি বড় সমস্যা সেটি হলো বাজেট। বাজেট সংকটের কারণে অনেক গুণী নির্মাতা এখন নাটক নির্মাণ থেকে সরে দাড়িয়েছেন। আবার যারা নির্মাণ করছেন তাদের কেউ কেউ দায়সারা কাজ করছেন। যদি একটি কাজের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট না থাকে তাহলে সেই কাজটি কখনো সুন্দরভাবে শেষ করা যায় না। আমি মনে করি নাটকের বিভিন্ন সংগঠনগুলোকে এই সমস্যার সমাধানের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। একইসঙ্গে টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষদের নাটকের বাজেট নিয়ে আরও আন্তরিক হতে হবে। কাজের ক্ষেত্রে নির্মাতাকে পুরো স্বাধীনতা দিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.