ছেলেধরা গুজবে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল by নুর মোহাম্মদ মিঠু

মিথ্যা আর কুসংস্কারের এক অভিনব সমন্বয়ে সৃষ্ট গুজব— কখনো মিথ্যা, কখনো আংশিক সত্য, আবার কখনো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এক অভিনব কৌশল।

তবে সত্য-মিথ্যা আর প্রতিহিংসা— গুজবে কার ভূমিকা কতটুকু তার সঠিক হিসাব মেলানো কঠিন। সামাজিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মোক্ষম হাতিয়ার গুজব বর্তমানে মহামারী আকার ধারণ করেছে। বঙ্গবন্ধু থেকে পদ্মা সেতু।

এর মাঝেই দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে মাথা কাটার গুজব। যে গুজবের সত্যতা যাচাই না করে চিলের পিছে ছুটে চলা মানুষেরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে। যার দরুণ যেখানে সেখানে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ায় ঘটছে ফৌজদারি অপরাধ।

গুজবের পেছনে স্বার্থান্বেষী কোনো একটি গ্রুপ থাকে। আরেক গ্রুপ থাকে, যারা এই গুজবকে কাজে লাগায়। বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ ও পদ্মা সেতুতে অভিন্ন রূপে উত্তীর্ণ হয়েছে দেশের মানুষ। এ যেন বিনাবিচারে মানুষ হত্যার উন্মাদ আচরণ!

চলমান গুজবের মধ্যেই নেত্রকোনায় এক মাদকাসক্তের কাছে শিশুর কাটা মাথা পাওয়া যায়। ওই ব্যক্তিকেও গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। অথচ গণপিটুনিতে প্রাণ হারানোর কারণে জানা যায়নি শিশুটির মাথা কাটার কারণ।

এরপর কক্সবাজার, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনির খবর পাওয়া গেছে। যা প্রতিনিয়তই ঘটছে। কিন্তু কক্সবাজারের ঘটনায় আহত রোহিঙ্গা তরুণী ধর্ষণ থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করতে ডেকেছিলেন শিশুকে। অথচ ছেলেধরা মনে করে লোকজন তাকে গণপিটুনি দেয়।

ভাগ্যক্রমে ওই তরুণীকে পুলিশে দেয়ায় এ যাত্রার তিনি প্রাণে বাঁচলেও বাঁচতে পারেননি রাজধানীর বাড্ডায় ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাবেন বলে তথ্য জানতে আসা নারী তাসলিমা বেগম রেনু। তিনি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে বসে কথা বলছিলেন, অথচ গুজবের বশে উত্তেজিত জনতা তাকে টেনেহিঁচড়ে বের করে এনে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করেছে।

কিন্তু কারো ভাবনায় একবারের জন্যও আসেনি— তিনি আদৌ ছেলেধরা কি না! নারায়ণগঞ্জের মিজমিজি এলাকায়ও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সেখানেও গণপিটুনিতে এক যুবক নিহত হয়েছে। কিন্তু কেউই নিশ্চিতভাবে জানেন না, ওই যুবক আসলেই ছেলেধরা ছিলেন কি না। কিন্তু সেসব বিবেচনার আগেই তার জীবন শেষ।

কেবল সন্দেহের বশে একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ উল্লেখ করে পুলিশ সদর দপ্তর দেশের মানুষকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার অনুরোধ করে। কেবল কিছু ব্যতিক্রম বাদে কোনো অবস্থায়ই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার সুযোগ নেই। যারা কেবল সন্দেহের বশে এমন গর্হিত কাজ করেছেন, তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। তার মধ্যে বাড্ডার ঘটনায় ইতোমধ্যে ৪০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছে পুলিশ। দেশে ইমারজেন্সি সার্ভিস ৯৯৯ রয়েছে। পুলিশ অ্যাপসে সারাদেশের পুলিশের নম্বর আছে।

যেকোনো বিষয়ে কারো সন্দেহ থাকলে পুলিশকে সেটি জানানোর ব্যবস্থাও রয়েছে। কিন্তু চিলে কান নিয়ে গেছে ভেবে চিলের পেছনে ছোটা এ জাতি তার নাগালে থাকা সকল আইনি সুবিধা গ্রহণ না করেই চলমান গুজবে ফৌজদারি অপরাধের জড়াচ্ছে।

