যেদিন ভারতের ব্যাংকগুলোর মৃত্যু হলো by মিহির শর্মা

পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৬৯ সালের গত ১৯ জুলাই ভারত সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই জটিলতা থেকে এখনো মুক্তি মেলেনি। যে ১৪টি ব্যাংককে জাতীয়করণ করা হয়েছিল, সেগুলোতে ছিল মোট ব্যাংক আমানতের ৮৫ ভাগ। এখন, উদারিকরণের সিকি শতক পরও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলো এই খাতের মোট সম্পত্তির ৭০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে ঋণদান দুর্বল হয়ে পড়েছে, বেসরকারি খাতের বিকাশ রুদ্ধ হয়ে আছে, বারবার ব্যাংক খাতে সঙ্কট দেখা দেয়, করদাতাদের অর্থ দিয়ে ব্যাংকগুলোকে উদ্ধার করতে হয়।

ব্যাংক জাতীয়করণ করা নিয়ে যে বক্তব্যটি প্রচারিত রয়েছে তা হলো এই – ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মনে হয়েছিল যে ব্যাংকগুলো পুঁজিপতি ও তাদের অনুসারীদের সেবা করছে। তিনি ভারতের কৃষকদের পর্যায়ে ব্যাংকিং সেবা সম্প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন। আর তা করতে তিনি বিশাল গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে ব্যাংকগুলোর শাখা খোলার ব্যবস্থা করলেন।

কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ব্যাংক জাতীয়করণ ছিল ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেসের ইন্দিরা ও তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যকার ক্ষমতার লড়াইয়ের উপজাত। অর্থনীতি ছিল ভাসাভাসা বিষয়। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর ভারতের প্রতিষ্ঠাতা প্রজন্ম আধা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে নিচ্ছিলেন, প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল, জীবনমানের উন্নতি ঘটছিল। কিন্তু ১৯৬০-এর দশকের যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের পর ব্যবস্থাটি মনে হচ্ছিল ব্যর্থ হয়ে পড়েছে। কংগ্রেসের ভিন্নমতালম্বীরা তাই একে গুঁড়িয়ে দিতে চাইলেন।

রাজনীতিবিদ হিসেবে দুর্দান্ত মেধার অধিকারী ইন্দিরা এমন এক চাল চাললেন যে তাতে করে অর্থমন্ত্রীসহ তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলো। তিনি তাদেরকে সরকার থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করলেন। প্রথমে তিনি সরকারি খাতকে অদক্ষ হিসেবে অভিহিত করে তাদেরকে কুপোকাত করেছিলেন। তারপর নিজেই বিরোধী অবস্থান নিয়ে ব্যাংকগুলোকে জাতীয়করণ করলেন, শত্রুদের জন্য অন্য কোনো পথ খোলা রাখলেন না। এটা ছিল দলীয় রাজনীতির বিষয়, গরিবি হঠাওয়ের ব্যাপার ছিল না।

অনেকে এখনো দাবি করে থাকেন যে জাতীয়করণ এর লক্ষ্য অর্জন করেছে। গ্রামীণ এলাকাগুলোতে ব্যাংকের শাখা স্থাপিত হয়েছে। কারণ নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে শহর-নগরে একটি শাখা খুলতে হলে গ্রামে খুলতে হবে চারটি। কৃষি ঋণ বাড়ে। কারণ ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছিল যে কৃষি ও দারিদ্র বিমোচনে ঋণ দিতে হবে ১৮ ভাগ।

তবে এই বর্ধিত ঋণের প্রভাব ছিল ন্যূনতম। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল অর্থনীতিবিদ শন কোলের মতে, জাতীয়কারণের শুরুতে কৃষি খাতে নজিরবিহীন মাত্রায় ঋণ গিয়েছিল। এটা হয়েছিল মানহীন মধ্যস্থ প্রক্রিয়ায়। আবার কৃষি খাতে ঋণ বাড়ানোর ফলে কৃষি বিনিয়োগ বাড়াটা নিশ্চিত ছিল না। এমনকি বর্ধিত ঋণও টেকসই হয়নি।

এদিকে শিল্পে এর প্রভাব হয় নেতিবাচক। জাতীয়করণের ফলে ব্যাংকগুলো খুব কমই নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে উৎসাহিত হতো। ফলে নতুন উদ্যোক্তারা ঋণ অভাবে ভুগতেন। নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণে ব্যাংকের ব্যবস্থাপকেরা উদ্যোগী হতেন না। তারা তাদের রাজনৈতিক প্রভুদের নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকতেন।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে বারবারই ঋণ সঙ্কটের সৃষ্টি হয় এবং ব্যাংকগুলোর দায়মুক্তি ঘটে করদাতাদের টাকায়। তা এখনো চলছে। সর্বশেষ বাজেটে সরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য ১০.২ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রাখা হয়। এর মানে হলো, ২০১৭ সাল থেকে ব্যাংকিং খাতে ২.৭ ট্রিলিয়ন রুপি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও ব্যাংকগুলো এখনো খারাপ ঋণের বোঝায় ভারাক্রান্ত।

প্রধানমন্ত্রীর মোদির আমলে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ দিচ্ছে ন্যূনতম নিরাপত্তার ভিত্তিতে। র‌্যাংটিং সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, এসব ঋণের ১০ থেকে ১৫ ভাগ ইতোমধ্যেই কুঋণে পরিণত হয়ে গেছে।

গত ৫০ বছরে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে সামান্যই। যে ব্যাংকিং খাত হওয়া উচিত ছিল প্রবৃদ্ধি চাঙ্গাকারী, তারা এখনো রয়ে গেছে অদক্ষ ও অপচয়মূলক। আর এর কারণ হলো লোকরঞ্জক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক অগ্রাধিকারগুলোকে অগ্রাধিকার প্রদান করা।

No comments

Powered by Blogger.