এ বিষয়ে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর প্রধান এসপি তবারক উল্লাহ বলেন, পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ নিয়ে বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে আমাদের প্রতি। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য— ছেলেধরা সন্দেহে যেসব বিচ্ছিন ঘটনা ঘটছে, সেগুলো ঘটার পরই আমরা জানতি পারছি। কিন্তু ঘটনার আগে কেউই জাতীয় জরুরি সেবায় ফোন করে ছেলেধরা সন্দেহে আটক ব্যক্তিদের বিষয়ে বলছেন না। তার আগেই তারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছেন।

এদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা গণমাধ্যমে বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে বলে গুজব ছড়ানোকে কেন্দ্র করে সমপ্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মর্মান্তিকভাবে কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।

গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রবিরোধী কাজের শামিল এবং গণপিটুনি দিয়ে মৃত্যুর ঘটানো ফৌজদারি অপরাধ।

তিনি আরও বলেন, ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়ে এ পর্যন্ত যতগুলো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, পুলিশ প্রত্যেকটি ঘটনা আমলে নিয়ে তদন্তে নেমেছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে ছেলেধরা সন্দেহে কাউকে গণপিটুনি দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার জন্য সকলের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।

গুজব ছড়ানো এবং গুজবে কান দেয়া থেকে বিরত থাকুন। কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সমাজবিজ্ঞানী ড. এ এইচ এম আমান উল্লাহ বলেন, পশ্চাৎপদ দেশেও গুজবের সংস্কৃতি রয়েছে। ভারত, আফ্রিকাসহ উন্নত দেশেও গুজবের সংস্কৃতি আছে।

আফ্রিকায়ও অনেক মানুষ গুজবের কারণে মৃত্যুবরণ করতে দেখা যায়। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এটা বেশিই হচ্ছে। আমাদের দেশে গুজব তৈরি করা হয়। যেটা করছে— কোনো একটি স্বার্থান্বেষী মহল।

এটা নিজে নিজে কখনোই তৈরি হয় না। এ গুজব কারা ছড়াচ্ছে, কেন ছড়াচ্ছে এবং গুজব তৈরিতে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে তার রহস্য জানতে হবে। শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে।

বিচারের আওতায় না আনলে এসবের কারণ অজানাই থেকে যাবে। তিনি বলেন, সমাজকে ডিস্টিবিলাইজড করা, সমাজের দৃষ্টি অন্য দিকে ফিরিয়ে দেয়া, রাষ্ট্রের মোড় ঘুরিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্যই কোনো একটি মহল গুজব সৃষ্টি করে।

মূলত গুজব সৃষ্টির করে তারা অন্য কাজ করছে। গুজবের আড়ালে তাদের স্বার্থ হাসিলের কাজকে লোকচক্ষুর আড়াল করতেই সমাজ কিংবা রাষ্ট্রকে গুজবে বিভোর করছে স্বার্থন্বেষী মহল। এ মহল দেশকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে অশিক্ষিত বেশি এবং কুসংস্কার বেশি। রাষ্ট্রকেই এসব নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের সক্ষমতা দেখাতে হবে। তবে সেটা আইনের মধ্য থেকেই করতে হবে— ক্রসফায়ারের মাধ্যমে নয়।

রাজধানীর বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নারী নিহতের ঘটনায় ৪০০ জনকে আসামি করে মামলা দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এভাবে সঠিক সমাধান হবে না, ঢালাওভাবে মামলা করে ঘুষ-বাণিজ্য ছাড়া কিছুই হয় না।

এসব ঘটনায় স্থানীয়ভাবে তদন্ত করে জড়িতদের শনাক্ত করার মধ্য দিয়েই বিচারের আওতায় আনতে হবে।

এদিকে গত রোববার পর্যন্ত ছেলেধরা সন্দেহে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এ পর্যন্ত ছয়জনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এছাড়া গণপিটুনির শিকার হয়ে আহত হয়েছেন ২১ জন।

২১ জুলাই ময়মনসিংহের ভালুকার ধামশুর এলাকার একটি মোটর সাইকেলের যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানায় আয়ার কাজ করা পাঁচগাঁও গ্রামের গৃহবধূ মালেকা খাতুনকে বাড়িতে ঢুকে পানি চাওয়ায় ছেলেধরা সন্দেহ হাত-পা বেঁধে গণপিটুনি দেয় বাড়ির মালিক।

খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাকে উদ্ধার করে ভালুকা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। লালমনিরহাটে শনিবার রাতে একইভাবে মানিসক প্রতিবন্ধী আরেক নারীকে গণপিটুনি দেয় উত্তেজিত জনতা।

এ ঘটনায় ওই নারীকে উদ্ধার করতে গেলে পুলিশের এক কর্মকর্তাকেও আহত করে তারা। কুমিল্লায় সরদ উপজেলার আমড়াতলী এলাকায়ও ছেলেধরা সন্দেহে নারীসহ তিনজনকে গণপিটুনি দেয়া হয়। নওগাতেও ছেলেধরা সন্দেহে ছয় জেলেকে গণপিটুনি দেয় জনতা।

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় ২১ জুলাই ছেলেধরা সন্দেহে তিনজনকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে জনতা। পাবনার ভাঙ্গুড়ায় ছেলেধরা সন্দেহে খুশিয়ারা (৩০) নামে এক গৃহবধূকে আটকের পর পুলিশে সোপর্দ করেছে স্থানীয় জনতা।

বান্দরবানে ছেলেধরা সন্দেহে রোকেয়া আক্তার (১৮) নামে এক রোহিঙ্গ্যা নারীকেও গণপিটুনি দিয়েছে জনতা। এ ছাড়া পাবনায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির হাতে থেকে এক নারীসহ তিনজনকে উদ্ধার করেছে পুলিশ।

গতকাল দুপুরে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে জহুরুল (৩০) ও জিয়া উদ্দিন (৩৫) নামের দুই ব্যক্তি এবং সদর উপজেলার ভাড়ারা ইউনিয়নের দড়িভাউডাঙ্গা গ্রাম থেকে সোনিয়া (২৩) নামে এক নারীকে উদ্ধর করে পুলিশ।

গত শনিবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন আরও এক নারী। যাকে সাভার মডেল থানা এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেয় জনতা। এ ঘটনায় সাভার মডেল থানায় একটি মামলাও হয়েছে বলে জানা গেছে।

বাড্ডায় নিহত নারী ছেলেধরা ছিলেন না, ৪০০ জনের বিরুদ্ধে হত্যামামলা সন্তানকে স্কুলে ভর্তির জন্য স্কুলে খোঁজ নিতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন এক হতভাগ্য মা। তার নাম তাসলিমা বেগম রেনু (৪০)।

শনিবার সকালে রাজধানীর বাড্ডায় এ ঘটনা ঘটলেও এই হতভাগ্য মায়ের পরিচয় মিলে রাতে। নিহত তাসলিমা বেগম রেনুর ভাগ্নে সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তার লাশ সনাক্ত করেন। নিহতের পরিবারের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেছেন।

সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু ঢামেক হাসপাতালের মর্গে সাংবাদিকদের জানান, নিহত হওয়া ওই নারী তার খালা তাসলিমা বেগম রেনু। বয়স আনুমানিক ৪০ বছর।

তিনি মহাখালীর ৩৩/৩ জিপি জ ওয়ারলেস গেইটে থাকতেন। তার দুই ছেলে। এর আগে তিনি স্কুলের পাশে আলী মোড় এলাকায় স্বামী তসলিম হোসেনের সাথে পরিবার নিয়ে থাকতেন।

দুবছর আগে পারিবারিক কলহের কারণে তাদের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। এরপর থেকে সন্তানদের নিয়ে মহাখালীতে বাসা ভাড়া করে থাকতেন।

তিনি ছেলেধরা ছিলেন না। তিনি আরও বলেন, নিহত রেনু শনিবার সকালে উত্তর বাড্ডায় ওই স্কুলে গিয়েছিলেন সন্তানকে ভর্তি করানোর জন্য খোঁজখবর নিতে।

সেখানে তাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন থাকতে ওই এলাকার লোকজন তাকে পিটিয়ে হত্যা করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে এর বিচার দাবি করেন তিনি। নিহত রেনু লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুরা থানার সোনাপুর গ্রামের মৃত আব্দুল মান্নানের মেয়ে।

তাসলিমা বেগম রেনুকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় বাড্ডা থানায় ৪০০-৫০০ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যামামলা দায়ের হয়েছে। মামলাটি বাদি হয়ে দায়ের করেন নিহত রেনুর ভাগ্নে নাসির উদ্দিন টিটো। মামলা নম্বর- ৩০।

বাড্ডা থানার ওসি (অপারেশন) ইয়াসিন গাজী বলেন, নিহত হওয়া নারীর ভাগিনাসহ স্বজনরা লাশ প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করেন। এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ ঢামেক মর্গে রাখা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.